শুল্কছাড় পেতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক বছরে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের গম, ডাল ও এলএনজি আমদানি করবে সরকার

যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পালটা শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) কমাতে চূড়ান্ত আলোচনার আগে দুদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে দেশটি থেকে আগামী এক বছরের মধ্যে ১.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের গম, ডাল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ওপর ওয়াশিংটনের প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কমানোর জন্য ঢাকার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ শুল্কহার ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।
এর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও ১.৫ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বাড়াতে তুলা, গম, সয়াবিন ও ডাল আমদানিকারকদের একটি প্রতিনিধিদলও যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।
সোমবার (২৮ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার আগে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাংলাদেশ নতুন করে যে পরিমাণ আমদানির পরিকল্পনা করছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি ৩ বিলিয়ন ডলার বাড়বে।
'আমরা আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে ১.৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। বাকিটা বেসরকারি খাত আমদানি করবে,' বলেন তিনি।

বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি হিসেবে আজ মঙ্গলবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল। দেশের টেক্সটাইল মিলগুলো তুলা আমদানি করে সুতা ও ফেব্রিক উৎপাদন করে থাকে।
এছাড়া টিকে গ্রুপ, মেঘনা ও সিটি গ্রুপ থেকেও প্রতিনিধি যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। মেঘনা, সিটি ও টিকে গ্রুপ বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সয়াবিন, গম ও ডাল আমদানি করে।
বাংলাদেশের ওপর আরোপিত শুল্ক কমাতে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিদল আজ ও আগামীকাল যখন ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে দরকষাকষি করবে, তখন বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদল মার্কিন রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করতে বৈঠক করবে বলে টিবিএসকে জানান বাণিজ্য।
ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিদলটি নিজ উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
সরকারি প্রতিনিধিদলে বাণিজ্য সচিব ছাড়াও রয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
বাণিজ্য সচিব ভিয়েতনামের উদাহরণ টেনে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১২৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও দেশটি আলোচনার মাধ্যমে শুল্কহার কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে।
'বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার। আগামী এক-দেড় বছরে এটা আরও কমে যাবে। তাই আমরা আশা করছি, আমাদের ট্যারিফ রেট ভিয়েতনামের চেয়েও কম হবে,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭.৯ বিলিয়ন ডলারের তুলা আমদানি করেছে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির পরিমাণ ৩৬১ মিলিয়ন ডলার। ওই অর্থবছরে ১.৭৬ বিলিয়ন ডলারের গম আমদানি হয়েছে, যার মধ্যে ৪৩.৪ মিলিয়ন ডলার আমদানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সয়াবিন আমদানি হয়েছে ৯২৩ মিলিয়ন ডলারের, যার প্রায় ৩৬.৮ শতাংশ (৩৩৯ মিলিয়ন ডলার) এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
সরকার ইতিমধ্যে জি-টু-জি ভিত্তিতে বছরে ৭ লাখ টন গম কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করেছে এবং ২.২০ লাখ টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এর বাইরে সরকারিভাবে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার পরিকল্পনা করছে সরকার।
সহায়তা চায় বেসরকারি খাত
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে যে পরিমাণ তুলা আমদানি করে, তা চার-পাঁচগুণ বাড়িয়ে ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব। এতে বাণিজ্য ঘাটতি অনেক কমিয়ে আনা যাবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে বর্তমানে বড় বাধা অপেক্ষাকৃত বাড়তি দাম এবং দূরত্বের কারণে বর্ধিত সময়, বলেন তিনি। 'প্রতি পাউন্ড তুলা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করতে বাড়তি ০.০৩ থেকে ০.০৪ ডলার খরচ হবে।'
রাসেল এই বাড়তি খরচ পুষিয়ে নিতে সরকারি সহায়তা চেয়েছেন। তার পরামর্শ হলো, বেশি দামে তুলা আমদানি করে একটি কেন্দ্রীয় বন্ডেড ওয়্যারহাউসে সংরক্ষণ করা এবং সেখান থেকে ব্যবসায়ীদের কাছে নিয়মিত দামে বিক্রি করা।
এছাড়া প্রত্যেক ব্যবসায়ীর জন্য রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সর্বোচ্চ সীমা ২০ মিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৩০ মিলিয়ন ডলার করা এবং সুদের হার কমিয়ে ১ শতাংশ করা হলে তা আমদানি বাড়াতে উৎসাহ দিতে পারে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারকেও কিছু প্রস্তাব দেওয়া হবে জানিয়ে রাসেল বলেন, মার্কিন তুলা ব্যবহার করে পোশাকপণ্য তৈরি করে সেদেশে রপ্তানি করলে ওই পণ্যের ওপর আগের রেটে (১৫ শতাংশ) ট্যারিফ রাখার বিষয়টি তারা তুলবেন।
বাংলাদেশ এডিবল অয়েল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং টিকে গ্রুপের পরিচালক মুহাম্মদ মোস্তফা হায়দার বলেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা তাকে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন।
'আমার এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না থাকায় যেতে পারছি না। তবে আমাদের টিকে গ্রুপ থেকে প্রতিনিধি যাচ্ছেন,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সরকার তাদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন ও গম আমদানি বাড়াতে অনুরোধ করেছে।
বাংলাদেশ বাজ্রিল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানি করে উল্লেখ করে মোস্তফা হায়দার বলেন, 'দুই দেশে সয়াবিনের মৌসুম ভিন্ন। যখন ব্রাজিলে সয়াবিন পাওয়া যায় না, তখন আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করি। যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, দামও বেশি।'
তিনি আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি করতে প্রতি টনে ২০-৩০ ডলার বেশি খরচ হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গমের মানও অনেক ভালো। দেশের রপ্তানি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য সরকারের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম ও সয়াবিন আমদানি বাড়াব। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিতে বাড়তি খরচের কারণে ব্যবসায় সমস্যা হলে তখন সরকারের কাছে সহযোগিতা চাইব।'
মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজার তাসলিম শাহরিয়ার টিবিএসকে বলেন, তাদের কোম্পানির চেয়ারম্যান বা ঊধর্বতন কোন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। 'দেশের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।'
বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী শফি মাহমুদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডাল আমদানি বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে তাদের অনুরোধ করা হয়েছে।
'তবে আমরা মন্ত্রণালয়কে বলেছি যে, আমরা একসঙ্গে ৪০০-৫০০ টনের বেশি ডাল আমদানি করি না এবং কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের ডাল আমদানি করি। যুক্তরাষ্ট্রের ডালের দাম বেশি,' বলেন তিনি।
হাজী শফি আরও বলেন, এখন ডালের বাজার মেঘনা, সিটি, টিকে ও বসুন্ধরা গ্রুপের দখলে চলে গেছে। 'তারা একসঙ্গে ৩০ হাজার টন ডাল আমদানি করে। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আমরা বলেছি এসব কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করতে।'