ব্যবসায়ীরা কেন পানগাঁও এড়িয়ে চলেন, ৪০০ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবে যেভাবে তা বদলাতে চায় এমএসসি

২০১৩ সালের শেষ দিকে পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) উদ্বোধনের সময় এটিকে চট্টগ্রাম বন্দরের জট নিরসনের সমাধান হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল। প্রায় ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের প্রথম নদীনির্ভর এ টার্মিনাল বছরে ১ লাখ ১৬ হাজার টুয়েন্টি-ফুট ইকুইভালেন্ট ইউনিটস (টিইইউএস) কনটেইনার হ্যান্ডল করার সক্ষমতা নিয়ে চালু হয়েছিল।
কিন্তু এক দশকের বেশি সময় পর— বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত এই আইসিডি এখন একটি ব্যর্থ প্রকল্পের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি টার্মিনালটির ব্যবহার হচ্ছে সক্ষমতার ২০ শতাংশেরও কম— যা কখনো কখনো মাত্র ৫ শতাংশেও নেমে আসে।
এখন হয়তো আশার আলো আসতে পারে অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কনটেইনার পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেরেনিয়ান শিপিং কোম্পানি (এমএসসি) পানগাঁও আইসিডি আধুনিকায়ন ও পরিচালনার জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের লজিস্টিক অবকাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নিতে এই প্রথম কোনো বৈশ্বিক শিপিং জায়ান্ট আগ্রহ দেখাল।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সরকারের আহ্বানে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সাতটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করেছে। একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, এমএসসি তাতে রয়েছে। প্রস্তাবগুলো এখন পর্যালোচনা করা হচ্ছে।"

চট্টগ্রামের তুলনায় পানগাঁওয়ে বাড়তি খরচ ৮০০–১,০০০ ডলার
অফিসিয়াল তথ্য অনুযায়ী, বিআইডব্লিউটিএ থেকে ৪৮.২৪ একর জমি লিজ নিয়ে নির্মিত পানগাঁও আইসিডি ২০২৩ সালে প্রায় ৩০ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছে—যা এর সক্ষমতার মাত্র এক-চতুর্থাংশ। ২০২৪ সালে মাসিক হ্যান্ডলিং নেমে আসে ৪ হাজার টিইইউএসের নিচে, অর্থাৎ ব্যবহার হয়েছে সক্ষমতার মাত্র ৫ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানগাঁও আইসিডির মাধ্যমে পণ্য খালাস করতে প্রতি টিইইউএসে অতিরিক্ত ৮০০–১,০০০ ডলার খরচ হচ্ছে। এই খরচের মধ্যে রয়েছে, মূল ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি বা মেইনলাইন অপারেটর (এমএলও) যেমন মায়েরস্ক এর ব্যয়, স্থানীয় বার্জ অপারেটরদের পরিবহন খরচ বা হলেজ চার্জ, এবং দুই বন্দরে লোডিং-আনলোডিং ও পোর্ট চার্জ।
পানগাঁও আইসিডির দায়িত্বে থাকা বন্দরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে এই বন্দর দিয়ে আসা প্রায় শতভাগ কনটেইনার খালি যাচ্ছে – কারণ কেউ এই বন্দরের মাধ্যমে আর রপ্তানি করছেন না। ফলে জাহাজ মালিকদের অপারেটিং কস্ট পোষানোর জন্য ভাড়া বাড়াতে হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত সপ্তাহে তিনটি জাহাজ এই বন্দরে আসতো, বর্তমানে মাসে তিনটি জাহাজ আসে।"
গত ৭ সেপ্টেম্বর বর্তমান সরকারের একাধিক উপদেষ্টার উপস্থিতিতে পানগাঁও আইসিডিতে অনুষ্ঠিত এক সভায় কর্মকর্তারা একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন। যাতে বলা হয়, এই বন্দর দিয়ে প্রতি টিইইউএসের জন্য বাড়তি প্রায় ১,০০০ ডলার খরচ হচ্ছে।
রপ্তানিকারকরা কেন পানগাঁও ব্যবহার করছেন না তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, "রপ্তানির ক্ষেত্রে এই বন্দর দিয়ে বিল অব লেডিং বা বিএল সাবমিট করা আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না – নির্ভর করে বায়ার বা তার মনোনীত এজেন্টের উপর। যেহেতু এখান থেকে নির্দিষ্ট শিডিউলে পণ্য যাচ্ছে না, আবার বাড়তি খরচও হচ্ছে – সেজন্য বায়ার এ বন্দরের মাধ্যমে পণ্য অনবোর্ড করার জন্য বিএল দিতে রাজি হয় না।"
ব্যয়বহুল ও পণ্য ছাড়ে বিলম্ব
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন টিবিএসকে বলেন, "পানগাঁওয়ে জাহাজের মাধ্যমে পণ্য আনার চাইতে সড়ক বা রেলপথে আনার খরচ কম হওয়ায় আমদানি ও রপ্তানিকারকরা এই বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন না।
এতে সময়ও বেশি লাগে, যা আরেকটি বড় কারণ। তিনি বলেন, "গাজীপুরের একটি কারখানা থেকে পানগাঁওয়ে পণ্য আনতে ট্রাক ভাড়া করতে হয়, সেখানে চালান পৌঁছানোর পর জাহাজে লোডিং, স্টাফ হ্যান্ডলিংসহ তিন থেকে চার দিন সময় লেগে যায়।"
"অথচ ওই কারখানা রাতে ট্রাকে লোড করলে প্রায় একই খরচে পরদিন চট্টগ্রামের আইসিডিতে পণ্য পৌঁছানোর পর কাস্টমস প্রসিডিউরও সম্পন্ন করতে পারবে" - যোগ করেন তিনি।
কাস্টমস জটিলতাও দেরি বাড়ায়। এক শিপিং এজেন্ট বলেন, কাস্টমস ও সিপিএর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে পানগাঁওয়ে কনটেইনার ছাড়তে কমপক্ষে তিন দিন বেশি সময় লাগে।
কয়েক বছর আগে তার কাঁচামালের একটি চালান পানগাঁও বন্দর দিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার পর তা সময়মত আসেনি, বেশ দেরি করেছে বলে জানান এমবি নিট ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, "এরপর থেকে কোনো কসনাইনমেন্ট এই বন্দর দিয়ে আনিনি।"
অনন্ত গার্মেন্টসের ইনামুল হক খান বাবলুও একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, "পানগাঁওয়ে পণ্য পৌঁছানোর পরও চট্টগ্রাম পৌঁছাতে তিন থেকে চারদিন সময় লেগে যায়। সে তুলনায় সড়কপথে পণ্য পাঠানো রপ্তানিকারকের জন্য এখনও দ্রুত ও সাশ্রয়ী।"
পানগাঁওয়ে ভ্যালু মিস-ডিক্লেয়ার করার সুযোগ আর নেই
পুরান ঢাকার অভিজ্ঞ স্টিল আমদানিকারক আমির হোসেন নুরানি একসময় পানগাঁওয়ের মাধ্যমে সিআর কয়েল শিট ও স্ক্র্যাপ স্টিল আনতেন, কিন্তু দ্বিগুণ খরচ ও কাস্টমস ঝামেলায় এখন তা বন্ধ করেছেন।
"ওসাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এক কনটেইনারের খরচ ১,২০০ ডলার। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে সেটা পানগাঁওয়ে আনতে বাড়তি খরচ ১,০০০ ডলার। এটা কীভাবে যুক্তিযুক্ত?" তিনি টিবিএসকে বলেন।
এছাড়া পানগাঁও থেকে তার পুরান ঢাকার গুদামে ট্রাকে পণ্য আনতে ভাড়া লাগত প্রায় ১৫ হাজার টাকা—যা সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে আনার সমান। "এতে বিনা কারণে ১,০০০ ডলার বা তারও বেশি বাড়তি খরচ হয়।"
নুরানি আরও জানান, আগে আমদানিকারকেরা পণ্যের ভ্যালু মিস-ডিক্লেয়ার করে কিছুটা বাড়তি খরচ পুষিয়ে নিতে পারতেন। "এখন সেই সুযোগ প্রায় নেই। তাহলে কেন কেউ বাড়তি খরচ ও সময় নষ্ট করে এই বন্দর ব্যবহার করবে?"
কনটেইনার হারানোয় সুনামের ক্ষতি
এছাড়া কাস্টমসের হয়রানির উদাহরণ তুলে ধরে নুরানি বলেন, "একবার চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে কনসাইনমেন্ট আনার পথে কিছু কনটেইনার নদীতে পড়ে যায়। এজন্য আমার অন্য সব কন্টেইনার বন্দরে আটকা ছিল এক বছর চার মাস। এই সময়ে আমার যে পোর্ট ডেমারেজ এসেছে, তা ওই পণ্যের দামের চেয়েও বেশি। তা পরিশোধ করতে গিয়ে প্রায় ফকির হয়ে গিয়েছি।"
বাদশা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদশা মিয়া বলেন, এই বন্দর চালু হওয়ার পর শুরুর দিকে তুলা আমদানির উদ্যোগ নিই। কিন্তু আসার পথে একটি কনটেইনার নদীতে পড়ে গেলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমার বাকী সব কনটেইনার আটকে রাখে দীর্ঘসময়।
"সেই চালান ছাড়াতে বিপুল পরিশ্রম করতে হয়েছে। তুলার ঘাটতিতে আমার কারখানা অচল ছিল, বন্দরের ডেমারেজ খরচও ক্রমেই বাড়ছিল। এরপর আমি পানগাঁও আর ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেই" - তিনি যোগ করেন।
দোষারোপ আর সিন্ডিকেট
পানগাঁও আইসিডির মালিক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সিপিএ প্রায়ই এই টার্মিনালের দুর্বল পারফরম্যান্সের জন্য কাস্টমসকে দোষারোপ করে। অন্যদিকে কাস্টমস কর্মকর্তারা আবার কাঠামোগত অসুবিধাকে দায়ী করেন।
কাস্টমসের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, "বহির্নোঙ্গর থেকে পানগাঁওয়ের দূরত্ব ২৮৩ কিলোমিটার, যেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ১১ কিলোমিটার। এত দূরত্ব ও সেকারণে উচ্চ খরচ স্বাভাবিকভাবেই (কাস্টমসের) কার্যক্রম ধীর করে দেয়।"
এর বাইরে, চট্টগ্রাম ও পানগাঁও উভয় বন্দরেই আলাদা কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ নেওয়া হয়, যার মধ্যে লোডিং ও আনলোডিং ফি-ও রয়েছে। শিল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কেরানীগঞ্জকেন্দ্রিক একটি পরিবহন সিন্ডিকেটও ট্রাক ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে, যা সামগ্রিক খরচ আরও বাড়াচ্ছে।
এমএসসির প্রস্তাব—৪০০ মিলিয়ন ডলারের লাইফলাইন
এমন প্রেক্ষাপটে এমএসসি এক সাহসী প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে: সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে পানগাঁও আইসিডির আধুনিকায়ন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের দেখা নথিপত্র অনুযায়ী, এমএসসি কনটেইনার ইয়ার্ড সম্প্রসারণ, হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন, পূর্ণ অটোমেশন ও ডিজিটাল ট্র্যাকিং চালু, এবং নৌপথ ড্রেজিং ও রক্ষণাবেক্ষণের পরিকল্পনা করেছে।
এমএসসি ২৫টি ডেডিকেটেড বার্জ চালু করবে, যা ঢাকা, চট্টগ্রাম, মোংলা, কলম্বো ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে ফিডার সার্ভিস পরিচালনা করবে। পাশাপাশি একটি বিশেষ তুলার গুদাম নির্মাণ করা হবে, যা টেক্সটাইল খাতের খরচ কমাবে।
এমএসসির স্থানীয় এজেন্ট এবং সিকম শিপিংয়ের চেয়ারম্যান আমিরুল হক বলেন, "এটি কোনো পরীক্ষামূলক প্রস্তাব নয়, সিরিয়াস অফার। এমএসসি পানগাঁওকে তাদের গ্লোবাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়।"
সিপিএ'র সদস্য (প্রকৌশল) কমোডর কাওসার রশিদও এমএসসির ৪০০ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, "অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিক সরঞ্জাম সংযোজনের পাশাপাশি এ শিপিং জায়ান্ট ২৫টি জাহাজের বহর নিয়ে আসবে, যা চট্টগ্রাম ও মোংলা থেকে পিআইসিটিতে কনটেইনার পরিবহন করবে।"
চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক এক কর্মশালায় নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, "আমরা এমএসসির সঙ্গে আলোচনার শেষ পর্যায়ে আছি। নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন হবে বলে আশা করি।"
তিনি আরও বলেন, "টার্মিনালের পাশাপাশি একটি কটন ওয়ারহাউজ তৈরি হবে, যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা তুলা সংরক্ষণ করা হবে। এই গুদাম দেশের টেক্সটাইল শিল্পে গতি আনবে।"
এনিয়ে রপ্তানিকারকেরাও আশাবাদী। "এমএসসি বাস্তবায়ন করলে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর চাপ কমতে পারে," বলেন পোশাক খাতের এক ব্যবসায়ী নেতা।
তবে সমালোচকেরা সতর্ক করছেন ঝুঁকি নিয়েও। "রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালের মতো বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে বিরোধ দেখিয়েছে, পানগাঁও এমএসসির হাতে গেলে ট্যারিফ ও খরচ বেড়ে যেতে পারে," সতর্ক করে বলেন সিপিএ'র এক সাবেক কর্মকর্তা।