বছরের শেষার্ধে তিন ব্যাংক ৫১,৬১৬ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে পড়ল কেন

শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে কোনো ধরনের প্রভিশন ঘাটতি না থাকা তিনটি ব্যাংক আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ৫১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এর অন্যতম কারণ, হাসিনার শাসনামলে বোর্ডের একচ্ছত্র ক্ষমতায় এসব তথ্য গোপন ছিল। আওয়ামী লীগে সরকারের পতনের পর এসব ব্যাংকের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত গোপন তথ্যগুলো বের হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুনে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা এবং বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের কোনো ধরনের প্রভিশন ঘাটতি ছিল না।
তবে ডিসেম্বর শেষে এই তিনটি ব্যাংকের মধ্যে জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলোকে সাধারণত তাদের আমানতের ০.৫০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। তবে খেলাপি ঋণের শ্রেণিকরণের ভিত্তিতে ২০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশনিং রাখতে হতে পারে।
উচ্চ মাত্রার খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়। প্রভিশন ঘাটতি বাড়লে ব্যাংকের নিট মুনাফা কমে যায়; এর ফলে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও কমে যায়।
ব্যাংকাররা বলছেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। গত জুনে যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি ছিল না, ডিসেম্বরে এসে এসব সূচকে ওই ব্যাংকগুলোর ব্যাপক অবনতি হয়েছে।
এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ, তখন ব্যাংকগুলোর বোর্ডের একচ্ছত্র ক্ষমতায় এসব তথ্য গোপন ছিল। গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব ব্যাংকের গোপন তথ্যগুলো বেরিয়ে আসছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতিতে পড়ার অর্থ হচ্ছে ব্যাংকটি মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।
তিনি বলেন, এই সমস্যা মোকাবিলায় নগদ অর্থের সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। একইসঙ্গে ব্যাংকের 'প্রফিটেবিলিটি' বাড়াতে হবে। যার ফলে প্রভিশন ঘাটতি কমে আসবে।
এই অভিজ্ঞ ব্যাংকার আরও বলেন, 'এছাড়া ব্যাংকের যারা বোর্ডে আসবেন, তাদের নতুন করে মূলধন ইনজেক্ট করতে হবে। এতে প্রভিশন ঘাটতি কমে এলে মূলধনের ওপর প্রভাব পড়বে না।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ১২টি ব্যাংক ১ লাখ ৯ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে। ছয় মাস আগে এই ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৩৪ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা।
প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলো হলো: অগ্রণী, বেসিক, জনতা, রূপালী, সোনালী, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, আইএফআইসি, ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ও স্ট্যান্ডার্ড।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতি আরও বেশি হতে পারে, কারণ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের প্রভিশন ডিফারাল সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।
নাম না প্রকাশের শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, 'পাঁচ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের জন্য ডিফারাল সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে বর্তমান বকেয়া বিলম্বিত প্রভিশনের পরিমাণ মূল্যায়ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। যদিও এটি যথেষ্ট পরিমাণে রয়ে গেছে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি মূলত প্রভিশন ঘাটতি বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১.৩৪ লাখ কোটি টাকা বেড়েছে। ডিসেম্বর শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৪৫ লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ২০.২ শতাংশ।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০২৪ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২.১১ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২.৫৬ শতাংশ ছিল।