এক বছর পেরিয়ে গেলেও চিনির কাঁচামাল আমদানির ৪৩৪ কোটি টাকা শুল্ক পরিশোধ করেনি এস আলম

এক বছর পেরিয়ে গেলেও বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ এখনও চিনির কাঁচামাল আমদানি করে ৪৩৪ কোটি টাকা শুল্ক পরিশোধ করেনি। যদিও বকেয়া অর্থ আদায়ের জন্য কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট চারটি মামলা দায়ের করেছে বলে জানা গেছে কাস্টমস মামলার নথি সূত্রে।
উল্টো একটি মামলায় ২৪৬ কোটি টাকা পরিশোধ না করে আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আপিল করেছে এস আলম। এতে নিকট ভবিষ্যতে কাস্টমসের পাওয়া আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এ পর্যন্ত কয়েক দফায় ৭১৩ কোটি টাকা শুল্ক-করের বিপরীতে এস আলম ২৭৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ২০২৪ সালের মার্চ থেকে কোম্পানিটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের নামে এই বকেয়া জমা হচ্ছে।
মামলার নথির তথ্য অনুযায়ী, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাষ্ট্রিজ ২০২৩ সালের আগস্টে ১১টি চালানে ৫৫ হাজার ৮০০ টন র সুগার (চিনির কাঁচামাল) আমদানি করে। প্রায় ৩২৭ কোটি টাকা মূল্যের এসব অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক-কর আসে ১৮৭ কোটি টাকা। কাস্টমসের হোম কনজাম্পশন বন্ডের আওতায় এই পণ্য চালানের শুল্ক ছয় মাসের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিল।
কিন্তু পণ্য আমদানির ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এই টাকা পরিশোধ করতে পারেনি এস আলম।
বন্ডিং মোয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টম বন্ড কমিশনারেট এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে গত বছরের ৫ মার্চ কাস্টমস আইনে মামলা করে।
শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া চিনির কাঁচামাল আমদানিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শুল্ক পরিশোধ করতে না পারায় এস আলম এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে একে একে চারটি মামলা দায়ের করে কাস্টমস।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, বন্ডিং মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর একটি মামলায় ২৬৪ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য বিচারাদেশ দেয়। কিন্তু এস আলম এই মামলার বিরুদ্ধে আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আপিল করে। এর ফলে এই মামলায় শুল্ক-কর আদায়ে বিলম্ব হচ্ছে।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, আমদানি করা ৫৫ হাজার ৮০০ টন চিনির কাঁচামালের রাজস্ব আদায়ের মামলায় এস আলম ইতিমধ্যে ১৮৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। তবে রাজস্ব পরিশোধে বিলম্ব হওয়ায় এই মামলায় প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা সুদ এসেছে।
এই বকেয়া সুদের টাকা পরিশোধ করতে চট্টগ্রাম কাস্টম বন্ড কমিশনারেট আবারও কারণ দর্শাণো নোটিশ জারি করে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার এস এম কবিরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'কাস্টমসের মামলার বিপরীতে এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগ্রুলো এখন ফ্রিজ অবস্থায় রয়েছে। ফলে তারা সময়মতো শুল্ক-কর পরিশোধ করতে পারছে না। এর প্রভাবে তাদের চিনির কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে।'
এস আলম গ্রুপের ম্যানেজার (ভ্যাট ও কাস্টম) দিদারুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা তিনি বলেন, 'আমি ব্যস্ত আছি। এ বিষয়ে পরবর্তীতে কথা বলবে।'
তবে পরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
অপরিশোধিত শুল্ক নিয়ে সমস্যার মধ্যেই অনিবার্য় কারণ দেখিয়ে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর থেকে চিনি, ইস্পাত ও ব্যাগ খাতের আট কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয় এস আলম গ্রুপ।
বন্ধ ঘোষণা করা কারখানাগুলো মধ্যে একটি হলো এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার মইজ্জ্যারটেক এলাকায় এসব কারখানা।
যদিও পরবর্তীতে কারখানাগুলো খুলে দেওয়া হয় বলে দাবি এস আলম গ্রুপের।
এস আলম গ্রুপের মানবসম্পদ ও প্রশাসনের প্রধান মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'আমদানি শুল্ক পরিশোধ না করার বিষয়ে আমি জানি না। তবে সুগার রিফাইনারি কারখানা চালু রয়েছে। এই কারখানায় নিয়মিত শ্রমিক আছে প্রায় ৫০০।'
কমেছে চিনি আমদানি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপ চট্টগ্রাম কাস্টম বন্ড কমিশনারেটের মাধ্যমে ২০২৩ সালে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৫২ টন র সুগার আমদানি করে। এর অ্যাসেসেমেন্ট ভ্যালু প্রায় ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এতে সরকারের শুল্ক-কর আসে প্রায় ৯৪২ কোটি টাকা।
তবে ২০২৪ সালে এস আলমের সুগার রিফানারি মিল র সুগার আমদানি করে ১ লাখ ৪৪ হাজার ১৫৩ টন। এর অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ৯০২ কোটি ৩১ লাখ টাকা। চিনি আমদানিতে শুল্ক আসে ৪৭৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
২০২৫ সালের জানুযারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এস আলম গ্রুপ র সুগার আমদানি করে মাত্র ২ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। এই চিনির অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু প্রায় ১৭ কোটি টাকা। এতে শুল্ক আসে প্রায় ৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
আর্থিক সমস্যা
এস আলম গ্রুপের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংক থেকে আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ায় তাদের চিনির কাঁচামাল আমদানির সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর 'এস আলমের সঙ্গে আর ব্যবসায়ে আগ্রহী নয় ব্যাংকগুলো, বন্ধ হয়ে গেছে তেল-চিনি কারখানা' শিরোনামে টিবিএসে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর প্রভাব পড়ে আমদানিতে। বন্ধ হয়ে যায় গ্রুপটির তেল ও চিনি কারখানা।
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
২০১৭ সালে গ্রুপটি ইসলামী ব্যাংক দখল করে নেয়। অভিযোগ আছে, এরপর আরও একাধিক ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব খাটিয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেয় গ্রুপটি।
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাইফুল ও তার ভাইয়েরাসহ গ্রুপটির কয়েকজন কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে গেছেন অথবা দেশত্যাগ করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এস আলম গ্রুপের আর্থিক সমস্যা আরও গভীর হয়েছে।
ব্যাংকগুলো থেকে সহযোগিতা না পাওয়ায় ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে গ্রুপটির চিনির কাঁচামাল আমাদনি কমে যায় প্রায় ৬০ শতাংশ।