আগাম চাষ ও উষ্ণ শীতকালে রমজানে এবার তরমুজের সরবরাহ বেড়েছে

গ্রীষ্মের ফল তরমুজ বছরের এপ্রিল-মে নগদ বাজারে আসার কথা থাকলেও এবার রমজানকে টার্গেট করে নভেম্বর থেকেই চাষ শুরু করেছিলেন কৃষকরা। আর এ বছর শীত কম পড়ায় ফলনও হয়েছে বেশি। ফলে রমজানের শুরু থেকেই বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে পরিপক্ক তরমুজের।
রাজধানীতে বর্তমানে কেজি হিসেবে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ বেশি থাকায় এবার অন্যবারের তুলনায় দামও কম। মাঝারি ও বড় আকারের তরমুজ প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়।
অন্যান্য বছর এ সময়ে বাজারে অপরিপক্ক তরমুজের আধিক্য দেখা গেলেও এবার পরিপক্ক তরমুজই বাজারে বেশি দেখা যাচ্ছে।
রাজধানীর শাহজাদপুরের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী মো. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "গত বছরের রোজায় প্রতিকেজি তরমুজ ৭০-৮০ টাকায় কিনেছিলাম। এবার ৫০ টাকায় কিনলাম। কোনো কোনো ভ্যানে ৪০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে, আবার কেউ ৬০ টাকাও বিক্রি করছেন। এ দাম মোটামুটি সহনীয়।"
এ সময় তরমুজ বিক্রেতা খাইরুল ইসলাম বলেন, "৪-৫ কেজি ওজনের তরমুজ যাত্রাবাড়ি থেকে কিনে আনছি প্রতি পিস ১৪০ টাকা করে। এখন ৫০ টাকা কেজি বিক্রি করছি। কিছু তরমুজ নষ্ট পড়ে। এ কারণে কেজিতে বিক্রি করতে হয়।"
আবহাওয়া, চাষের ধরণ
কৃষক ও কৃষি গবেষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তরমুজ মূলত গ্রীষ্মের ফল হলেও সারাবছর চাষ করা যায়। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং শীত দুটোই তরমুজের জন্য ক্ষতিকর। সে হিসেবে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি তরমুজ আবাদের সবচেয়ে উপযোগী সময়। তিন থেকে সাড়ে তিন মাসে তরমুজের ফলন ওঠে। ফলে তরমুজের মূল মৌসুম হওয়ার কথা এপ্রিল-মে মাস।
তবে চলতি বছর আবহাওয়া ছিল তরমুজ চাষের উপযোগী। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৭৮ বছর ধরে বছরে অন্তত ২-৩টি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিলেও এবার শীতের মৌসুমে কোনো তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়নি। বলা যায়, এ বছর শীতের মৌসুম ছিল সবচেয়ে উষ্ণতম শীতকাল। ফলে এবার শীতকাল উষ্ণ থাকায় তরমুজের ফলন ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি গবেষকরা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. একেএম কামরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "কৃষকরা রমজানকে টার্গেট করে তরমুজ চাষ করেছেন। এবার বাজারে তরমুজের সরবরাহ বেশি, দামও কম। এর সবচেয় বড় কারণ হলো, আবহাওয়া অনুকূলে ছিল। শীত বেশি থাকলে ফলন কম হয়। এবার শীতের মৌসুমে বেশি শীত পড়েনি। এ কারণে ফলন বেশি হয়েছে।"
"আরও দুই-তিন বছর পর যখন ফেব্রুয়ারির শুরুতে রোজা হবে তখনও দেখা যাবে, বাজারে তরমুজ থাকবে। কিন্তু দাম কমবেশি নির্ভর করবে ফলনের ওপর," বলেন তিনি।
সার্বিক বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "যেকোনো কৃষি পণ্যের উৎপাদন আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। এবার তরমুজের জন্য আবহাওয়া উপযোগী ছিল। এ কারণে মৌসুমের শুরুতে হলেও অধিকাংশ তরমুজ পরিপক্ক।"
"আর রোজার সাথে সাথে তরমুজের মৌসুমও কৃষকরা এগিয়ে নিয়ে আসছেন। সামনে আরও এগিয়ে আসবে," যোগ করেন তিনি।
উৎপাদন ও সরবরাহ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে গত অর্থবছরে ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ উৎপাদন হয়েছে ৩৫.৫১ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯১ হাজার হেক্টর জমিতে ৩৬.০৩ লাখ টন তরমুজ উৎপাদন হয়। চলতি মৌসুমে এখনও পরিসংখ্যান হালনাগাদ হয়নি। যদিও কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার উৎপাদন বেশি হবে।
বর্তমানে রাজধানীর বাজারে আসা তরমুজ বেশিরভাগই বরিশাল অঞ্চলের। মোট উৎপাদিত তরমুজের প্রায় অর্ধেকই আসে এ অঞ্চল থেকে।
চলতি অর্থবছরে বরিশালের ৬ জেলায় তরমুজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভালো ফলনের কথা জানিয়েছেন কৃষকরা।
বরিশালের রূপাতলী বাজারে তরমুজ বিক্রি করতে আসেন পটুয়াখালীর চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের তরমুজ চাষী সোহেল রানা। তিনি বলেন, "মৌসুমের শুরুতে তরমুজ তুলতে পেরেছি দেখে কিছু দাম পাচ্ছি। ঈদের পরে তরমুজের দাম কমে যেতে পারে। তখন সবার ক্ষেতের তরমুজ উঠতে শুরু করবে।"
"ছোট সাইজের তরমুজ প্রতি ১০০টি ১২-১৪ হাজার টাকায় এবং একেবারে বড় সাইজের তরমুজ ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারছি," বলেন এই চাষী।
পাইকারি ও খুচরা দর
পরিবহন খরচ ও পোস্ট হারভেস্ট লসের কারণে তরমুজের দাম ভোক্তা পর্যায়ে বেড়ে যায় বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহ থেকে বরিশাল পোর্ট রোড মোকামে আসা তরমুজের পাইকারী ক্রেতা শেখ ইয়ামিন।
তিনি বলেন, "চার বছর ধরে বরিশাল থেকে তরমুজ কিনে এলাকায় নিয়ে বিক্রি করি। এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় তরমুজের দাম অনেক বেশি। আড়ত থেকে প্রতি পিস তরমুজ কিনছি নূন্যতম ২৫০ টাকায়। এর বেশি দামেও কিনতে হয়।"
তিনি বলেন, "এই দামের সাথে পরিবহন খরচ, শ্রমিক খরচ যুক্ত হবে। পরিবহনের সময়ে অনেক তরমুজ পচে যাবে। সেই খরচও তুলতে হবে দামে। যে কারণে ক্রেতা পর্যায়ে দাম অনেক বেড়ে যায়।"
পোর্ট রোড মা-বাবার দোয়া আড়তের স্বত্ত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, "ফেব্রুয়ারির ১৪/১৫ তারিখ থেকে চাষীরা তরমুজ নিয়ে আসছেন আড়তে। আরও দুইমাস পর্যন্ত মৌসুম থাকবে। আড়তে সবসময় পিস হিসেবে তরমুজ বিক্রি হয়। কেজি হিসেবে বিক্রি করেন খুচরা বিক্রেতারা। বেশি লাভ করার জন্য তারা এমনটা করেন।"
"বর্তমানে বরিশালের পোর্টরোড মোকামে আনুমানিক ৭/১০ কেজি ওজনের ১০০ পিস তরমুজ ২১ হাজার টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। ৪ কেজি থেকে ৬ কেজি ওজনের ১০০ পিস তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ১৪/১৫ হাজার টাকায়," যোগ করেন তিনি।