সড়কে মৃত্যুর ৩০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়, বেপরোয়া গতি মূল কারণ

শুক্রবার রাতে ঢাকার পল্লবী এলাকায় কালশী ফ্লাইওভারের ওপর একটি গাড়ির সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই যুবক নিহত হন। পুলিশ জানিয়েছে, দুটি গাড়িই দ্রুতগতিতে চলছিল এবং বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুসারে, গত দুই সপ্তাহে দেশব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে, যার মূল কারণ ঈদ ভ্রমণ। সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৩০ শতাংশই ঘটে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণে।
পুলিশ ও সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ বেপরোয়া মোটরবাইক চালানো ও অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো।
যাত্রী কল্যাণ সংস্থা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, ২৪ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ২১৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২৩৯ জন নিহত ও ৫১৬ জন আহত হয়েছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, 'আমাদের প্রতিবেদন এখনও চূড়ান্ত করা হচ্ছে, তাই এই মুহূর্তে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে সংখ্যাটি গত বছরের মতোই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।'
গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে-পরে মিলিয়ে ১৫ দিনে সড়কে ৩৯৯ দুর্ঘটনায় ৪০৭ জনের প্রাণ গেছে। এর মধ্যে ১৯৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৫ জন নিহত হয়—যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৯.৬২ শতাংশ ও নিহতের ৪০.৫৪ শতাংশ।
বিআরটিএর তথ্যেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মোট সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪০৪ জন, যার মধ্যে ১৩৭ জন বা ৩৩.৯ শতাংশ মারা যায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। পরের মাসগুলোতেও এই প্রবণতা অব্যাহত ছিল। ফেব্রুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের ৩২.৫ শতাংশ, মার্চে ২৯.৩ শতাংশ, এপ্রিলে ৩০.২ শতাংশ, মে মাসে ২৯.৩ শতাংশ ও জুনে ৩১ শতাংশ মৃত্যু হয় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। জুলাই মাসে এই মৃত্যুহার অপ্রত্যাশিতভাবে ২৬.১ শতাংশে নেমে আসে, যা আবার বেড়ে আগস্টে ৩০.৩ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ২৯.১ শতাংশ, অক্টোবরে ২৯.২ শতাংশ, নভেম্বরে ৩৪.৮ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে ৩৬.১ শতাংশে দাঁড়ায়।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে ৪৩.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, বেপরোয়া গতিতে বাইক চালানোই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
তিনি বলেন, 'দেশে বাইক অ্যাক্সিডেন্টের ৫৮ শতাংশই ঘটে বেপরোয়া গতির কারণে। এক্ষেত্রে মোটরসাইকেল কোম্পানিগুলোরও দায় রয়েছে। কারণ তারা বিজ্ঞাপনের জন্য তৈরি করা ভিডিওগুলোতে বেপোরোয়া গতিতে চালাতে উৎসাহ দেয়।'
সাইদুর আরও বলেন, 'বাংলাদেশের মোট যানবাহনের প্রায় ৭১ শতাংশই মোটরসাইকেল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব বাইক চালায় কিশোররা। অনেকেরই লাইসেন্স নাই। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে হেলমেট ব্যবহার না করার প্রবণতা দেখা যায়। শহরাঞ্চলে হেলমেট ব্যবহার করা হলেও এগুলো খুবই নিম্নমানের। পুলিশের সামনে দিয়ে কিশোর বয়সের ছেলেরা এসব হেলমেট নিয়ে যাতায়াত করছে। তারা কিছু করে না।'
এই পরিস্থিতির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায় আছে উল্লেখ করে সাইদুর বলেন, 'ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার না করা, বেপরোয়া গতিতে বাইক চালানো, চালকের পেছনে একের অধিক যাত্রী বসার জন্য যদি ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তবে পরিস্থিতির উন্নতি হতো।'
অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (হাইওয়ে পুলিশ) মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের জায়গা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের প্রবেশমুখগুলোতে ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রিত গতিতে বাইক চালাতে নিয়মিত মাইকিং করা হচ্ছে। যারা লাইসেন্সবিহীন অথবা হেলমেট ছাড়া বাইক চালায়, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে গাড়ি জব্দ করা হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'পুলিশের একার পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা কঠিন। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও ব্যক্তিপর্যায়ে এগুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।'
এদিকে ঈদের ছুটিতে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অভ ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতাল।
এসব হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেন, বেশিরভাগ আহতই মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার দুর্ঘটনার কারণে জখম হয়েছেন।
৩০ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত নিটোরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মোট ৪১২ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ১৪১ জন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন, বাকিরা অন্যান্য যানবাহনের দুর্ঘটনার শিকার।
কালশী ফ্লাইওভারে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পর গাড়িচালক আটক
কালশী ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন ঢাকার মাটিকাটার বাসিন্দা নবম শ্রেণির ছাত্র মো. তোফাজ্জল (১৬) ও চাঁদপুরের বাসিন্দা মো. রিয়াদ হোসেন (১৮)।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুজনকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে এক ঘণ্টা পর চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নজরুল ইসলাম।
থানার উপ-পরিদর্শক আতিকুর রহমান বলেন, অনলাইন গেম ফ্রি ফায়ারের মাধ্যমে দুই তরুণের বন্ধুত্ব হয়েছিল। রিয়াদ ঈদের ছুটিতে তোফাজ্জলের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় এসেছিল।
দুর্ঘটনায় জড়িত গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে এবং এর চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান ওসি নজরুল।