চলতি অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ধার নেওয়া বেড়েছে ৭৪ শতাংশ

বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হওয়া এবং সংকোচনশীল মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঋণ কমানোর পরিকল্পনার কারণে চলতি অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ধার নেওয়া ৭৪ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, জুলাই থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রি করে ৭৮ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা ধার নিয়েছে সরকার, যা এক বছর আগের একই সময়ে ৪৫ হাজার ২৩১ কোটি টাকা ছিল।
বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে সরকারের বকেয়া ঋণ ৩.৯৭ লাখ কোটি টাকা।
তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া ঋণের মাধ্যমে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ধারের ৬২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া সরকারের বকেয়া ধারের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। এ ধারের পরিমাণ ২০২৪ সালের জুনের ১.৫৬ লাখ কোটি টাকা থেকে কমে ৯৪ হাজার ৪২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকার বর্তমানে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ধার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার পরিশোধ করার প্রক্রিয়ায় গেছে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার পরিশোধ করার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালান্স শিটকে সংকুচিত করা হচ্ছে, যা আগের অস্বাভাবিক সম্প্রসারণকে সংশোধন করছে।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, এই প্রবণতা রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে দিচ্ছে। গত দুইমাস ধরে মূল্যস্ফীতি কমছে, তবে এখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের ধার সরাসরি কমানো এখনও দেখা যায়নি।
সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ধার না বাড়ালে মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল মন্তব্য করে জাহিদ হোসেন বলেন, 'সরকার ধার না বাড়ালে বাজারে অর্থ সরবরাহ অনেক বেশি থাকত।'
'ব্যাংকগুলোর হাতে অনেক তারল্য থেকে যাওয়ার কারণে তারা বেসরকারি খাতকে বেশি ঋণ দিত এবং এসব ঋণের ঠিকমতো ব্যবহার না হলে মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ তৈরি হতো। অবশ্য এখন বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার কারণে ব্রড মানির প্রবৃদ্ধি কমে গেছে,' বলেন তিনি।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ধার বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি অনেক কমে গেছে। এছাড়া বেশ কিছু দুর্বল ব্যাংকের আমানত ঘুরেফিরে কয়েকটি সবল ব্যাংকের হাতে চলে এসেছে। ফলে সবমিলিয়ে ব্যাংকগুলোর হাতে এখন তারল্যের পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক বেশি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কম থাকায় ব্যাংকগুলোর জন্য বিনিয়োগের একটি আকর্ষণীয় টুল হয়ে উঠেছে ট্রেজারি বিল ও বন্ড। সরকারের নিশ্চয়তা থাকায় এই বিনিয়োগে ঝুঁকি নেই; ফলে ব্যাংকগুলো সেদিকে ঝুঁকছে।
অনেকসময়ই সরকারের তরফ থেকে যে পরিমাণ ট্রেজারি বিল ও বন্ড নিলামে তোলা হচ্ছে, ব্যাংকগুলো বিড করছে তার কয়েকগুণ বেশি। ফলে ১২ শতাংশ পার করে যাওয়া ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৭.২৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা নভেম্বরের তুলনায় ৩৮ বেসিস পয়েন্ট কম। নভেম্বরে ঋণের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৩ বছরের সর্বনিম্ন ৭.৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.১৩ শতাংশ। এরপর থেকেই এ প্রবৃদ্ধি ধীরে ধীরে কমছে।
এই প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের ৯.৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের নিট ধার বেড়েছে ১৬ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময় শেষে সরকারের নিট ধার বেড়েছিল ১২ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় সরকার ব্যাংক খাত থেকে নিট ধার বাড়িয়েছে ৩৪ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী, পুরো অর্থবছরে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ধার নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে ৯৯ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং খাত থেকে এবং ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং-বহির্ভূত খাত থেকে নেওয়া হবে। সেই হিসাবে এখন পর্যন্ত প্রায় আট মাসে ব্যাংকিং খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার ১৭ শতাংশ ধার নিয়েছে সরকার।
২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের নিট ধার দাঁড়িয়েছে ৪.৯১ লাখ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের জুনের শেষে ছিল ৪.৭৪ লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার সরবরাহ কমিয়ে করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারি ঋণ কমানো এবং নীতিমালা ও সুদহার বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
ব্যাংক থেকে সরকারের ধার নেওয়া সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, 'বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী সরকারের ব্যাংকিং খাত থেকে ধার করার টার্গেট কমানো উচিত। অর্থাৎ সরকারের খরচ কিছুটা কমাতে হবে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ধার নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা কম ধার নেওয়া হলে বেসরকারি খাতের ঋণ কিছুটা বাড়বে।'