আজ থেকে এনবিআর কর্মকর্তাদের অসহযোগ আন্দোলন, শনিবার থেকে দেশজুড়ে ধর্মঘট

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করার প্রতিবাদে আন্দোলনরত কর্মকর্তারা এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের অপসারণের দাবিতে গতকাল থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন।
এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তারা আরও জানান, আগামী শনিবার থেকে সব ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট অফিসে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হয়েছে—তবে কাস্টমস হাউস ও স্থল শুল্ক স্টেশনগুলো এই ধর্মঘটের আওতামুক্ত থাকবে।
তবে দাবি পূরণ না হলে ২৬ মে থেকে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ছাড়া এনবিআরের সব কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
গত এক সপ্তাহ ধরে এনবিআর কর্মকর্তারা প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করে আসছেন। সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, আজ প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের দাবিসংবলিত একটি স্মারকলিপিও জমা দেওয়া হবে।
মঙ্গলবার অর্থ উপদেষ্টা, এনবিআর কর্মকর্তাবৃন্দ ও রাজস্ব সংস্কার কমিটির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠককে ব্যর্থ উল্লেখ করে কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আমদানি-রপ্তানি, সরকারের রাজস্ব আয় ও ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যদি কর্মকর্তারা পুরো কর্মবিরতি শুরু করেন, তাতে রাজস্ব আদায়ের ক্ষতি হবে। এর বাইরে সময়মতি রপ্তানি না হলে রপ্তানিকারকদের ক্ষতি হবে। আমদানি আটকে গেলে সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে—যা পুরো অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'এতে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগও বাধার মুখে পড়বে। এ কারণে এনবিআরের অন্যান্য সংস্কার আটকে যেতে পারে—এবং এনবিআরের কর্মকর্তারা উৎসাহ হারালে তা সার্বিকভাবে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।'
এই সংকট সমাধানে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে স্বচ্ছতার সঙ্গে সমাধান বের করার পরামর্শ দিয়ে তৌফিকুল আলম বলেন, অতীতে স্বচ্ছতার অভাবে পলিসি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায়নি।
উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী নেতারাও। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, 'কর্মকর্তারা পুরোদমে স্ট্রাইক করলে আমাদের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আগামী ঈদের আগে বেতন-বোনাস দেওয়া কঠিন হবে।'
রপ্তানিকারকরা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিস থেকে কাঁচামাল আমদানির অনুমতি নেন। রপ্তানি ও আমদানির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কাস্টমস হাউজগুলো। ফলে এসব অফিসে কর্মবিরতি শুরু হলে তাদের ওপরে ধাক্কা আসবে।
এছাড়া কর ও ভ্যাট আদায়েও ধাক্কা পড়বে।
দ্রুত এই সংকট নিরসনের আহ্বান জানিয়ে হাতেম বলেন, 'এনবিআর কর্মকর্তাদের দাবি যৌক্তিক হলে তা মেনে নেওয়া উচিত। আমরা এনবিআর পৃথক হোক তা চেয়েছি। কিন্তু সেখানে বিভাগের প্রধান নিজস্ব বিভাগ থেকে আসাই যৌক্তিক হবে।'
প্রসঙ্গত, অর্থবছরের শেষ তিন মাসে রাজস্ব আদায়ের চাপ থাকে বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মোট লক্ষ্যমাত্রার ৫৩ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে। লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এই তিন মাসে আদায় করতে হবে বাকি ৪৭ শতাংশ। গত এপ্রিলে রাজস্ব আদায়ে সামান্য প্রবৃদ্ধি হলেও চলতি মাসে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন খোদ এনবিআরের কর্মকর্তারাই।
'অধ্যাদেশ পাশ করা হয়েছে গোপনে ও তড়িঘড়ি করে'
সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর কর্মকর্তারা তাদের দাবির বিস্তারিত তুলে ধরেন। এসবের মধ্যে রয়েছে বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ, সদ্য পাশ হওয়া অধ্যাদেশ বাতিল—যেটি রাজস্ব সংস্কার কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে গোপনে ও তড়িঘড়ি করে পাশ করা হয়েছে বলে দাবি করেন তারা—সংস্কার কমিটির সুপারিশের পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে রাজস্ব ব্যবস্থার পুনর্গঠন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এনবিআরের অতিরিক্ত কর কমিশনার হাসিনা আখতার এবং এনবিআরের অধিকাংশ সিনিয়র কর্মকর্তা ও কমিশনারদের নিয়ে গঠিত প্ল্যাটফর্ম 'এনবিআর রিফর্ম ইউনিটি পরিষদ'-এর দুইজন শীর্ষ কর্মকর্তা।
১২ মে ঘোষিত একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর ভেঙে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্তে আন্দোলনে নামেন কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ করেন, রাজস্ব সংস্কার কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে এবং তা প্রকাশ না করেই এই অধ্যাদেশ গোপনে ও তড়িঘড়ি করে পাশ করা হয়েছে। এতে এনবিআর কর্মকর্তাদের বাদ পড়ার এবং কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তারা।
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে এনবিআর কর্মকর্তাদের বহুলপ্রত্যাশিত সভা ভেস্তে গেল যে কারণে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির অধ্যাদেশ ঘিরে চলমান আন্দোলন, অচলাবস্থা ও রাজস্ব ক্ষতির প্রেক্ষাপটে সমস্যা সমাধানে গতকাল মঙ্গলবার বহুলপ্রত্যাশিত বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
এতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদসহ উপদেষ্টা পরিষদের আরও দুজন সদস্য, এনবিআরের আন্দোলনরত কর্মকর্তা ও রাজস্ব সংস্কার কমিটির সদস্যরা অংশ নেন।
তবে বৈঠকের শুরুতেই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, 'আমি মিটিং দীর্ঘ করব না… আমি ৬–৭ মিনিটের বেশি সময় দেব না।'
তিনি আরও বলেন, 'ক্যাবিনেট সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে আরেকটি মিটিং আছে, আমি তাদের বসিয়ে রাখতে পারব না।'
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে এনবিআরের কর্মকর্তাদের বৈঠকের বিষয়বস্তু বুধবার (২১ মে) সাংবাদিকদের কাছে এভাবেই তুলে ধরেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের বিষয়টি টিবিএসকে নিশ্চিত করেছেন বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অর্থ উপদেষ্টার এ বক্তব্য শুনে উপস্থিত এনবিআরের কর্মকর্তাসহ রাজস্ব সংস্কার কমিটির সদস্যরা হতবাক হয়ে পড়েন।
রাজস্ব সংস্কার কমিটির সদস্য আমিনুর রহমান খন্দকার টিবিএসকে বলেন, 'আমরা সভাকক্ষে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের অপেক্ষায় ছিলাম। এমন সময় জনপ্রশাসন সচিব তার দল নিয়ে ঢুকেই বললেন, "আমাদের সঙ্গেও একই সময়ে মিটিং আছে।'"
ফলে বৈঠকটি সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। সভায় এনবিআরের কর্মকর্তারা ছাড়াও রাজস্ব সংস্কার কমিটির সদস্যরা বলেন, তাদের প্রতিবেদনে যেভাবে সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে, তা জারিকৃত অধ্যাদেশে প্রতিফলিত হয়নি।
তাদের মতে, প্রতিবেদন অনুযায়ী সংস্কার কার্যকর হলে তা জাতীয় স্বার্থে উপকারী হবে। তারা দুটি বিভাগের (রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা) নেতৃত্ব এনবিআরের মধ্য থেকেই নির্ধারণের পক্ষে অবস্থান জানান।
তবে এসব আলোচনার বাইরে গিয়ে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের অর্থ উপদেষ্টা বলেন, 'এনবিআর বিষয়ে যে মিস-কনসেপশন [ভুল বোঝাবুঝি] ছিল, তা দূর হয়েছে। এনবিআরকে যে দুই বিভাগে ভাগ করা হয়েছে, তা-ই থাকবে।'
এনবিআর কর্মকর্তারা বৈঠকে সন্তুষ্ট কি না এবং তারা আন্দোলন শেষ করবেন কি না—এমন প্রশ্নে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, 'আমরা তাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বলেছি। তারা করবে কি না তা আমার চিন্তার বিষয় নয়।'
ওই বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'অর্থ উপদেষ্টা এনবিআরের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিতে—যাতে বলা হবে আন্দোলনকারীদের কথা শোনা হয়েছে এবং পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
তবে একজন কর্মকর্তা তখন বলেন, 'স্যার, আমাদের কথা বলার সুযোগই দেওয়া হয়নি।' এর জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, 'আমি এত সময় কাউকে দিই না। তোমাদের কথা অনেক শুনেছি। আমি যখন সহকারী কমিশনার ছিলাম, তখন সচিবের রুমে তো ঢুকতেই দিত না।'
তিনি আরও বলেন, 'তোমরা আন্দোলন করছ, আইনজীবী সমিতিকে নামিয়েছ, টিআইবি, সিপিডিকে নামিয়েছ, রিট করিয়েছ। আমি এগুলো নিয়ে কেয়ার করি না।'
এমন সময় একজন কর্মকর্তা কিছু বলতে চাইলে তাকেও থামিয়ে দেন উপদেষ্টা—এমন অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা।
বৈঠক শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, 'জারিকৃত অধ্যাদেশ বিষয়ে কর্মকর্তাদের বিভিন্ন উদ্বেগ, পরামর্শ এবং মতামত গুরুত্বসহকারে শোনা হয়। উত্থাপিত বিষয়সমূহ যথাযথভাবে বিবেচনা করা হবে মর্মে অর্থ উপদেষ্টা মহোদয় আশ্বাস প্রদান করেন।'
তবে ওই রাতেই এনবিআরের আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের সংগঠন 'এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ' এক বিবৃতিতে জানায়, উপদেষ্টার সঙ্গে 'আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি'।
আজ বুধবার (২১ মে) তারা ঘোষণা দেন, কর্মবিরতি আরও জোরদার করা হবে এবং অসহযোগ আন্দোলন চলবে পুরোদমে। এর ফলে আগামী কয়েকদিনে দেশের রাজস্ব খাতে আরও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য জানতে টিবিএসের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও ফোনে বা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।