পোশাক খাতের সবুজ রূপান্তরের প্রচেষ্টা হোঁচট খাচ্ছে সোলার আমদানি শুল্কের ভারে

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ছাদে সৌরবিদ্যুৎ সম্প্রসারণে আগ্রহী হলেও উদ্যোক্তারা বলছেন, যন্ত্রাংশ আমদানিতে অস্বাভাবিক শুল্ককরের কারণে স্থাপনের খরচ বেড়ে যাচ্ছে, এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বৃহৎ পরিসরে সৌর প্রযুক্তি ব্যবহারের পথ। অথচ এ উদ্যোগ সফল হলে প্রতিবছর প্রাথমিক জ্বালানি আমদানিতে সরকারের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতো।
দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিখাত কার্বন নির্গমন কমানোর জোর চেষ্টা চালাচ্ছে—বৈশ্বিক কমপ্ল্যায়েন্স পূরণে। সরকারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ বর্তমানের প্রায় ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার।
কিন্তু উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রাংশ আমদানিতে উচ্চ শুল্কের কারণে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারতের তুলনায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি খরচ হচ্ছে বাংলাদেশে।
শিল্পখাতে ব্যবহৃত সোলার প্যানেল—অর্থাৎ ফোটোভোল্টায়িক জেনারেটর সেট স্থাপনে ১৩ ধরনের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে প্যানেল ও ইনভার্টারে মাত্র ১ শতাংশ শুল্ক থাকলেও— বাকি প্রায় অর্ধেক যন্ত্রাংশে ৬২ থেকে ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসানো হয়েছে। স্থাপন খরচের সম্পূর্ণ ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক এগুলোর পেছনেই করতে হয়।
সংশ্লিষ্ট শিল্পের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এসব শুল্কের কারণে সৌরপ্রকল্প স্থাপনের মোট ব্যয় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য স্বল্পসুদে গ্রিন ফান্ড চালু করলেও বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, সেখানে প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব রয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে সরকার জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বেসরকারিখাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের হ্রাসকৃত আমদানি শুল্কের মতো বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছে। গত বছরে দেওয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একটি সার্কুলার অনুযায়ী, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা ৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড়া প্রায় সব আমদানিশুল্ক থেকে অব্যাহতি পায়। অথচ সৌর খাতকে নীতিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বারবার বলা হলেও এমন সুবিধা দেওয়া হয়নি বলে উদ্যোক্তাদের অভিযোগ।
তাদের মতে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং পরিবেশবান্ধব এই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হলে— সোলার ইক্যুইপমেন্টে আমদানিশুল্ক বাতিল করতে হবে, দিতে হবে প্রণোদনা।

কেন দেশে সোলার প্যানেলের খরচ এত বেশি
দেশের অন্যতম বৃহৎ বস্ত্রকল এনজেড টেক্সটাইল লিমিটেড ইতোমধ্যে প্রায় ১০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা স্থাপন করেছে, যা এ খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য সৌর বিদ্যুতের সক্ষমতা বাড়িয়ে ৩০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউধ জামান খান বলেন, "আমদানি করা সোলার ইক্যুইপমেন্টের ওপর ট্যাক্স আমাদের খরচ ৩০ শতাংশের বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে ভারতে এ ধরনের একটি প্রকল্পে খরচ হয় ২ কোটি টাকা, বাংলাদেশে একই প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়ায় ৩ কোটি টাকা। এ কারণেই আমরা কস্ট কম্পিটিটিভনেসে পিছিয়ে আছি।"
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ফ্যাশনস লিমিটেড—যেটি ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের সনদপ্রাপ্ত প্লাটিনাম-রেটেড পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা—আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নেট-জিরো কার্বন লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা নিয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানটির সব বিদ্যুৎ চাহিদা নিজস্ব সৌর বিদ্যুৎ থেকেই মেটানো হবে। কারখানাটি ইতোমধ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে। বর্তমানে সোলার ইনস্টলেশনের কিছু অংশ চালু থাকলেও আরও সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ চলছে।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফাজলে শামীম এহসান বলেন, "বেসরকারি খাতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছি। তাই সরকারেরও উচিত সোলারের যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি দেওয়া।"
দেশের শীর্ষস্থানীয় টেক্সটাইল ও পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম রাইজিং গ্রুপ বর্তমানে সৌর শক্তি থেকে প্রায় ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিকল্পনা আছে, এই সক্ষমতা আরও ১০ মেগাওয়াট বাড়ানোর।
তবে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু টিবিএস-কে বলেন, "সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সরঞ্জামের ওপর অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক আমাদের জন্য একটা বড় বাধা।"
শিল্পোদ্যোক্তারা আরও বলছেন, বাংলাদেশে একই সক্ষমতার সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে খরচ হয় প্রতিবেশী ভারতের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি, যার প্রধান কারণ উচ্চ আমদানি শুল্ক।
অন্যদিকে, টেক্সটাইল শিল্পের মধ্যে স্পিনিং মিলগুলো সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, যার বড় অংশ আসে গ্যাস ও আমদানি করা জ্বালানিভিত্তিক ক্যাপটিভ পাওয়ার সিস্টেম থেকে। এতে সরকারকেও জ্বালানি সরবরাহের বাড়তি চাপ নিতে হয়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫২৭টি স্পিনিং মিলের মধ্যে প্রায় ৪০টি ইতোমধ্যে সোলার প্যানেল স্থাপন করেছে, যেখান থেকে সম্মিলিতভাবে প্রায় ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য।
অনেক পোশাক কারখানাও সোলার প্যানেল স্থাপন করেছে। তবে ঠিক কতগুলো কারখানা এ উদ্যোগ নিয়েছে এবং এর মাধ্যমে মোট কত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে—তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্টশিল্পের প্রধান দুটি সংগঠন থেকে।
অপব্যবহারের আশঙ্কায় শুল্ক কমায়নি এনবিআর
২০২৩ সালে এক আমদানিকারকের আবেদনের প্রেক্ষিতে এনবিআরের কাস্টমস পলিসি উইং একটি ব্যাখ্যা বা অ্যাডভান্স রুলিং জারি করে জানায়, কেন 'ফোটোভোলটাইক জেনারেটর সেটস'-এর আওতাধীন ১১ ধরনের যন্ত্রাংশে ১ শতাংশ আমদানি শুল্কের সুবিধা প্রযোজ্য নয়।
ব্যাখ্যায় বলা হয়, এসব যন্ত্রাংশের কিছু 'সাধারণ ব্যবহারের অংশ' হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ এবং সেগুলোকে নির্দিষ্ট কোনো ধরনের যন্ত্রের জন্য এককভাবে বা মূলত ব্যবহৃত অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। এ কারণে এগুলো কম শুল্ক সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব নয়।
সেসময় এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একজন শুল্ক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে টিবিএসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয় , "এই সুবিধা অপব্যবহারের ঝুঁকি এবং একই ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরি করা দেশীয় উৎপাদকদের স্বার্থ বিবেচনায়, এই ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়।" নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি এ মন্তব্য করেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান টিবিএস-কে বলেন, "আমরা অলরেডি কিছু সোলার ইক্যুইপমেন্টে শুল্কছাড় দিয়েছি, এর মধ্যে কিছু গত বাজেটেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে এসব আইটেমের অনেকগুলো শুধু সৌরবিদ্যুৎ খাতেই নয়, অন্য খাতেও ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশীয় (সোলার) শিল্পকেও রক্ষা করা জরুরি। নাহলে একই ধরনের পণ্য উৎপাদনকারী স্থানীয় উদ্যোক্তারা বলবেন, তাদের স্বার্থ উপেক্ষা করা হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "উদ্যোক্তাদের যদি যৌক্তিক দাবি থাকে, তবে পরিবর্তন শুধুমাত্র আগামী বাজেটে আনা সম্ভব।"
এদিকে স্থানীয় সোলার সরঞ্জাম প্রস্তুতকারকেরা অভিযোগ করেছেন, আমদানি শুল্ক সুবিধার অপব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশ সোলার মডিউল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এসএমএমএবি) এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএস-কে বলেন, "শিল্পগুলোকে কর সুবিধা দেওয়া হলে তা অপব্যবহৃত হচ্ছে।"
তিনি আরও জানান, দেশীয় শিল্পের স্বার্থে সরকার চাইলে নীতি নির্ধারণ করতে পারে—- যাতে শিল্পখাতের সৌর প্রকল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির একটি নির্দিষ্ট অংশ স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক হয়।
তবে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম বাকী মাসুদ টিবিএস-কে বলেন, "শিল্প কারখানাগুলো যখন ছাদে সৌর প্যানেল বসাচ্ছে, তখন সরকার চাইলে নির্দিষ্ট কিছু আইটেমে ছাড় দিতে পারে, সেটাও কেবল নির্দিষ্ট অর্ডারের ভিত্তিতে।"
কিন্তু এনজেড টেক্সটাইলের এমডি সালেউধ জামান খান বলেন, "যেসব যন্ত্রাংশে উচ্চ আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, তার অধিকাংশই এখনো দেশে উৎপাদন হয় না। যদিও কিছু যন্ত্রাংশ স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়, কিন্তু এগুলোর মান শিল্পের আন্তর্জাতিক মান পূরণ করে না।" তার মতে, এগুলো আমদানি ছাড়া বিকল্প নেই।
অপব্যবহারের প্রসঙ্গে তিনি প্রস্তাব দেন, "যাতে শিল্পখাতের বাইরের কেউ সুবিধা নিতে না পারে, সে জন্য বুয়েটের বিশেষজ্ঞ প্যানেল সার্টিফিকেশন বা অন্য কোনো যাচাইয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। তবে মাথা কেটে মাথাব্যথার সমাধান খোঁজা কোনো সমাধান হতে পারে না।"
পোশাকখাতে ২,০০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যেখানে দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৫০ শতাংশই যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইইউ পণ্য উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইইউ করপোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেকটিভ (সিএসডিডিডি), কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম (সিবিএএম) – যা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উচ্চ কার্বননির্ভর পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করবে, আরও রয়েছে জার্মান সাপ্লাই চেইন ডিউ ডিলিজেন্স অ্যাক্ট।
কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজমের আওতায় ইইউ তাদের নিজস্ব বায়ারদের ওপর অতিরিক্ত কর বসাবে—সরবরাহ শৃঙ্খলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর নির্দিষ্ট মাত্রার কার্বন নিঃসরণের ওপর ভিত্তি করে। এর অর্থ হলো, বাংলাদেশি রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে এসে উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে হবে। অন্যথায়, রপ্তানিকারকরা বাজার হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন।
সালেউধ জামান–যিনি বিটিএমএ-রও ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, দেশের টেক্সটাইল ও পোশাকখাতের কারখানাগুলোর ছাদের জায়গা ব্যবহার করে সর্বমোট ২,০০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। যা খাতদুটির মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ মেটাতে পারবে।
তার হিসাবে, ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা বছরে প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, এবং জ্বালানি (ফুয়েল ও গ্যাসভিত্তিক) খরচও একই পরিমাণ হ্রাস করবে। পাশাপাশি সরকারের জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাবে, বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়েও অবদান রাখবে।
তিনি আরও বলেন, যদি সরকার সৌরবিদ্যুতের সরঞ্জামে আমদানি শুল্ক মওকুফ করে, তাহলে তা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি ও সরকার— উভয়ের জন্যই লাভজনক হবে।