বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য স্থিতিশীল কর নীতির আহ্বান বিনিয়োগকারীদের

করনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহের বিনিয়োগকারীদেরকে অভিন্ন কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া, অভিন্ন ভ্যাটের হার চালুসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর কাছে বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেছেন ব্যবসায়ী, গবেষক ও বিনিয়োগ প্রচার সংস্থার প্রতিনিধিরা।
গতকাল বুধবার (৫ মার্চ) ঢাকার আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে এনবিআরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় এ প্রস্তাবসমূহ তুলে ধরেন তারা।
সভায় নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিয়ার্স নেটওয়ার্ক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচ্যাম)- এর প্রতিনিধিরা
বেজার ডেপুটি সেক্রেটারি মুহাম্মদ ইমতিয়াজ হাসান বলেন, "ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে বার বার বলেন, করনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আমরা একটি সুবিধা দেব বলে নিয়ে আসলাম, বাংলাদেশে এসে প্রতিষ্ঠান তৈরি করার সময় তারা দেখলো সেই সুবিধা পাচ্ছেন না, তাহলে তো তারা বিনিয়োগে নিরুৎসাহী হবেন।"
তিনি বলেন, "আয়কর, মূল্য সংযোজন কর ও কাস্টমস ডিউটি সংক্রান্ত এসআরও আগে যেটা দেওয়া হয়েছে, সেটার ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেন। যখন তারা দেখছেন, এখন ১০ বছর বা ৮ বছর যাওয়ার পর পরই এসআরও রিভিশন হয়, তখন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।"
"এখানে যেন নীতির ধারাবাহিকতা থাকে, করনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা উচিত। এতে ব্যবসায়ীদের আস্থা বাড়বে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করে বলেন, নীতি স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে এবং বিনিয়োগে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে না।
এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনায় সহায়তা দিতে আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি করনীতি প্রণয়ন করব।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা কর ফাঁকিদাতাদের চিহ্নিত করব, জাতীয় কোষাগারে যথাযথ কর আদায় নিশ্চিত করব, করের আওতা বৃদ্ধি করব এবং এনবিআরের সব কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।"
বেপজার নির্বাহী পরিচালক (ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন) মো. তানভীর হোসেন বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে বিনিয়োগকারীদের জন্য অভিন্ন কর অবকাশ সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করেন।
তিনি বলেন, "বর্তমানে বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থা অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদের জন্য কর অবকাশ সুবিধার ভিন্নতা রয়েছে, যা বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা দেখা দেয়, যা সুষম বিনিয়োগের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।"
"এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের আওতাধীন সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য সমন্বিত কর অবকাশ সুবিধা ও প্রণোদনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, অপ্রচলিত পণ্য উৎপাদনে বিশেষ কর অবকাশ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে বলে প্রস্তাব দেয় বেজা। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে স্থাপিত ওয়্যারহাউসগুলোর জন্য বন্ড সুবিধা পুনর্বহালের লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।
সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য বিল্ড ১০ শতাংশ ফ্ল্যাট ভ্যাট হার প্রস্তাব করেছে। বর্তমানে সার্বজনীন ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি আরও সাতটি হার রয়েছে।
বিল্ড-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম জানান, ভ্যাট আইনের ৪৬(১) ধারা অনুযায়ী ১৫ শতাংশের নিচের হারের ক্ষেত্রে ভ্যাট ক্রেডিট বা রিবেট দেওয়া হয় না, যার ফলে ক্যাসকেডিং প্রভাবের কারণে মূলত ভ্যাটের বোঝা প্রায় ৩০ শতাংশ হয়ে যায়।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ৫৩ শতাংশ ভ্যাট ব্যবস্থার আওতার বাইরে, আর বাকি ৪৭ শতাংশ তিনটি স্তরে বিভিন্ন হারে ভ্যাট পরিশোধ করে, যার ফলে রিবেট ব্যবস্থা কার্যকরভাবে কাজ করছে না।
সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, সরকারও একক ভ্যাট হার সমর্থন করে, তবে নির্দিষ্ট হার নিয়ে আলোচনা চলছে।
তিনি উল্লেখ করেন, এই বাজেটেই বা প্রয়োজনে পরবর্তী বাজেটে একটি অভিন্ন ভ্যাট হার প্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, সভায় কর সংস্কার ও ব্যবসাবান্ধব নীতির ওপর গুরুত্বারোপ করে অ্যামচ্যাম।
অ্যামচ্যাম প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার এবং অ্যামচ্যামের রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি অ্যাডভোকেসি সাবকমিটির সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল।
ফিলিপ মরিস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজা-উর-রহমান মাহমুদ প্রস্তাবনার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
অ্যামচ্যাম এনবিআরের অনাপত্তি সনদের (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি প্রত্যাহার এবং কর ছাড়ের আওতা সম্পর্কে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ার আহ্বান জানায়।
এছড়া, নারীদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিয়ার্স নেটওয়ার্ক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, যা বর্তমানে ৪ লাখ টাকা।
সবার কথা শোনার পর সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, "আমাদের এবারের নীতি হলো, আমরা কর অব্যহতি সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে বের হবো। যারা কম রেটে ট্যাক্স দেয়, তাদের ট্যাক্স রেট বাড়াবো। যারা কর অব্যাহতি পায়, তাদের অব্যাহতি আস্তে আস্তে কমিয়ে দেব।"
"আর অন্য জায়গায় অপারেশন লেভেলে বিশেষ করে অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স, টার্নওভার ট্যাক্স—যেগুলোর কারণে ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো আমরা যুক্তিযুক্ত করবো। এগুলোই আমাদের প্রধান কাজ হবে," যোগ করেন তিনি।