দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজের ৪৩ শতাংশ শিক্ষক পদ শূন্য, আগামী বছর থেকে কমবে ভর্তির সংখ্যা

শিক্ষক সংকট নিরসনের দাবিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাত দিনের কর্মবিরতি পালন করেছিল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। তবে এখনো সংকট কাটেনি। কলেজটিতে ৩৪৩টি শিক্ষকের পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৩৭ জন। বিশেষ করে অধ্যাপকের ৫৩টি পদের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন মাত্র চারজন।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আজিমুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের আন্দোলনের ফলে তখন ১৬ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, এতে সংকট কিছুটা কমেছে। যেসব বিষয়ে একেবারেই শিক্ষক ছিল না, সেসব ক্ষেত্রে কিছু নিয়োগ হয়েছে। তবে এখনো বেসিক সাবজেক্টে শিক্ষক সংকট রয়ে গেছে।'
তিনি জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুসারে মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। লেকচার ক্লাসে ২৩৪ জন শিক্ষার্থী একসঙ্গে পড়েন, যেখানে আদর্শ গাইডলাইনে গ্রুপ স্টাডির জন্য ১৫ থেকে ২০ জন থাকার কথা থাকলেও শিক্ষক সংকটের কারণে সেটি ৪০ জনের গ্রুপে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। আগে যা ৬০ থেকে ৮০ জনের গ্রুপ ছিল। ফলে শিক্ষার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তবে এই সংকট শুধু শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজেই নয়, দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজেই একই অবস্থা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস (এমআইএস)-এর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর ৪২ দশমিক ৬০ শতাংশ শিক্ষক পদ শূন্য রয়েছে।
সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মোট ৬ হাজার ৪৪৬টি শিক্ষকের পদের মধ্যে ২ হাজার ৭০০টি পদ শূন্য। সবচেয়ে বেশি সংকট রয়েছে অধ্যাপক পদের ক্ষেত্রে, যেখানে ৬৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে।
এছাড়া, সহকারী অধ্যাপকের ৭৩৫টি পদের মধ্যে ১ হাজার ৬৩৪টি এবং সহযোগী অধ্যাপকের ২ হাজার ৪৫৩টি পদের মধ্যে ১ হাজার ২৫০টি শূন্য রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে জেলায় জেলায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত মেডিকেল কলেজ স্থাপন করলেও অবকাঠামো ঘাটতি, শিক্ষক ঘাটতি আছে। অনেক মেডিকেল কলেজের সাথে হাসপাতাল নেই। এসব সংকটের কারণে সরকারি মেডিকেল থেকে অদক্ষ ডাক্তার বের হচ্ছে।
বাংলাদেশ হেলথ রাইটস মুভমেন্টের চেয়ারম্যান ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. রাশিদ-ই-মাহবুব বলেন, 'শিক্ষক সংকট দীর্ঘদিনের সমস্যা। এটি সমাধান না হলে মানসম্মত চিকিৎসক তৈরি হবে না, ফলে রোগীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।'
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ড. মো. সাইদুর রহমান বলেন, 'মেডিকেল কলেজে একজন শিক্ষক তৈরি হতে ৫-৭ বছর সময় লাগে। এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেনসিক মেডিসিন ও ভাইরোলজি—এই আটটি বেসিক বিষয়ের শিক্ষক সংকট সবচেয়ে বেশি।'
তিনি আরও বলেন, 'গাইনি ও কার্ডিওলজির মতো ক্লিনিক্যাল বিষয়ে তেমন সংকট নেই। কিন্তু বেসিক বিষয়ের ক্ষেত্রে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ কম থাকায় শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার হার কম। আমরা বেসিক সাবজেক্টে শিক্ষক তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছি, তবে এটির ফল পেতে ৩-৫ বছর সময় লাগবে।'
'শিক্ষক বা অবকাঠামো সংকটের কারণে সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে মানহীন ডাক্তার তৈরি হবে সেটা আসলে দুঃখজনক। আমরা মেডিকেল শিক্ষার মান উন্নয়নের চেষ্টা করছি', যোগ করেন তিনি।
২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে আওয়ামী লীগ সরকার এমবিবিএস কোর্সে ১ হাজার ৩০টি আসন বাড়িয়েছিল, যার ফলে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৮০টি। তবে আগামী বছর থেকে এই সংখ্যা কমানো হবে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিজিএমই) মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, আগের সরকার পরিকল্পনা ছাড়াই নতুন মেডিকেল কলেজ চালু করেছে এবং আসন সংখ্যা বাড়িয়েছে, কিন্তু সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বা শিক্ষকের ব্যবস্থা করা হয়নি।
তিনি বলেন, 'মেডিকেল শিক্ষার ন্যূনতম মান বজায় রাখতে হলে ৫ হাজার ৩৮০ আসন রাখা সম্ভব নয়। অনেক মেডিকেল কলেজে এমনকি ২০০ শিক্ষার্থীর জন্য যথাযথ ক্লাসরুমও নেই, অথচ সেখানে ২৫০ জন পর্যন্ত ভর্তি করা হয়েছে। যেখানে যতটুকু ম্যাক্সিমাম ক্যাপাসিটি আছে তার বেশি যেন স্টুডেন্ট না থাকে সেটা নিশ্চিত করা হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকারি মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি মানহীন মেডিকেল কলেজগুলো নিয়েও কাজ করা হচ্ছে। আমরা মেডিকেল কলেজগুলো সরেজমিন দেখে সিদ্ধান্ত নেব। মেডিকেল কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার চেয়ে সিট সংখ্যা কমানো সহজ। সিট সংখ্যা কমানোটা এক ধরনের শাস্তি, এর ফলে তাদের ব্যবসাও কমে যাবে'।
দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ১৪টি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এগুলোর ত্রুটি চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক নাজমুল হোসেন বলেন, '২০১৮ সালের পর নির্মিত ৬টি মেডিকেল কলেজে সুযোগ-সুবিধা কম, শিক্ষক সংকটসহ নানা সমস্যা রয়েছে। বিগত সরকার পরিকল্পনাহীনভাবে এগুলো তৈরি করেছে। মেডিকেল কলেজগুলো এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে চললে মানসম্মত চিকিৎসক তৈরি হবে কি না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। চাইলেই মেডিকেল কলেজ বন্ধ করে দেওয়া যায় না। আমরা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছি এবং কীভাবে এ অবস্থার উন্নতি করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে'।
দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষক সংকট শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে, যেখানে ৩৪৩টি পদের মধ্যে ২০৬টি শূন্য। এরপর রয়েছে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, যেখানে ৩৫৪টি পদের মধ্যে ১৭২টি শূন্য। সবচেয়ে কম সংকট মুগদা মেডিকেল কলেজে, যেখানে ১১৭টি পদের মধ্যে ২৩টি শূন্য।