শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে মামলার মুখে পড়তে পারে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ

দেশের বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের (বিএটিবি) কুষ্টিয়ায় অবস্থিত তামাক প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় প্রায় ৪৫ ধরনের শ্রম আইন ও নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা শনাক্ত করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়। শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের বেনিফিট না দেওয়া, সপ্তাহিক ছুটি না দেওয়া, নিয়োগপত্র সংক্রান্ত রেজিস্ট্রার না থাকাসহ বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বহুজাতিক কোম্পানিটি তার কুষ্টিয়ার কারখানাটিকে মৌসুমি কারখানা হিসেবে নিবন্ধন করালেও এটি মূলত সারা বছরই পরিচালিত হয় এবং এটি বিএটিবির অন্যতম প্রধান প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, কারখানাটিতে শ্রমিকদের স্বাভাবিক কর্মঘণ্টার বাইরেও অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাদেরকে সাপ্তাহিক ছুটিও দেওয়া হয় না।
এছাড়া, সেখানে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই; এমনকি, আইনের বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকরা পেশাগত কোনো রোগে আক্রান্ত হলে কিংবা কর্মক্ষেত্রে কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে তাদেরকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না।
এরমধ্যে ২২টি বিষয় সংশোধনের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিলেও কোম্পানিটি তা পরিপালন করেনি। এ নিয়ে বহু চিঠি চালাচালির পর গত ৪ মার্চ শ্রম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ব্যাখ্যা চেয়েছে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) কুষ্টিয়া অফিস।
গত ৯ মার্চ, ডিআইএফই-এর কুষ্টিয়া অফিসের উপ-মহাপরিদর্শক ফরহাদ ওয়াহাব স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বিএটিবির কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
বিএটি'র কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়ার সংক্রান্ত চিঠির বিষয়টি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে নিশ্চিত করেছেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান।
তিনি বলেন, "বিষয়গুলো পরিপালনে জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে আগে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তা করেনি। এরপর আমরা পরবর্তী আইনানুগ পদক্ষেপ নেব।"
"ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বড় প্রতিষ্ঠান বলে যে তারা পার পেয়ে যাবে, সে সুযোগ নেই," বলেন তিনি।
আইনানুগ পদক্ষেপ কী, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি তিনি।
অবশ্য ডিআইএফইর এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "বিষয়টিকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছি। তাদেরকে যেসব বিষয়ে সংশোধনের জন্য বলা হয়েছে, সেগুলো না করা হলে মামলা হতে পারে।"
বিএটিবির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে।
পরে এর একজন মুখপাত্র লিখিত বিবৃতিতে জানান, 'একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএটিবি স্থানীয় আইন ও বিধিনিষেধের সম্পূর্ণ অনুসরণের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা ডিআইএফই-এর সমস্ত রেগুলেটরি অবজারভেশন নোট করেছি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যথাযথভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'আমরা ইতোমধ্যে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি এবং যেগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, সেগুলোও ব্যাখ্যা করেছি এবং এ বিষয়ে ডিআইএফই-এর সঙ্গে আলোচনা করছি।'
অবশ্য গত ৩০ অক্টোবর বিএটিবির কুষ্টিয়া কারখানার সাবেক প্ল্যান্ট ম্যানেজার এম আলম খান স্বাক্ষরিত ডিআইএফইতে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, 'যে ২২টি বিষয় পরিপালনের কথা বলা হয়েছে, বিএটি তা পালনে বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে একটি ক্রস-ফাংশনাল টিম গঠন করা হয়েছে। তবে মৌসুম শেষ হওয়ায় তা পরবর্তী মৌসুমের আগে পরিপালন করা সম্ভব নয়।'
তাই পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত সময় চাওয়া হয় ওই চিঠিতে।
তবে ডিআইএফইর পক্ষ থেকে লিখিতভাবে বলা হয়েছে, 'মৌসুম শুরুর আগ পর্যন্ত সময় চেয়ে মূলত আইন বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।'
যেভাবে প্রকাশ্যে এলো বিএটিবি'র শ্রম আইনের লঙ্ঘন
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কুষ্টিয়া লিফ ফ্যাক্টরি নামের ওই তামাক প্রক্রিয়াকরণ কারখানাটি কয়েক দশকের পুরনো।
২০০৭ সালে কারখানাটি সিজনাল তামাক প্রক্রিয়াকরণ কারখানা হিসেবে নিবন্ধন নেয়। অর্থাৎ বছরে ১২৫ দিন বা ৪ মাস চলমান থাকবে কারখানাটি। কিন্তু গত জুলাইয়ে মৌসুমী শ্রমিকদের মধ্য থেকে একটি অংশ পুনরায় নিয়োগ না পাওয়ায় তারা বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম তুলে ধরে স্থানীয় জেলা প্রশাসন এবং ডিআইএফইর কাছে অভিযোগ দেন।
এর ভিত্তিতে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন গত ২৯ আগস্ট স্থানীয় ডিআইএফই অফিস ও ডিপার্টমেন্ট অব লেবারকে তদন্ত করার অনুরোধ জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল তদন্ত করে ২২ ধরনের শ্রম আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
এর সূত্র ধরে গত সেপ্টেম্বরে কারখানাটিতে শ্রম অধিকারের পাশাপাশি সেফটির বিষয়েও বিস্তারিত ইনস্পেকশন করে ডিআইএফই। তাতে ওই কারখানাটিতে সব মিলিয়ে ৪৫ ধরনের অনিয়মের চিত্র উঠে আসে।
মোটাদাগে যেসব অনিয়ম
প্রতিবেদনে উঠে আসে, কারখানায় শ্রমিকদের কাজের ধরণ অনুযায়ী তথ্যসহ নিয়োগপত্র দেওয়া এবং ছবিসহ পরিচয়পত্র সরবরাহ করা হয়নি। তামাকের মতো স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারখানাটিতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া, কারখানার অভ্যন্তরে চলাচলের পথ প্রতিবন্ধকতামুক্ত নয় এবং অনেক স্থানে লোহার তৈরি সিঁড়ি ও পাটাতন ব্যবহার করা হয়েছে।
অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানটিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ও সরঞ্জাম নির্দিষ্ট স্থানে কার্যকরভাবে প্রস্তুত রাখা নেই এবং এগুলোর ব্যবহার সংক্রান্ত কোনো রেকর্ডও সংরক্ষণ করা নেই।
এছাড়া, কর্মকালীন দুর্ঘটনায় মলিক কর্তৃক আক্রান্ত শ্রমিকদের পূর্ণ আরোগ্য হওয়া পর্যন্ত বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান না করা, আইন অনুযায়ী পোশাগত ব্যাধি ও দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ না দেওয়া, শিশু কক্ষের ব্যবস্থা না রাখা, শ্রমিকের স্বাভাবিক কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত ডিউটি করানো, সপ্তাহিক ছুটি প্রদান না করার মত বিষয়ও তদন্তে উঠে আসে।
একইসঙ্গে, আইন অনুযায়ী লভ্যাংশ প্রদান না করার প্রমাণও মিলেছে।
অন্যদিকে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাাঙ্গায় মোট সাতটি কারখানার মধ্যে একটি বাদে বাকি কারখানার লাইসেন্সও নেওয়া হয়নি।
আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত শ্রমিকরা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সাল থেকে নিয়োগকৃত মৌসুমী শ্রমিকদের প্রতি বছর ছাঁটাই বা টার্মিনেট করা হতো না। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে বছর বছর টার্মিনেশন শুরু হয়। দেশের বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী, মৌসুমী শ্রমিকদের টার্মিনেট করার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে, কারখানাটি মৌসুমী কারখানা হিসেবে নিবন্ধিত হলেও তা লঙ্ঘন করেছে বলে ডিআইএফইর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
কারখানার সাবেক শ্রমিক ও ডিআইএফই কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুষ্টিয়ায় অবস্থিত বিএটিবি'র কারখানাটিতে প্রায় ১,৭০০ শ্রমিক কাজ করলেও মাত্র ৪১ জন ম্যানেজমেন্ট এর সাথে যুক্ত ও ২৮ জন স্থায়ী শ্রমিকসহ মোট ৬৯ জন স্থায়ী। ঽ
বাকি শ্রমিকদের ১৪৬ জন মৌসুমী শ্রমিক এবং অন্যরা ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া। স্থায়ী শ্রমিক বাদে অন্যরা শ্রম আইন অনুযায়ী প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটিসহ লভ্যাংশ পান না।
ডিআইএফই'র একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, "প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিকদের লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করতেই মূলত কৌশলে এ কাজটি করা হয়েছে।"
প্রতিষ্ঠানটিতে ২০১৩ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন – এমন একজন শ্রমিক শামিম উল আলিম টিবিএসকে বলেন, "১১ বছর কারখানাটিতে কাজ করলেও বেতনের বাইরে শ্রম আইন অনুযায়ী অন্য কোনো আর্থক সুবিধা আমি পাইনি।"
"মূলত শ্রমিকদের আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার জন্য মৌসুমী এবং অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মতো অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে বিএটি। এই উপায়ে তারা আমাদেরও আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে।"
প্রসঙ্গত, কেবল স্থায়ী শ্রমিকরাই প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, প্রফিট শেয়ারসহ শ্রম আইন অনুযায়ী অন্যান্য আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন।
কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় বছরে কোম্পানির ব্যবসা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সব ধরনের খরচ বাদ দিয়ে কোম্পানিটি কেবল ২০২৪ সালেই মুনাফা করেছে ১,৭৫০ কোটি টাকার বেশি।