অনলাইন বিক্রির কমিশনে বাড়তি ভ্যাট এসএমই খাতকে চাপে ফেলবে, বলছেন স্টেকহোল্ডাররা

দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) দীর্ঘদিন ধরে যে সংকটে আছে, তার মধ্যে অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ের কমিশনের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এ খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্টেকহোল্ডাররা বলছেন, এই পদক্ষেপের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এসএমই খাতে। কারণ দেশের এসএমই উদ্যোক্তাদের বড় অংশই ই-কমার্সের মাধ্যমে তাদের পণ্য বিক্রি করেন।
প্রবেশের বাধা কম ও বাজার বড় হওয়ায় বাংলাদেশের অধিকাংশ এসএমই উদ্যোক্তা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্য বিক্রি করেন। তবে বাড়ার কারণে এসএমই উদ্যোক্তারা আশঙ্কা করছেন, অনলাইন বিক্রিতে ধস নামবে, তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে এবং পণ্যের মূল্য বাড়বে। ফলে অনেক এসএমই ব্যবসা আরও গভীর সংকটে পড়বে।
সরকারের কাছে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তারা বলেন, এ পদক্ষেপ ক্ষুদ্র উদ্যেক্তাবান্ধব হয়নি। অতিরিক্ত ভ্যাটে পণ্যের দাম বাড়াতে হবে, যা ভোক্তাদের প্রভাবিত করবে।
ভ্যাট আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়াসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায় সহায়তার জন্য বাজেট থেকে সরাসরি অর্থ বরাদ্দও দাবি করেছে এসএমই ফাউন্ডেশন ।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে শাবাব লেদারের স্বত্বাধিকারী মাকসুদা খাতুন বলেন, 'এই ভ্যাট বৃদ্ধি ছোট উদ্যেক্তাবান্ধব হয়নি। আমাদের দেশে যখন একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তখন প্রায়ই কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যেক্তাদের (সিএমএসএমই) কথা চিন্তা করে নেওয়া হয় না।'
তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, প্রযুক্তি ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা ও পর্যাপ্ত অর্থের অভাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে এসব উদ্যোক্তাদের।
'আমাদের মতো ক্ষুদ্র উদ্যেক্তাদের জন্য অনলাইনে পণ্য বিক্রি এমনিতেই অনেক চ্যালেঞ্জিং। নতুন উদ্যেক্তাদের শুরুতে একটি শোরুম নিয়ে পণ্য বিক্রি করতে গেলে অনেক মূলধন প্রয়োজন হয়, সেটা তাদের থাকে না। তাই সিএমএসএমইর জন্য অনলাইনে পণ্য বিক্রি সহজ করা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি এটা সহজ করার পরিবর্তে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং করা হচ্ছে আমাদের জন্য,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অর্থনৈতিক ইউনিট বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছে।
মোট ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি অর্থনৈতিক ইউনিটের মধ্যে প্রায় ৭৫ লাখ ৪৮ হাজার ১৪৭টি ইউনিট তাদের সমস্যার কথা জানিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা মূলধনের অভাবের সমস্যার কথা বলেছেন। এর পরেই ছিল ঋণের সহজলভ্যতা (৩৪.৪১ শতাংশ), অবকাঠামোগত সমস্যা (১৯ শতাংশ) ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির (৯.৭৭ শতাংশ) সমস্যা।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'বেশিরভাগ এসএমই উদ্যক্তা পণ্য উৎপাদন খরচ, পণ্য বাজারজাতকরণে এখনও ওইভাবে সক্ষমতা অর্জন করেননি। তাই এ ভ্যাট বৃ্দ্ধি হলে এসএমই উদ্যেক্তাদের ওপর প্রভাব বেশি পড়বে। তাই তাদের ওপর ভ্যাটের হার যত কম রাখা হবে, ততই ভালো হয়। ই-কমার্স এসএমই উদ্যেক্তাদের পণ্য বিক্রির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম । তারা সহজেই এর মাধ্যমে পণ্য বিক্রি ও প্রচারণা চালাতে পারে। তাই আমাদের প্রস্তাব থাকবে এখানে ভ্যাটের হার যেন আগের মতোই থাকে ।'
ই-ক্যাবের প্রশাসক মো. সাইয়েদ আলী বলেন, 'বাড়তি ভ্যাটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। ই-ক্যাবের সদস্যভুক্ত হাজারো উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা নিজেরা পুঁজি জোগাড় করে ধীরে ধীরে ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। তাদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ না দিলে তারা ব্যবসা বাড়াতে পারবেন না। ফলে সরকারও প্রত্যাশিত রাজস্ব পাবে না। বরং যদি বিক্রির সুযোগ তৈরি করা হয়, তাহলে বিক্রি বাড়বে, আর বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে রাজস্বও বাড়বে। তাই আমরা মনে করি, কমিশনের ওপর ভ্যাট জিরো পারসেন্ট করা হোক।'
তিনি আরও বলেন, ই-ক্যাব খুব শিগগিরই শূন্য ভ্যাটের যৌক্তিকতা ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণসহ প্রস্তাব তুলে ধরবে—যাতে প্রমাণ করা যায়, ভ্যাট শূন্য শতাংশ করলে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব বাড়বে এবং উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধির পথ তৈরি হবে।
সরাসরি বাজেট বরাদ্দ চায় এসএমই ফাউন্ডেশন
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় আগ্রহী করতে ১২৫ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ প্রতিষ্ঠা, নারী উদ্যোক্তাসহ প্রান্তিক পর্যায়ের সিএমএসএমই খাতের ১০ হাজার উদ্যোক্তাকে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ, ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে ৩ হাজার নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে কর্পোরেট ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সংযোগ স্থাপন ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বাজেট থেকে সরাসরি বরাদ্দের দাবি জানিয়ে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, 'আমরা নারী উদ্যেক্তাদের নিয়ে সরাসরি কাজ করি। তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা আমরা বুঝি।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটে বরাদ্দ থাকলেও ক্ষুদ্র উদ্যেক্তারা নানা জটিলতায় এ অর্থ পান না। 'তারা যাতে অর্থ সহজে পেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে,' বলেন তিনি।
ঢাকা চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, আইএমএফ-এর শর্তানুযায়ী সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন করছাড় প্রত্যাহার করা হলেও সিএমএসএমইর জন্য কোনো রোডম্যাপ নেই। 'একটি একটি নেতিবাচক প্রভাব রাখবে,' বলেন তিনি।