বাংলাদেশ আমাদের বিনিয়োগের জন্য প্রথম পছন্দ হতে পারে: চীনা ব্যবসায়ী নেতারা

ঢাকায় গতকাল (১ মে) অনুষ্ঠিত চীন-বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্মেলনে অংশ নেওয়া চীনা ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ উল্লেখ করে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ তাদের বিনিয়োগের জন্য শীর্ষ পছন্দ হতে পারে।
বাংলাদেশে চীনা টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শাখার শিল্প উদ্যোক্তাদের সংগঠন চাইনিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি গে জেনইউ (মাইক) বলেন, চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশ হতে পারে প্রথম পছন্দ।
১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশে বসবাসরত এবং একটি মাঝারি আকারের টেক্সটাইল কোম্পানির মালিক এই চীনা ব্যবসায়ী বলেন, 'বাংলাদেশে নীতিগত স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে — এগুলো বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
তিনি আরও বলেন, '২০১৯ সালে বাংলাদেশ আমাকে স্থায়ী বাসিন্দার মর্যাদা দিয়েছে। বন্ধুরা যখন বিনিয়োগ নিয়ে জানতে চায়, আমি সবার আগে বাংলাদেশকেই সুপারিশ করি।'
বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ আরও বাড়াতে দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা জানিয়েছেন চায়না চেম্বার অব কমার্স ফর ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের ভাইস চেয়ারম্যান ঝাং শিয়ান।
সম্মেলনে অংশ নিয়ে চীনা বিনিয়োগকারীরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি, উন্নত বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্প, উৎপাদনশিল্প, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি খাতে বিনিয়োগে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) যৌথভাবে রাজধানী ঢাকায় বিডার প্রধান কার্যালয়ে এ সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও।
সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানান, এতে ১৪৩টি চীনা কোম্পানির প্রায় ২৫০ জন বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধি অংশ নেন। এছাড়া বহু বাংলাদেশি ব্যবসায়ীও উপস্থিত ছিলেন। সব মিলিয়ে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৫০ জন।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, 'আমরা আগামী ৬, ১২ ও ২৪ মাসের মধ্যে বাংলাদেশে প্রকৃত বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছি। একটি নির্দিষ্ট দেশকে ঘিরে এত বড় সম্মেলন খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু আমরা এটি চীনকে কেন্দ্র করে আয়োজন করেছি, কারণ আগামী পাঁচ থেকে ১০ বছরে সেখান থেকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।'
সম্মেলনের টেকনিক্যাল সেশনে আলোচনার বিষয় ছিল—বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে যৌথ উদ্যোগ, ইলেকট্রনিক্স ও যন্ত্রপাতিতে চীনের প্রযুক্তি হস্তান্তর, কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে সম্ভাবনা ইত্যাদি।
বেজা ও পাওয়ারচায়না-র মধ্যে সমঝোতা চুক্তি
মতলব উত্তর উপজেলায় চীনা অ্যাগ্রিভোল্টাইক ইকোনমিক জোন স্থাপনে বেজা (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ) ও পাওয়ারচায়না ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ লিমিটেডের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে।
চৌধুরী আশিক জানান, প্রকল্পটির জন্য প্রায় ৩ হাজার একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ১ হাজার একরে পরীক্ষামূলকভাবে কৃষিকাজের পাশাপাশি সোলার প্যানেল বসানো হবে।
তিনি বলেন, 'অ্যাগ্রিভোল্টাইক' বলতে বোঝায় এমন কৃষিকাজ, যেখানে সূর্যালোক-সহনশীল ফসলগুলো সোলার প্যানেলের ছায়ায় চাষ করা হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৩০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলেও তিনি জানান।
অনুষ্ঠানে বিডার স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট বিভাগের মহাপরিচালক আরিফুল হক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মোহাম্মদ আল আমিন প্রামাণিক বিনিয়োগ প্রণোদনা, কর সুবিধা ও কাস্টমস-সুবিধা নিয়ে বিস্তারিত উপস্থাপনা দেন।
এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী মাহবুব উর রহমান এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ফারিয়া কবির বাংলাদেশের বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের প্রশংসা করেন এবং চীনা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক এক সেশনে মিরসরাইয়ে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক বিনিয়োগ নীতিমালা, শর্তাবলি এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা তুলে ধরেন।
চায়না ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স ফর দ্য প্রাইভেট সেক্টরের (সিআইসিসিপিএস) ভাইস প্রেসিডেন্ট ছি ছিয়ান অতীতে কিছু বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া স্বীকার করে বলেন, 'এইবার আমরা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে আশাবাদী।'
তিনি বলেন, 'আমি শ্রীলঙ্কায় একটি প্রকল্প শেষ করেছি। বাংলাদেশে ২০টির বেশি প্রকল্প শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।' সবুজ শিল্পখাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি, শ্রমবাজারের উন্নয়ন এবং নিবেদিত কর্মীবাহিনীর প্রশংসা করেন তিনি।
এছাড়া, লিথিয়াম ব্যাটারি ও ইভি ব্যাটারি-স্ব্যাপিং প্রযুক্তি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টাইগার নিউ এনার্জির সিইও নিকোল মাও বলেন, তার প্রতিষ্ঠান গত তিন বছর ধরে বাংলাদেশে কাজ করছে। দক্ষ শ্রমশক্তি ও কর-সুবিধা পাওয়ায় তারা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে বলেও জানান তিনি।
প্রধান অংশগ্রহণকারী
সম্মেলনে অংশ নেয় চীনের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে ছিল টেক্সটাইল খাতের বড় দুই প্রতিষ্ঠান হংদো গ্রুপ ও শানডং ওয়েইচিয়াও পাইওনিয়ারিং গ্রুপ, তরল পরিবাহী পণ্যে বিশেষজ্ঞ মেইডে গ্রুপ, সৌর ফোটোভোলটাইক সিলিকন ওয়েফার উৎপাদনকারী হুয়ানতাই এনার্জি, অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে কাজ করা পাওয়ারচায়না ও চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধাতব নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মেটালার্জিক্যাল করপোরেশন অব চায়না এবং কৃষি খাতের প্রতিষ্ঠান সিচুয়ান জিনহে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও লাইউ মানহিং ভেজিটেবলস ফ্রুটস।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চৌধুরী আশিক এ সফরকে 'একটি মাইলফলক' হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, 'একক কোনো দেশ থেকে এত বড় প্রতিনিধি দল এর আগে কখনও বাংলাদেশে আসেনি। এতে বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা দেখছি আমরা।'