ট্রাম্পের শুল্কনীতি কি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য সুযোগ তৈরি করবে?

চীন ও মেক্সিকো থেকে আমদানির ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক বৃদ্ধি বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
তারা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ও চীনের রপ্তানির ওপর প্রায় একই হারে শুল্ক আরোপ করা হতো। তবে ট্রাম্প প্রশাসন ধাপে ধাপে চীনা রপ্তানির ওপর বিদ্যমান শুল্কের পাশাপাশি অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা এ মাস থেকে কার্যকর হয়েছে।
এদিকে, নতুন মার্কিন শুল্ক নীতির আওতায় মেক্সিকো থেকে আমদানির ওপরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর আগে, উত্তর আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (নাফটা) অধীনে মেক্সিকোর রপ্তানি শূন্য শুল্ক সুবিধা পেত।
পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এসব শুল্ক স্থগিত করেন। তবে এ স্থগিতাদেশ ২ এপ্রিল শেষ হচ্ছে। ওইদিন থেকে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সব বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর পারস্পরিক শুল্কনীতি কার্যকর করার হুমকি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর এক গবেষণা অনুযায়ী, পণ্যের ধরন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ওপর ন্যূনতম ১১.৭ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, শুল্ক বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ওপর চীন ও মেক্সিকোর বিকল্প খুঁজে বের করতে চাপ তৈরি করবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে।
তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশেরও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত রয়েছে, যা ২ এপ্রিল ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্কনীতি কার্যকর হলে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তারা স্থানীয় শিল্পকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেওয়া কমিয়ে বাণিজ্য উদারীকরণের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর কাছে জায়ান্ট গ্রুপের পরিচালক এস এম মজিদুর রহিম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্য আমদানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে ক্রেতারা বিকল্প উৎসের দিকে ঝুঁকতে পারেন।
তবে তিনি বলেন, এ পরিবর্তন রাতারাতি হবে না, কারণ সরবরাহের নতুন উৎস খুঁজে পেতে ছয় থেকে সাত মাস লেগে যেতে পারে।
তিনি যোগ করেন, গ্রুপটি দীর্ঘ সময় ধরে মার্কিন ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা করছে এবং বছরের পর বছর উচ্চ শুল্ক সত্ত্বেও, তাদের ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কোম্পানির ব্যবসার মূল্য প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার। গত বছর, গ্রুপটি রপ্তানি থেকে ৭৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
সেই বছরে কোম্পানির প্রবৃদ্ধি ২৩ শতাংশের বেশি হয়েছিল। এরর পেছনে একটি কারণ ছিল, মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে পাওয়া অতিরিক্ত অর্ডার।
অর্থনীতিবিদ এম মাশরুর রিয়াজ বলেছেন, তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক ঘাটতি বিবেচনায় মার্কিন প্রশাসন কিছু দেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে।
তিনি আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত আমাদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।'
নতুন বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের সম্ভাবনা
যুক্তরাষ্ট্রে কটন জার্সি ও পুলওভার-এর চাহিদা অনেক বেড়েছে, কারণ এগুলো মৌসুমি ফ্যাশন ট্রেন্ড এবং দৈনন্দিন আরামদায়ক পোশাক হিসেবে জনপ্রিয়।
'ফ্যাশন টু ফাইবার' নামক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব এবং প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের পরিবর্তন কেমন হতে পারে তা বিশ্লেষণ করেছে। বিশেষ করে, চীন বাজার হারানোর ফলে বাংলাদেশসহ কোন দেশগুলো লাভবান হতে পারে তা খতিয়ে দেখা হয়েছে, কারণ উচ্চ শুল্ক চীনের পণ্যগুলোকে কম প্রতিযোগিতামূলক করে তুলছে।
বাংলাদেশ এই পরিবর্তিত বাণিজ্যিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হতে প্রস্তুত, যেখানে এর প্রকাশিত তুলনামূলক সুবিধার সূচক (আরসিএ) ২৭.৩৬ এবং সর্বনিম্ন ইউনিট ভ্যালু রিয়ালাইজেশন (ইউভিআর) প্রতি কেজিতে ১৪.৮৬ ডলার।
এটি নির্দেশ করে, বাংলাদেশ তুলার জার্সি এবং পুলওভার রপ্তানিতে বিশেষভাবে দক্ষ। অর্থাৎ, অধিকাংশ প্রতিযোগীর চেয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত তুলনামূলক কম দামে এই পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করতে সক্ষম।
প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ কৌশলের কারণে বাংলাদেশ মূলত চীনের প্রধান প্রতিযোগী। তবে চীনের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির কারণে মার্কিন ক্রেতারা এখন কম খরচে বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজছে এবং সেখানে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
ব্যবসায়ী নেতারা কী বলছেন?
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরা মার্কিন বাজারে ভালো পারফর্ম করছে।
তিনি আশাবাদী, আগামী মাসগুলো আরও ভালো হবে, কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের অতিরিক্ত শুল্কের কারণে কিছু অর্ডার চীন থেকে বাংলাদেশে চলে আসছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা তুলার ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।
তিনি বলেন, 'এই শুল্ক ব্যবস্থা বাংলাদেশের স্পিনিং এবং টেক্সটাইল মিল মালিকদের উপকারে আসবে, যা তাদের তুলা আরো প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে কিনতে সাহায্য করবে।'
ফারুক হাসান গুরুত্ব দিয়ে বলেন, এই সুযোগটি কাজে লাগাতে সরকারকে চারটি মূল বিষয় সমাধান করতে হবে: গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ, খরচ কমানো, কাস্টমস সেবা উন্নত করা এবং আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং অতিরিক্ত অর্ডার পাওয়ার জন্য আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি এবং এটি এখন শীর্ষ অগ্রাধিকার। পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে আহ্বান জানান তিনি।
ফারুকের মন্তব্যের সাথে একমত হয়ে টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, বাংলাদেশের মার্কিন বাজারে উপস্থিতি বাড়ানোর একটি সুযোগ রয়েছে, কারণ বাণিজ্যগুলো চীন থেকে সরে যাচ্ছে।
তবে, তিনি সরকারের সহায়তার অভাব নিয়ে সমালোচনা করে বলেন, 'সরকার শিল্পের চাহিদার সাথে নীতিমালা সমন্বয়ের কোনো ইচ্ছা দেখায়নি।'
এদিকে, বিএকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গত কয়েক মাসে অর্ডার বাড়লেও, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে রপ্তানিকারকদের মূল্য নির্ধারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (ওটেক্সা)-এর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক এবং রপ্তানি থেকে আয় ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলার। চীন এবং ভিয়েতনাম যথাক্রমে প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তাদের রপ্তানি থেকে আয় যথাক্রমে ১৬.৫১ বিলিয়ন ডলার এবং ১৪.৯৮ বিলিয়ন ডলার।