ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ, তবে আমাদের জন্য ওয়েকআপ কল: ফাহমিদা খাতুন

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, সারা বিশ্বে এখন শুল্ক ঝড় বইছে। মার্কিন প্রশাসন শুল্কহার বৃদ্ধিতে কোন নিয়ম কানুনের ধার ধারেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে শুল্ক আরোপ নিয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও এই চ্যালেঞ্জের বাইরে নয়। বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ কর আরোপের প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ। তবে ট্রাম্পের উচ্চ শুল্কনীতি আমাদের জন্য ওয়েকআপ কল। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর আমরা বেশি সময় কর সুবিধা পাবো না। তাই আমাদের বাণিজ্যিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তুতি খুবই জরুরী।
আজ শনিবার (১২ এপ্রিল) ঢাকার এফডিসিতে (৮নং ফ্লোরে) যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কহারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা নিয়ে আয়োজিত ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান জনাব হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, অতিরিক্ত শুল্ক গ্রহণে ৯০ দিনের স্থগিতাদেশ বাংলাদেশের জন্য কিছুটা স্বস্তির। এই সময়ে সম্ভাব্য ঝুঁকি নিরসনে বাণিজ্য কূটনীতি জোরদার ও অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি অনুুকূল না থাকলে বৈদেশিক বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। আন্দোলনের নামে সহিংসতা ও ভাঙচুর হলে বিনিয়োগকারীরা শংকায় পড়বে। বর্তমানে যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবায়িত হলে ক্ষমতার পালাবদলেও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার পরিবর্তন হবে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা হলে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে ঘোষিত নতুন শুল্ক আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত করায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে সাময়িক স্বস্তি মিললেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। তবে এই স্থগিতাদেশের পর বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বন্ধ হওয়া ক্রয়াদেশ ফিরে পাওয়া শুরু করছে। অন্যদিকে চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কারণে তাদের ক্রয়াদেশ স্থগিত হচ্ছে।
তিনি মনে করেন, চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করবে। এছাড়াও চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের মুখে নিজেদের বাণিজ্য সামাল দিতে আগামী সপ্তাহে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ সফরে যাচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এই কঠিন অবস্থার মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলে আমাদের রপ্তানি খাত আরো বেশি প্রসারিত হবে।
কিরণ যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কহারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ১০ দফা সুপারিশ করেন, এগুলো হলো—
১. শুধুমাত্র পোশাক খাত কেন্দ্রিক রপ্তানি নির্ভরতা না রেখে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখিতা ও বৈচিত্র্য বাড়ানো এবং বিকল্প বাজার খুঁজে বের করা;
২. যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য কূটনীতি জোরদার করে— সেদেশের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের রপ্তানি অব্যাহত রাখা;
৩. যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য কূটনীতি বজায় রেখে আমদানি বাড়িয়ে তুলা, সয়াবিন, মেশিনারি, ওষুধ ও সেবা পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমালে তারা পাল্টা শুল্ক আরোপ থেকে সরে আসতে পারে;
৪. মার্কিন উচ্চ শুল্ক হার আরোপের উদ্বেগ নিরসনে অর্থনীতিবিদ, বাজার বিশ্লেষক ও ব্যবসায়িক প্রতিণিধিদের নিয়ে ইকোনমিক কনসাল্টেশন গ্রুপ গঠন করা;
৫. ৯০ দিনের স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষে রপ্তানি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছালে বা জাহাজীকরণ হলে— রপ্তানির বিপরীতে স্থগিতকৃত শুল্ক সুবিধা প্রযোজ্য হবে কিনা তা স্পষ্ট করা;
৬. শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ দূরীকরণে দ্বন্দ¦ নিরসন ও শিল্প সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা;
৭. আমরা অনেক সময় রপ্তানিমূল্য সঠিক সময়ে দেশে আনা হয় না। রপ্তানিকারকদের সঠিক সময়ে রপ্তানি মূল্য দেশে আনতে উৎসাহিত করতে হবে। এতে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ পাবে অন্যদিকে ঋণ খেলাপিও হ্রাস পাবে;
৮. পণ্য রপ্তানির ওপর ক্যাশ ইনসেনটিভ (নগদ প্রণোদনা) প্রদান নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। রপ্তানিকারকদের নগদ প্রণোদনা না দিয়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ এ ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। এতে প্রণোদনার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং প্রকৃত রপ্তানিকারকরা প্রণোদনা পাবে। চীন এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সফলতা পেয়েছে।
৯. আগামী নির্বাচনে ঋণখোলাপিদের মনোনয়ন না দেওয়ার বিষয়ে— রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত গড়ে তোলা এবং নির্বাচনী ইশতিহারে তা উল্লেখ করা, এবং
১০. বিল অফ এন্ট্রি ইস্যুর ক্ষেত্রে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে এবং আমদানিতে ফরেন কারেন্সি রিলিজ করার পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকয়ের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি'র আয়োজনে "যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক হারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সক্ষম হবে" শীর্ষক ছায়া সংসদে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি'র বিতার্কিকদের পরাজিত করে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, সুলতান আহমেদ ভূঁইয়া এফসিএ, সাংবাদিক দৌলত আক্তার মালা, ড. এস এম মোর্শেদ ও টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা কেএম মাহমুদ হাসান। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।