৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়ন প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন, কার্যক্রম শুরু দুই সপ্তাহে
অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় ধুঁকতে থাকা ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) অবসায়ন বা লিকুইডেশন প্রক্রিয়ার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই এসব প্রতিষ্ঠান অবসায়নের প্রাথমিক ধাপের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে অন্তত ৯টি প্রতিষ্ঠানকে এই প্রক্রিয়ার আওতায় আনার পরিকল্পনা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
রোববার (১ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তালিকায় থাকা ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে নড়বড়ে অবস্থায় থাকা ৯টি প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের জন্য প্রাথমিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, আভিভা ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি এবং প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
কার্যক্রম ও প্রক্রিয়া
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক রেজোলিউশন ডিপার্টমেন্টের এক পরিচালক জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাজার বিভাগ চূড়ান্ত করবে কোন কোন প্রতিষ্ঠান অবসায়ন করা হবে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ওই ৯টি প্রতিষ্ঠানকে চিন্তায় রেখেই কাজ এগোচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, 'ব্যাংক রেজোলিউশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫'-এর আওতায় সমস্যাগ্রস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নের বিধান রয়েছে। আইন অনুযায়ী এজন্য পর্ষদের অনুমোদন প্রয়োজন, যা রোববার পাওয়া গেছে। এখন যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, 'প্রাথমিকভাবে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তালিকাটি করা হয়েছে। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডিদের ডাকা হবে। তাদের জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সন্তুষ্ট হলে অবসায়ন নাও হতে পারে। ৯টি প্রতিষ্ঠানই একসঙ্গে অবসায়ন হবে, নাকি সংখ্যা কমবে—তা এখনো চূড়ান্ত নয়।'
আমানতকারীদের অর্থের কী হবে
প্রতিষ্ঠান অবসায়ন হলে আমানতকারীদের জমানো টাকা ফেরতের বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, সরকার এ ক্ষেত্রে তহবিলের জোগান (ফান্ড সাপোর্ট) দেবে। তবে প্রক্রিয়াটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে অবসায়নের অনুমোদনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধে সরকারের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।
৯ প্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ আর্থিক চিত্র
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থতা, উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং মূলধন ঘাটতি—এই তিন সূচকে ৯টি প্রতিষ্ঠানই 'অব্যবহারযোগ্য' অবস্থায় রয়েছে।
এফএএস ফাইন্যান্স: মোট ঋণের ৯৯.৯৩ শতাংশই খেলাপি। পুঞ্জীভূত লোকসান ১ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা।
ফারইস্ট ফাইন্যান্স: ৯৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি, লোকসান ১ হাজার ১৭ কোটি টাকা।
বিআইএফসি: খেলাপি ঋণ ৯৭.৩০ শতাংশ, লোকসান ১ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং: খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা (৯৬ শতাংশ), যার প্রায় পুরোটাই আদায় অযোগ্য। লোকসান ৪ হাজার ২১৯ কোটি টাকা।
পিপলস লিজিং: খেলাপি ঋণ ৯৫ শতাংশ, লোকসান ৪ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা।
আভিভা ফাইন্যান্স: খেলাপি ঋণ ৮৩ শতাংশ, লোকসান ৩ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা।
প্রাইম ফাইন্যান্স: ৭৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি, লোকসান ৩৫১ কোটি টাকা।
প্রিমিয়ার লিজিং: খেলাপি ঋণ ৭৫ শতাংশ, লোকসান ৯৪১ কোটি টাকা।
জিএসপি ফাইন্যান্স: খেলাপি ঋণ ৫৯ শতাংশ, লোকসান ৩৩৯ কোটি টাকা।
আইনি প্রেক্ষাপট ও নোটিশ
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে প্রণীত 'ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন'-এর ৭(১) ধারা অনুযায়ী আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম, দায় পরিশোধে অক্ষমতা এবং মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থতার দায়ে লাইসেন্স বাতিলের সুযোগ রয়েছে। আইনের ৭(২) ধারা মেনে গত ২২ মে এসব প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ে সন্তোষজনক জবাব না পাওয়ায় এখন অবসায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
খাতের সার্বিক পরিস্থিতি
বর্তমানে দেশে ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ২০টিকেই সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকাই খেলাপি (৮৩.১৬ শতাংশ)। বিপরীতে বন্ধকি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা ১৫টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার মাত্র ৭.৩১ শতাংশ। গত বছর তারা ১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে এবং তাদের ৬ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা মূলধন উদ্বৃত্ত রয়েছে।
সমস্যাগ্রস্ত ২০ প্রতিষ্ঠানে আমানত রয়েছে ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রাহকদের নিট ব্যক্তি আমানত প্রায় ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। অবসায়ন ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় প্রাথমিকভাবে এই অর্থের জোগান প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া, অবসায়নের পর কর্মরত কর্মচারীরা চাকরিবিধি অনুযায়ী সব ধরনের সুবিধা পাবেন বলে নিশ্চিত করেছে সংস্থাটি।
