অনুমোদন পেল ৯ অর্থনৈতিক অঞ্চল, উদ্বেগ গ্যাস সরবরাহ নিয়ে

দেশে নয়টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে দুটি সরকারি, দুটি জিটুজি (সরকারি পর্যায়ে) চুক্তিভিত্তিক ও পাঁচটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে।
তবে উদ্যেক্তারা গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে বিলম্ব হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগে দিতে দীর্ঘসূত্রতা শিল্প কার্যক্রম শুরু করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এপ্রিলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) পরিচালনা পর্ষদের ৮ম সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল আগেই বিভিন্ন নীতিগত বা প্রাথমিক পর্যায়ে অনুমোদন পেয়েছিল। এবার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেল।
নতুন অনুমোদিত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মোট জমির পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৫৭৪ একর।
পাঁচটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ভোলা সদর ও দৌলতখান এলাকায় ভোলা ইকো ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক জোনকে ২০২৪ সালের ৪ জুলাই নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। চীনা মালিকানাধীন লিজ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি লি. ১০২ একর জমিতে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করবে।
নরসিংদী সদরে আমানত শাহ স্পেশাল ইকোনেমিক জোন ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর প্রাক-যোগ্যতাপত্র পেয়েছিল। প্রায় ৩৬ একর জমিতে আমানত শাহ গ্রুপ এ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছে।
নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জ উপজেলায় ৯৩ একর জমিতে পূর্বগাঁও অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে সিটি গ্রুপ। অঞ্চলটি ২০২২ সালে নীতিগত ও ২০২৪ সালের ৫ মার্চ চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।
কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
৩৬০ একর জমিতে কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চল করবে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থনৈতিক অঞ্চলটি ২০২২ সালে চূড়ান্ত লাইসেন্স পায়। এ জোনটিতে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার এবং কর্মসংস্থান তৈরি করবে প্রায় ৫০ হাজার। তিতাস ইকোনমিক জোন ২০২৩ সালে প্রাক-যোগ্যতাপত্র পায়। ১৬০ একর আয়তনের এ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবার পেয়েছে ভূতাপেক্ষ অনুমোদন।
জিটুজি ভিত্তিতে যে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন পেয়েছে, তার মধ্যে চাঁদপুরে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রায় ৩ হাজার ৩৭ জমিতে হবে। এ জোন করতে ঢাকাস্থ চীনা দুতাবাস ২০২৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে।
কুড়িগ্রামে ২০০ একর জমিতে জিটুটি ভিক্তিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করবে ভুটান। এ জোন করার জন্য গত বছরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে সরকারের সঙ্গে ভুটার সরকারের চুক্তি সই হয়।
সরকারি যে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দেয়া হয়োছে, তার মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরা সদরে ১১৩ একর জমিতে সাতক্ষীরা অর্থনৈতিক অঞ্চল। ২০২২ সালে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল নীতিগত অনুমোদন পায়। আর রংপুরের কাউনিয়া সদর উপজেলায় ৪২৮ একর জমিতে রংপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল (কাউনিয়া) নীতিগত অনুমোদন পায় ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে।
ইউটিলিটি সংযোগে বিলম্ব, হতাশ বিনিয়োগকারীরা
বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীসহ অনেক বিনিয়োগকারী অবকাঠামোতে বিপুল বিনিয়োগ করেও বছরের পর বছর গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন।
উদ্যোক্তারা সতর্ক বলছেন, সময়মতো ইউটিলিটি সংযোগ পাওয়া না গেলে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পাওয়ার পরও নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বিনিয়োগ আকর্ষণ ও ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এসব উদ্বেগ স্বীকার করেন।
'ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন দিতে হলে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হতে হবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের মতো সেবাদানকারিরী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে তারা সেখানে সঠিক সময়ে সেবা দিতে পারবে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, এখন সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয় মেনে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো করা হবে। পরিবেশগত আধুনিকায়ন সূত্র মানা হবে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলকে প্রাক-যোগ্যতা লাইসেন্স দেয়া হবে না।
বেজা জানিয়েছে, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর অনুমোদন কার্যক্রম তাদের নৈমিত্তিক বা রুটিন কার্যাবলির অংশ। জিটুজি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য চীন, ভুটান ও নেপালের হাইকমিশনের সঙ্গে তাদের নিয়মিত সমন্বয় ও যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। তবে দ্বিপাক্ষিক জটিলতার কারণে জিটুজি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো স্থাপনের কাজ ধীরগতিতে এগোয়। এছাড়া বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কাজ নিজস্ব গতিতে এগোবে।
তবে বেসরকারি খাতে হতাশা বাড়ছে।
এমজিআইয়ের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল গত ৩০ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে বলেন, কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেও তারা গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না।
'আমরা বিদেশিদের বিনিয়োগের জন্য ডাকছি, অথচ নিজের দেশের উদ্যোক্তারা জ্বালানি সংকটে ভুগছেন। এটা অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। কারণ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিনিয়োগের জন্য আবশ্যক,' বলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রমে এক অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, 'গ্যাস সরবরাহ একটা বড় সমস্যা। সম্প্রতি জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে শিল্পে বাড়াবেন। আমার মনে হয়, এটাই যথেষ্ট না, আমাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার কাছে বিনিয়োগকারী প্রস্তুত, কিন্তু আমার সুযোগ প্রস্তুত না দুর্ভাগ্যবশত। আমাদের যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে।'
এ সমস্যার সমাধানে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলসহ পরিকল্পিত শিল্পনগরীতে স্থাপিত রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানাগুলোকে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়ার পাশাপাশি চালু থাকা কারখানার লোড বাড়াতে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
পেট্রোবাংলা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে গ্যাস প্রেশার ঠিক রাখা এবং সিস্টেম লস অর্ধেকে নামিয়ে আনার সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ন্যাশনাল স্পেশাল ইকোনমিক জোন, সিলেট অর্থনৈতিক অঞ্চল, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল ও জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে জানুয়ারিতে একটি দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা ঘোষণা করে বেজা।
এ পরিকল্পনা লক্ষ্য ৫.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ২.৫ লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, এখন থেকে সমস্ত বেসরকারি অঞ্চলের অনুমোদন ও সেবা প্রদানে নির্দিষ্ট সময়সীমাভিত্তিক পদ্ধতি মেনে চলা হবে।