অনুবাদ | ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য সিক্রেট অভ সিক্রেটস’

আগামী ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হচ্ছে জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক ড্যান ব্রাউনের নতুন বই দ্য সিক্রেট অভ সিক্রেটস। ইজেলের পাঠকদের জন্য রইল বইটির প্রথম দুই অধ্যায়ের অনুবাদ।
প্রারম্ভ
আমি নির্ঘাত মরে গেছি, ভাবল মহিলা।
পুরনো শহরের গির্জার সূচাল চূড়াগুলোর অনেক ওপর দিয়ে ভাসছে সে, নিচে তার আলোর সাগর; সেই সাগরে জ্বলজ্বল করছে সেন্ট ভিটাস ক্যাথেড্রালের আলোকিত টাওয়াররগুলো। চোখ দিয়ে, যদি এখনও থেকে থাকে আরকি, সে খুঁজে নিলো ধীরে ধীরে বোহেমিয়ান রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রের দিকে নেমে যাওয়া ক্যাসল হিলের ঢালটা। নজর অনুসরণ করল তাজা তুষারের শুভ্র চাদরে ঢাকা পড়া গোলকধাঁধার মতো সব সরু, আঁকাবাঁকা গলিঘুপচি।
প্রাগ।
সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ছটফট করতে লাগল মহিলা, বোঝার চেষ্টা করল নিজের এই অচেনা অবস্থা।
আমি একজন নিউরোসায়েন্টিস্ট, নিজেকে বোঝাল সে। আমার বিচারবুদ্ধি ঠিক আছে।
কিন্তু দ্বিতীয় উপলব্ধিটা নিয়ে ঘোর সন্দেহ থেকে গেল নিজের মনেই।
এই মুহূর্তে ড. ব্রিজিটা গেসনার শুধু একটা ব্যাপারেই নিশ্চিত: নিজ শহর প্রাগের আকাশে ঝুলছে সে! শরীরটা যেন সঙ্গে নেই। নেই কোনো ভর, আকারও নেই। আছে কেবল সে নিজে, ওর আসল সত্তা...পুরোপুরি সজাগ আর অক্ষত চেতনা ও অস্তিত্ব নিয়ে। ধীরে ধীরে ভেসে চলেছে ভলটাভা নদীর দিকে।
একটু আগের ব্যথার অস্পষ্ট স্মৃতি ছাড়া নিকট অতীতের আর কিছুই মনে করতে পারছে না গেসনার। এখন মনে হচ্ছে যেন পুরো শরীরটাই এই শূন্য বাতাস, যে বাতাসে সে উড়ছে।
এমন অনুভূতি এর আগে কস্মিনকালেও হয়নি জীবনে। নিজের সমস্ত জ্ঞান-বুদ্ধি, যুক্তি...সব জলাঞ্জলি দিয়ে কেবল একটাই ব্যাখ্যা খুঁজে পেল গেসনার:
আমি মরে গেছি, এটাই পরকাল।
কিন্তু ভাবনাটা মাথায় আসতেই ঝেঁটিয়ে বিদেয় করল সে। যত্তসব আজগুবি ভাবনা!
পরকাল আসলে একটা সম্মিলিত বিভ্রম...আমাদের এই নশ্বর জীবনটাকে সহনীয় করার জন্য বানানো মানুষের বানানো এক মিথ্যে সান্ত্বনা।
ডাক্তার হিসেবে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছে গেসনার। জানে, মৃত্যু মানেই সবকিছুর সমাপ্তি। মেডিক্যাল স্কুলে মানুষের মস্তিষ্ক কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে একটা জিনিস খুব ভালোমতো বুঝে গেছে গেসনার: আমাদের যা কিছু পরিচয়—আমাদের আশা, ভয়, স্বপ্ন, স্মৃতি—এগুলো আদপে মস্তিষ্কের ভেতরে বৈদ্যুতিক চার্জের মাধ্যমে ভেসে থাকা কিছু রাসায়নিক যৌগ ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষ মারা গেলে মস্তিষ্কের পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়। আর ওই সব রাসায়নিক গলে পরিণত হয় এক অর্থহীন তরলে। মানুষটার যা কিছু পরিচয় ছিল, তার শেষ চিহ্নটুকুও মুছে যায় চিরতরে।
মানুষ মরলে, ফুরিয়ে যায়।
ব্যস, খতম।
অথচ এখন ওয়ালেনস্টাইন প্যালেসের সুসজ্জিত বাগানগুলোর ওপর দিয়ে ভেসে যেতে যেতে নিজেকে ওর দিব্যি জীবন্ত মনে হচ্ছে। দেখতে পাচ্ছে: বরফ পড়ছে তার চারপাশে...নাকি সোজা শরীরের ভেতর দিয়ে? অথচ অদ্ভুত ব্যাপার, একটুও শীত লাগছে না! মনে হচ্ছে, মনটা যেন সব যুক্তি আর বুদ্ধিসহ ভেসে বেড়াচ্ছে শূন্যে।
মাথাটা কাজ করছে, নিজেকে শোনাল সে। তার মানে আমি বেঁচে আছি।
অনেক ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে পারল গেসনার। সে এখন এমন এক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ডাক্তারি শাস্ত্রে যাকে বলে ওবিই; অর্থাৎ, আউট-অভ-বডি এক্সপেরিয়েন্স। ক্লিনিক্যালি ডেড বা মৃত ঘোষণার পর কোনো মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচিয়ে তোলা হলে তার মধ্যে এই ভ্রমটা দেখা যায়।
ওবিইয়ের লক্ষণগুলো সব ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম হয়: মনটা বুঝি কিছুক্ষণের জন্যে শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে; ওপরের দিকে উঠে আকারহীন, ওজনহীনভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে শূন্যে।
অভিজ্ঞতাটাকে যতই বাস্তব মনে হোক, ওবিই আসলে পুরোপুরি কাল্পনিক ভ্রমণ। সাধারণত প্রচণ্ড মানসিক চাপ, মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব, কিংবা কখনও কখনও ইমার্জেন্সি রুমে ব্যবহৃত কেটামিনের মতো চেতনানাশকের প্রভাবে ঘটে এই ব্যাপারটা।
এসবই আমার ভ্রম, মনের জন্ম দেওয়া দৃশ্য, শহরের বুক চিরে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলা ভলটাভা নদীর অন্ধকার বাঁকের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আশ্বস্ত করল গেসনার। কিন্তু সত্যিই যদি ওবিই হয়ে থাকে...তাহলে তো...আমি মরতে বসেছি!
এতকিছুর পরও নিজের এই শান্ত ভাবটা দেখে অবাক হলো গেসনার। মনে করার চেষ্টা করল, কী হয়েছিল তার।
আমি ঊনপঞ্চাশ বছরের একজন সুস্থ-সবল নারী...আমি কেন মরতে যাব?
হঠাৎ যেন চোখধাঁধানো ঝলকানির সাথে ভয়ংকর এক স্মৃতি ভেসে উঠল গেসনারের মনে। এবার মনে পড়ল, ঠিক এই মুহূর্তে তার শরীরটা কোথায় পড়ে আছে! আর তার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার হলো...
...কী করা হচ্ছে সেই শরীরটাকে নিয়ে!
শেষ স্মৃতি যদ্দূর মনে পড়ে, চিত হয়ে শুয়ে ছিল সে, নিজেরই বানানো একটা যন্ত্রের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। মাথার ওপর ঝুঁকে ছিল এক দানব, দেখতে আদিম কোনো গুহামানবের মতো; মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে যেন। মুখ আর কেশহীন মাথা নোংরা কাদামাটির পুরু আস্তরণে ঢাকা; পুরোটা চাঁদের পিঠের মতো এবড়োখেবড়ো, ফাটলে ভরা। মাটির মুখোশের আড়াল থেকে কেবল ঘৃণাভরা চোখ দুটোই দেখা যাচ্ছে শুধু। কপালে খোদাই করা প্রাচীন কোনো ভাষার তিনটে অক্ষর।
'কেন করছ এসব?!' আতঙ্কে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল গেসনার। 'কে তুমি?!'
আসলে জিজ্ঞেস করতে হতো: তুমি আসলে কী?!
'আমি তার রক্ষক,' ফাঁপা শোনাচ্ছিল দানবের উত্তর, কথায় স্লাভিক টান। 'বেচারি তোমাকে বিশ্বাস করেছিল...আর তুমি তার বদলে উপহার দিয়েছ বিশ্বাসঘাতকতা।'
'কার কথা বলছ?!' জানতে চেয়েছিল গেসনার।
এক মেয়ের নাম উচ্চারণ করেছিল দানবটা। সেই নামটা শুনতেই ধড়াস করে ওঠে গেসনারের বুকটা।
আমি কী করেছি...তা এই লোক জানল কী করে?!
আচমকা বাহুতে বরফঠান্ডা একটা ভার অনুভব করল গেসনার। বুঝতে পারল, মেশিন চালু করে দিয়েছে দানবটা। পরক্ষণেই বাঁ হাতে সুচের মতো বিঁধল অসহ্য এক যন্ত্রণা। ব্যথাটা শিরা বেয়ে এগোতে লাগল কাঁধের দিকে, যেন ধারালো নখ দিয়ে শরীরটা চিরে দিচ্ছে কেউ। 'দয়া করো...থামো...' গোঙাতে গোঙাতে বলল সে।
'সব কিছু খুলে বলো আমাকে,' গর্জে উঠল দানবটা। ততক্ষণে অসহ্য অসহনীয় সেই যন্ত্রণা গেসনারের বগলের কাছে পৌঁছে গেছে।
'বলছি! সব বলছি!' মরিয়া হয়ে রাজি হলো গেসনার। প্রত্যুত্তরে মেশিন থামাল দানব। কাঁধের কাছে এসে থেমে গেল ব্যথা, কিন্তু তীব্র জ্বালাটা রয়েই গেল।
তীব্র আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে, দাঁতে দাঁত চেপে গড়গড় করে সব বলে গেল গেসনার...যে গোপন কথাগুলো কখনও ফাঁস করবে না বলে শপথ করেছিল, সব উগরে দিল উন্মত্তের মতো। দানবের সব প্রশ্নের উত্তর দিল, জানিয়ে দিল—সঙ্গীদের সাথে মিলে কী ভয়ংকর জিনিস সে তৈরি করেছে প্রাগের মাটির নিচে।
পুরু কাদার মুখোশের আড়াল থেকে দানব তাকিয়ে রইল তার দিকে, হিমশীতল চোখে ফুটে উঠেছে ঘৃণা...আর সব বুঝে ফেলার ক্রূর ঝিলিক।
'তোমরা তাহলে মাটির নিচে একটা বিভীষিকার কারখানা বানিয়েছ,' ফিসফিস করে বলল লোকটা। 'তোমাদের সবার মরা উচিত।' একমুহূর্ত দ্বিধা না করে আবার মেশিনটা চালু করে সে পা বাড়াল দরজার দিকে।
'না...' নতুন করে যন্ত্রণাটা কাঁধ পেরিয়ে বুকে ছড়িয়ে পড়তেই গলা ফাটিয়ে আর্তচিৎকার করে উঠল গেসনার। 'প্লিজ, আমাকে ফেলে যেয়ো না...আমি মরে যাবো!'
'ঠিক বলেছ,' শুধু ঘাড়টা ফিরিয়ে বলল লোকটা। 'কিন্তু মৃত্যুই শেষ কথা নয়। আমিই বহুবার মরেছি।'
এই বলে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল দানবটা, গেসনার দেখল—অকস্মাৎ শূন্যে ভাসছে সে আবার। প্রাণভিক্ষা চেয়ে চিৎকার করতে গেল মহিলা, কিন্তু কানফাটানো এক বজ্রপাতের আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে গেল সেই আকুতি। মনে হলো যেন মাথার ওপরের আকাশটা চিরে দুভাগ হয়ে গেছে। অদৃশ্য এক শক্তি আঁকড়ে ধরল গেসনারকে—একরকম উলটো-মাধ্যাকর্ষ—আরও ওপরে, আরও উঁচুতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলল তাকে।
রোগীদের মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসার গালগল্প শুনে, ড. ব্রিজিটা গেসনার হেসে উড়িয়ে দিয়েছে বছরের পর বছর। অথচ এখন সে নিজেই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছে ওইসব বিরল সৌভাগ্যবানদের তালিকায় নাম তোলার জন্যে, যারা ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়ে নেচেছে, উঁকি দিয়েছে অতল গহ্বরে; তারপর অলৌকিকভাবে ফিরে আসতে পেরেছে সেই খাদের কিনারা থেকে।
যেকোনো উপায়ে মৃত্যুকে ফাঁকি দিতেই হবে, সাবধান করতে হবে অন্যদের!
কিন্তু এ-ও জানে, বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
এ জীবনের পর্দা নামতে যাচ্ছে এখানেই...এখনই।
এক
বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ফোনের অ্যালার্মে—ক্লাসিক্যাল মিউজিকের হালকা সুর—ঘুম ভেঙে গেল রবার্ট ল্যাংডনের। বেশ ফুরফুরে লাগছে শরীর-মন, গ্রেগের 'মর্নিং মুড' গানটার মতোই। অ্যালার্মের হিসেবে হয়তো বেশ মামুলি, কিন্তু দিনের শুরু হিসেবে ল্যাংডনের কাছে এই চার মিনিটের গানের চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। সুরটা তুঙ্গে উঠতেই আয়েশ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। কোথায় আছে, এখনও ঠিক মনে করতে পারছে না। চোখ বন্ধ করে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে মনে করতে না পারার এই দোলাচলটা!
ও হ্যাঁ, ধীরে ধীরে মনে পড়ল সব। আপনমনেই মনেই মুচকি হাসল সে। শত মিনারের শহর।
ভোরের আবছা আলোয় ঘরের বিশাল খিলানওলা জানালাটা দেখতে লাগল ল্যাংডন। ওটার একপাশে এডওয়ার্ডিয়ান ড্রেসার, আরেকপাশে অ্যালাবাস্টারের ল্যাম্প। হাতে বোনা বিলাসি কার্পেটের ওপর এখনও ছড়িয়ে আছে গোলাপের পাপড়ি। হোটেলের পক্ষ থেকে গতরাতের বিশেষ সৌজন্যের প্রমাণ।
তিন দিন হলো প্রাগে এসেছে ল্যাংডন। আগেরবারের মতোই এবারও উঠেছে ফোর সিজনস হোটেলে। সবসময়ই এখানে ওঠে। এবার হোটেল ম্যানেজার যখন প্রায় জোর করেই ল্যাংডনের রিজার্ভেশনটা তিন বেডরুমের রয়্যাল স্যুইটে আপগ্রেড করে দিল, তখন দুটো প্রশ্ন জেগেছিল ওর মনে। এক, এই হোটেল তার প্রতি একটু বেশিই সদয়? নাকি, দুই, খ্যাতনামা সঙ্গিনীর সম্মানে জুটেছে এই সৌভাগ্য?
'আমাদের সবচেয়ে বিখ্যাত অতিথিরা যদি সেরা সেবা না পায়, তাহলে পাবেটা কে?' জোর দিয়ে বলেছিল ম্যানেজার।
স্যুইটটায় তিনটে আলাদা বেডরুম, সাথে তিনটে অ্যাটাচড বাথ। একটা বসার ঘর, একটা খাবার ঘর, আর আছে একখানা গ্র্যান্ড পিয়ানো আর মাঝখানের একটা বে উইন্ডো। সেই জানালায় লাল, সাদা আর নীল টিউলিপ ফুলের তোড়া সাজানো—আমেরিকান দূতাবাস থেকে পাঠানো স্বাগত উপহার। ল্যাংডনের প্রাইভেট ড্রেসিংরুমে একজোড়া ব্রাশ করা উলের চপ্পলও রাখা, তাতে মনোগ্রাম করা দুটো আদ্যাক্ষর: আরএল। ল্যাংডন ভাবল, এই আরএল নিশ্চয় রালফ লরেন নয়। এমন নিখুঁত ব্যক্তিগত ছোঁয়া দেখে বেশ মুগ্ধ সে।
বিছানায় শুয়ে বিলাসী ভঙ্গিতে অ্যালার্মের সুর শুনছে, সহসা একটা পেলব হাতের ছোঁয়া টের পেল কাঁধে।
'রবার্ট?' কানে এলো একটা নরম ফিসফিসানি।
পাশ ফিরল ল্যাংডন। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল হৃৎস্পন্দনের গতি। পাশেই শুয়ে আছে মেয়েটা, হাসছে। ধোঁয়াটে ধূসর চোখ দুটো এখনও ঘুমের আবেশে ঢুলুঢুলু। লম্বা কালো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে কাঁধের ওপর।
'গুড মর্নিং, সুন্দরী,' জবাব দিল ল্যাংডন।
হাত বাড়িয়ে আলতো করে ওর গাল ছুঁয়ে দিল রমণী, কবজিতে তখনও লেপটে রয়েছে মনমাতানো ব্যালাড সভাজ পারফিউমের সুবাস।
মুগ্ধ চোখে ওই কমনীয় মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ল্যাংডন। বয়সে ওর চেয়ে চার বছরের বড়ো হলেও, প্রতিবারই এই নারীকে আগের চেয়েও মোহনীয় লাগে। মুখের চারপাশে খানিকটা গভীর ভাঁজ, কালো চুলে রুপালি রেখার আভাস, দুষ্টুমিভরা দুটো চোখ আর মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়া তীক্ষ্ণ মেধা।
এই অসাধারণ নারীর সাথে ল্যাংডনের পরিচয় সেই প্রিন্সটনের সময় থেকে। তখন ল্যাংডন ছিল স্নাতকের ছাত্র, আর মেয়েটি ছিল তরুণী অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। তার প্রতি ল্যাংডনের যে একটা স্কুলবালকসুলভ মুগ্ধতা আর ভালোলাগা ছিল, সেটা হয়তো মেয়েটির চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল...কিংবা কে জানে, হয়তো পাত্তা দেয়নি। তবে দুজনের বন্ধুত্বটা ছিল একেবারে নিখাদ। পেশাগত জীবনে মেয়েটা যখন সাফল্যের শিখরে পৌঁছাল, আর ল্যাংডনও যখন বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেল, তখনও দেখা গেল—নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে দুজনে।
সবই সময়ের খেল, এখন বুঝতে পারছে ল্যাংডন। এই আকস্মিক সফরের মাঝে যে ওরা এত দ্রুত একে-অপরের প্রেমে হাবুডুবু খাবে, কল্পনাও করতে পারেনি। ভাবতেই অবাক লাগছে এখন।
মর্নিং মুডের সুরটা যখন পূর্ণ অর্কেস্ট্রার মূর্ছনায় তুঙ্গে উঠল, শক্ত হাতে তখন ওকে কাছে টেনে নিলো ল্যাংডন। সে-ও মুখ গুঁজে দিল প্রেমিকের বুকে। 'ঘুম ভালো হয়েছে?' ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ল্যাংডন। 'আর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখনি তো?'
মাথা নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটা। 'আমার না ভীষণ লজ্জা করছে। কী জঘন্য স্বপ্ন ছিল ওটা!'
রাতে ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল সে। ল্যাংডন ঘণ্টাখানেক জড়িয়ে ধরে রাখার পর শেষতক আবার ঘুমোতে পেরেছে। ল্যাংডন তাকে বুঝিয়েছিল, স্বপ্নের এই অস্বাভাবিক তীব্রতার কারণ আসলে ঘুমোনোর আগে খাওয়া বোহেমিয়ান অ্যাবসিন্থ। ল্যাংডনের বরাবরই মনে হয়, এই পানীয়টার সাথে একটা সতর্কবার্তা জুড়ে দেয়া উচিত: 'ইউরোপের স্বর্ণযুগে হ্যালুসিনেশন ঘটানোর ক্ষমতার জন্য কুখ্যাতি ছিল এই মদের'।
'আর কক্ষনো খাব না,' ল্যাংডনকে আশ্বস্ত করল সে।
হাত বাড়িয়ে গান বন্ধ করে দিল ল্যাংডন। 'চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। আমি নাস্তার আগেই ফিরে আসব।'
'আমার কাছে থাকো,' ছলনাময়ীর মতো ওকে জড়িয়ে ধরল রমণী। 'একদিন সাঁতার না কাটলে কিছু হবে না।'
'যদি চাও তোমার এই তরুণ সঙ্গীর শরীরটা এমন ছিপছিপে থাকুক, তাহলে তো যেতে দিতেই হবে,' বাঁকা হাসি দিয়ে উঠে বসল ল্যাংডন।
রোজ সকালে তিন কিলোমিটার জগিং করে সে স্ত্রাহভ সুইমিং সেন্টারে যায় সাঁতার কাটতে।
'বাইরে এখনও অন্ধকার,' জেদ ধরল সঙ্গিনী। 'এখানেই সাঁতার কাটলে ক্ষতি কী?'
'হোটেলের পুলে?'
'অসুবিধা কী? ওটাও তো পানি।'
'বড্ড ছোটো। দুইবার শরীর দোলালেই শেষ!'
'চাইলে কথাটা ভিন্নার্থে ব্যবহার করা যায়, রবার্ট। তবে সেদিকে আর গেলাম না।'
হাসল ল্যাংডন। 'ভারি মজার মেয়ে তো তুমি। ঘুমাও, ব্রেকফাস্টে দেখা হবে।'
গাল ফুলিয়ে ল্যাংডনের দিকে একটা বালিশ ছুড়ে মেরে পাশ ফিরে শুলো সঙ্গিনী।
হার্ভার্ডের দেয়া ফ্যাকাল্টি সোয়েটশার্ট গায়ে চাপিয়ে দরজার দিকে এগোল ল্যাংডন। স্যুইটের দমবন্ধ করা প্রাইভেট লিফটের চেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামাই ভালো মনে হলো ওর।
নিচে নেমে নদীর ধারে তৈরি হোটেলের বারোক স্থাপত্যশৈলীর অ্যানেক্স বিল্ডিং থেকে মূল লবিতে যাবার অভিজাত হলওয়ে ধরে হনহন করে হেঁটে চলল সে। যাওয়ার পথে চোখে পড়ল 'প্রাগ হ্যাপেনিংস' লেখা একটা সুন্দর ডিসপ্লে কেস। ভেতরে ফ্রেমে বাঁধানো সারি সারি পোস্টার: এই সপ্তাহের কনসার্ট, ট্যুর আর লেকচারের ঘোষণা। মাঝখানের চকচকে পোস্টারটা দেখে হাসি ফুটে উঠল ল্যাংডনের মুখে।
চার্লস ইউনিভার্সিটি লেকচার সিরিজ
প্রাগ ক্যাসলে স্বাগত জানাচ্ছে
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নোয়েটিক বিজ্ঞানী
ড. ক্যাথেরিন সলোমনকে
গুড মর্নিং, সুন্দরী, নিজের মনেই আওড়াল ল্যাংডন। যে মহিলাকে সে খানিক আগে চুমু খেয়ে এসেছে, তার ছবিটার তারিফ করল মনে মনে।
ক্যাথেরিনের গত রাতের লেকচারটা জমজমাট ছিল। এত লোক হয়েছিল যে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ব্যাপারটা মোটেও হেলাফেলার নয়। কারণ ও লেকচার দিয়েছে প্রাগ ক্যাসলের কিংবদন্তিতুল্য ভ্লাদিস্লাভ হলে। রেনেসাঁ যুগে এই বিশাল, খিলান দেওয়া হলঘর ব্যবহার করা হতো নাইটদের মল্লযুদ্ধের জন্য। বর্ম পরা নাইটরা ঢাল-তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে রীতিমতো লড়াই করত এখানে!
লেকচার সিরিজটা ইউরোপের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আয়োজন। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে সেরা বক্তা আর উৎসুক শ্রোতারা আসেন এখানে। কাল রাতেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ক্যাথেরিনের নাম ঘোষণা করতেই করতালিতে ফেটে পড়ল গোটা হল।
'ধন্যবাদ সবাইকে,' ধীর পদক্ষেপে মঞ্চে উঠে বলেছিল ক্যাথেরিন, প্রশান্ত চেহারায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ। পরনে সাদা কাশ্মীরি সোয়েটার আর নিখুঁত ফিটিংয়ের ডিজাইনার স্ল্যাক্স। 'আজকের আলোচনা একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করতে চাই। এই প্রশ্নটা আমাকে প্রায় প্রতিদিনই শুনতে হয়।' ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক খেলে গেল তার। এরপর স্ট্যান্ড থেকে মাইক্রোফোনটা খুলে নিয়ে বলল: 'এই নোয়েটিক সায়েন্স জিনিসটা আসলে কী?!'
শ্রোতাদের মধ্যে হাসির রোল উঠল ওর বলার ভঙ্গিতে। জাঁকিয়ে বসল সবাই, উৎকর্ণ।
'সহজ কথায় বলতে গেলে,' ক্যাথেরিন শুরু করল, 'নোয়েটিক সায়েন্স হলো মানুষের চেতনা নিয়ে গবেষণা। অনেকের ধারণা এ বুঝি নতুন কোনো বিজ্ঞান! কিন্তু আসলে তা নয়। সত্যি বলতে কী, নোয়েটিক সায়েন্সকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিজ্ঞান বললেও অত্যুক্তি হবে না। ইতিহাসের শুরু থেকে মানুষ তার মন-রহস্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। চেতনা আর আত্মার স্বরূপ কী, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছি আমরা। আর শত শত বছর ধরে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা খুঁজেছি মূলত ধর্মের চশমা চোখে দিয়ে।'
এইটুকু বলে মঞ্চ থেকে নেমে এলো ক্যাথেরিন। সোজা এগিয়ে গেল সামনের সারিতে বসে থাকা শ্রোতাদের দিকে। 'ধর্মের কথা যখন উঠলই, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, তখন একটা কথা না বলে পারছি না। আজ আমাদের মাঝে একজন বিখ্যাত মানুষ উপস্থিত আছেন। উনি হলেন ধর্মীয় প্রতীকবিদ্যা—রিলিজিয়াস সিম্বোলজির বিখ্যাত গবেষক—প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন।'
কথাটা কানে যেতেই উত্তেজিত চাপা গুঞ্জন উঠল দর্শকদের মধ্যে, টের পেল ল্যাংডন।
কী শুরু করল মেয়েটা!
'প্রফেসর,' হাসিমুখে ল্যাংডনের সামনে এসে দাঁড়াল ক্যাথেরিন। 'আপনার জ্ঞান থেকে আমরা কি একটু উপকৃত হতে পারি? একটু কষ্ট করে আসবেন?'
ভদ্রভাবে উঠে দাঁড়াল ল্যাংডন। কিন্তু মুখ টিপে হাসছে, যার অর্থ: 'ইট মেরেছ, পাটকেল কিন্তু পরে খেতেই হবে, সোনা।'
'একটা জিনিস জানতে চাইছি, প্রফেসর: পৃথিবীর সবচেয়ে প্রচলিত ধর্মীয় প্রতীক কোনটা?'
জবাবটা সহজ। ক্যাথেরিন হয়তো এই বিষয়ে ল্যাংডনের লেখাটা পড়েছে, তাই জানে কী উত্তর পাবে। যদি পড়ে না থাকে, তাহলে বড্ড হতাশ হতে হবে!
মাইক্রোফোনটা নিলো ল্যাংডন। প্রাচীন লোহার শেকলে ঝুলন্ত ঝাড়বাতির আবছা আলোয় তাকাল উৎসুক মুখগুলোর দিকে। 'গুড ইভনিং,' স্পিকারে গমগম করে উঠল ওর মন্দ্রকণ্ঠ। 'আর ধন্যবাদ ড. সলোমনকে, বিনা নোটিশে আমাকে এমন ফাঁদে ফেলার জন্য।'
হাততালি দিল শ্রোতারা।
'আচ্ছা, শুরু করা যাক তাহলে,' বলল ল্যাংডন। 'পৃথিবীর সবচেয়ে প্রচলিত ধর্মীয় প্রতীক কোনটা, তাই তো? কেউ আন্দাজ করতে পারবেন?'
সাথে সাথে ডজনখানেক হাত ওপরে উঠে গেল।
'চমৎকার!' তারিফের সুরে বলল ল্যাংডন। 'ক্রুশ ছাড়া আর কোনো উত্তর দিতে পারবেন কেউ?'
ব্যস, নেমে গেল সবকটা হাত।
মুচকি হাসল ল্যাংডন। 'ক্রুশ অতি পরিচিত, অতি প্রচলিত একটা প্রতীক, এতে কোনো সন্দে নেই। কিন্তু ওটা কেবল খ্রিস্টানদের প্রতীক। কিন্তু এমন একটা সর্বজনীন প্রতীক আছে, যা পৃথিবীর প্রত্যেকটা ধর্মের শিল্পকর্মে পাওয়া যায়।'
শ্রোতারা অবাক হয়ে একে-অপরের মুখের দিকে তাকাল।
'আপনারা সবাই বহুবার দেখেছেন ওটা,' আরেকটু তথ্য দিল ল্যাংডন। 'মনে করে দেখুন, হয়তো মিশরের হোরাখ্তি স্টেলায় দেখেছেন?'
কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল সে।
'বৌদ্ধদের কণিষ্ক সিন্দুকে? অথবা বিখ্যাত ক্রাইস্ট প্যান্টোক্রেটরে?'
কোনো সাড়াশব্দ নেই। বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই।
বাপ রে, ভাবল ল্যাংডন। এরা যে খাঁটি বিজ্ঞানের লোক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
'রেনেসাঁ যুগের শত শত বিখ্যাত চিত্রকর্মেও দেখা মেলে প্রতীকটার: লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চির সেকেন্ড ভার্জিন অভ দ্য রকস, ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকোর দি অ্যানানসিয়েশন, জিয়োত্তোর ল্যামেন্টেশন, টিশানের টেম্পটেশন অভ ক্রাইস্ট, আর ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ডের অসংখ্য চিত্রকর্মে...?'
তবু কোনো সাড়াশব্দ নেই।
'আমি যে প্রতীকটার কথা বলছি,' বলল ল্যাংডন, 'সেটা হলো হেইলো—জ্যোতির্বলয়।' হাসল ক্যাথেরিন। দেখেই বোঝা গেল, উত্তরটা তার জানা ছিল।
'এই হেইলো বা জ্যোতির্বলয় হলো একটা আলোর চাকতি। দিব্যজ্ঞানপ্রাপ্ত মানুষের মাথার ওপর এ জিনিস ভাসতে দেখা যায়,' ল্যাংডন বলে চলল। 'খ্রিস্টধর্মে যিশু, মেরি আর সাধুসন্তদের মাথার ওপর দেখা যায় বলয়টাকে। আরও পেছনে গেলে, প্রাচীন মিশরের দেবতা রা-এর মাথার ওপরেও দেখা যেত সূর্যচাকতি। আর প্রাচ্যের ধর্মগুলোতে বুদ্ধ এবং হিন্দু দেবদেবীদের মাথায় দেখা যায় নিমবাস হেইলো।'
'অসাধারণ। ধন্যবাদ, প্রফেসর,' মাইক্রোফোন নেবার জন্য হাত বাড়াল ক্যাথেরিন। কিন্তু ল্যাংডন তাকে পাত্তা না দিয়ে একটু সরে দাঁড়াল, নিয়ে নিলো মধুর প্রতিশোধ। ইতিহাসবিদকে কোনো প্রশ্ন করলে তার পুর্ণাঙ্গ জবাব না পাওয়া পর্যন্ত প্রশ্নকারী নিস্তার পায় না।
হাসির রোল উঠল শ্রোতাদের মধ্যে। ল্যাংডন বলে চলল: 'একটা কথা বলে রাখা ভালো—এই বলয় অনেক আকার, আকৃতি আর শৈল্পিক রূপে পাওয়া যায়। কিছু আছে নিরেট সোনার চাকতির মতো, কিছু স্বচ্ছ; আবার কিছু চারকোনাও হয়। ইহুদিদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে মোজেসের মাথাকে ঘিরে থাকা "হিলা" নামে এক ধরনের আলোর চাকতির বর্ণনা রয়েছে। হিব্রু ভাষায় হিলা অর্থ "জ্যোতির্বলয়" বা "আলোর বিচ্ছুরণ"। কিছু বিশেষ ধরনের হেইলো থেকে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। সেগুলো উজ্জ্বল কাঁটার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।'
মুখে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে ক্যাথেরিনের দিকে ফিরল ল্যাংডন।
'ড. সলোমন হয়তো বলতে পারবেন, এই বিশেষ ধরনের হেইলোর নাম কী?' মাইক্রোফোনটা এগিয়ে দিল ক্যাথেরিনের দিকে।
'রেডিয়েন্ট ক্রাউন,' ক্যাথেরিনের ত্বরিত জবাব।
তাহলে পড়াশোনাটা করা হয়েছে বটে, ভাবল ল্যাংডন। মাইক্রোফোনটা আবার মুখের কাছে এনে বলল, 'সঠিক উত্তর। রেডিয়েন্ট ক্রাউন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতীক। ইতিহাসের শুরু থেকে হোরাস, হেলিয়োস, টলেমি, সিজারের মতো বিখ্যাত মানুষের মাথায় তার দেখা মিলেছে। এমনকি সুবিশাল রোডস কলোসাসের মাথায়ও দেখা গেছে ওই জিনিস।'
দর্শকদের দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিল ল্যাংডন। 'এই তথ্যটা খুব বেশি মানুষ জানে না। গোটা নিউ ইয়র্ক সিটির সবচেয়ে বেশি ছবি তোলা হয় যে বস্তুটার, ওটা...একটা রেডিয়েন্ট ক্রাউন!'
সবার চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়, এমনকি ক্যাথেরিনের চোখেও।
'কেউ আন্দাজ করতে পারছেন?' জিজ্ঞেস করল সে। 'আপনারা কেউ নিউ ইয়র্ক হারবারের তিনশো ফুট ওপরে থাকা ওই রেডিয়েন্ট ক্রাউনের ছবি তোলেননি?'
অপেক্ষা করতে লাগল ল্যাংডন, গুঞ্জনটা বাড়তে দিল দর্শকদের মাঝে।
'স্ট্যাচু অভ লিবার্টি!' ভিড়ের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলল কেউ একজন।
'একদম ঠিক,' বলল ল্যাংডন। 'স্ট্যাচু অভ লিবার্টির মাথায় আছে জ্যোতির্বলয়—একটা প্রাচীন হেইলো। এমন এক সর্বজনীন প্রতীক, যেটা আমরা ইতিহাসের শুরু থেকে ব্যবহার করে আসছি সেইসব বিশেষ মানুষদের চিহ্নিত করতে, যাদের মাঝে আমরা ঐশ্বরিক ক্ষমতা...বা চেতনার উন্নত স্তরের সন্ধান পাই।'
মাইক্রোফোনটা ক্যাথেরিনের হাতে ধরিয়ে দিল ল্যাংডন। খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল ক্যাথেরিনের চেহারা। ধন্যবাদ, নিঃশব্দে ঠোঁট নেড়ে বলল সে। শ্রোতাদের করতালি আর প্রশংসার মাঝে নিজের আসনে ফিরে গেল ল্যাংডন।
আবার মঞ্চে উঠে এলো ক্যাথেরিন। 'প্রফেসর ল্যাংডনের অসাধারণ বক্তব্য থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হলো: মানুষ বহুকাল ধরেই চেতনা নিয়ে ভাবছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এসেও আমরা সেটার সঠিক সংজ্ঞা বের করতে হিমশিম খাচ্ছি। সত্যি বলতে কী, অনেক বিজ্ঞানী তো চেতনা নিয়ে কথা বলতেই ভয় পান।' ক্যাথেরিন চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, 'তারা "চ-বর্গীয়" গালি পর্যন্ত বকে বসেন!'
আবারও চাপা হাসির ঢেউ বয়ে গেল ঘরজুড়ে।
সামনের সারিতে বসা এক চশমা পরা মহিলার দিকে ইশারা করল ক্যাথেরিন। 'ম্যাডাম, আপনি চেতনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?'
একমুহূর্ত ভাবল মহিলা। 'নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা...?'
'চমৎকার,' তারিফ করল ক্যাথেরিন। 'আর এই সচেতনতা আসে কোত্থেকে?'
'আমার মস্তিষ্ক থেকে, সম্ভবত,' জবাব দিল মহিলা। 'আমার চিন্তা, ভাবনা, কল্পনা...মস্তিষ্কের যেসব কার্যকলাপই আমাকে এই আমি বানিয়েছে।'
'খুব সুন্দর বলেছেন, ধন্যবাদ।' ফের শ্রোতাদের দিকে তাকাল ক্যাথেরিন। 'তাহলে আমরা কি কিছু মূল বিষয়ে একমত হতে পারি? চেতনার সৃষ্টি হয় আমাদের মস্তিষ্কে—খুলির ভেতরে থাকা তিন পাউন্ড ওজনের ছিয়াশি বিলিয়ন নিউরনের জট থেকে। সুতরাং, চেতনা থাকেও আমাদের মাথার ভেতরেই।'
মাথা দুলিয়ে সায় দিল সবাই।
'চমৎকার,' বলল ক্যাথেরিন। 'আমরা সবাই মানব চেতনার বর্তমান প্রচলিত মডেলটার সাথে একমত হলাম।' একটু থেমে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। 'কিন্তু সমস্যাটা হলো...বর্তমানে প্রচলিত এই মডেলটা আগাগোড়া ভুল! আপনার চেতনা মোটেই মস্তিষ্কের সৃষ্টি নয়। সত্যি বলতে কী, আপনার চেতনা আপনার মাথার ভেতরেই থাকে না।'
পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে এলো ঘরজুড়ে। সবাই স্তম্ভিত।
সামনের সারির সেই চশমা পরা মহিলা বলল, 'কিন্তু...আমার চেতনা যদি আমার মাথার ভেতরে না থাকে...তাহলে ওটা আছে কোথায়?'
'খুব খুশি হলাম আপনার প্রশ্নটা শুনে,' শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে হাসল ক্যাথেরিন। 'আরাম করুন বসুন সবাই। আজ রাতে রোলার কোস্টারে চড়তে যাচ্ছি আমরা।'
ওস্তাদের মার, লবির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল ল্যাংডন। এখনও কানে বাজছে ক্যাথেরিনের জন্য দর্শকদের দেওয়া সেই স্ট্যান্ডিং ওভেশন। কান ফাটার দশা হয়েছিল করতালির আওয়াজে। ওর প্রেজেন্টেশনটা ছিল অসাধারণ, ঝড় তুলে দিয়েছিল রীতিমতো। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল দর্শকরা, মুখে কথা সরছিল না, কিন্তু আরও কিছু শোনার জন্য ছটফট করছিল ভেতরে ভেতরে। নতুন কী নিয়ে কাজ করছে, একজন সে প্রশ্ন করতেই ক্যাথেরিন জানাল: সদ্যই একটা বইয়ের কাজ শেষ করেছে সে। আশা করছে, চেতনার বর্তমান ধারণার সংজ্ঞা বদলে দিতে বইটা কাজে আসবে।
ক্যাথেরিনকে বইটা ছাপানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে ল্যাংডনই, যদিও পাণ্ডুলিপিটা এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি ওর। বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে যতটুকু আভাস দিয়েছে ক্যাথেরিন, তাতেই ওটা পড়ার জন্যে মুখিয়ে আছে ও। কিন্তু ওর মন বলছে, সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্যগুলো ক্যাথেরিন নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে। ক্যাথেরিন সলোমন পারেও বটে! ওর ঝুলিতে চমকের অভাব হয় না কখনও।
এখন হোটেলের লবির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ ল্যাংডনের মনে পড়ল, ক্যাথেরিনের আজ সকাল আটটায় ড. ব্রিজিটা গেসনারের সাথে দেখা করার কথা। প্রখ্যাত এই চেক নিউরোসায়েন্টিস্টই ক্যাথেরিনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে লেকচার সিরিজে বক্তৃতা দিতে। গেসনারের আমন্ত্রণটা বেশ আন্তরিক ছিল, কিন্তু কাল রাতে অনুষ্ঠানের পর মহিলার সাথে আলাপ করে তাকে চূড়ান্ত অসহ্য মনে হয়েছে ল্যাংডনের। তাই ল্যাংডন এখন মনে মনে চাইছে, ক্যাথেরিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে ফেলুক, তারপর মিটিং বাদ দিয়ে নাস্তা করতে চলে আসুক ওর সাথে।
ভাবনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে লবিতে ঢুকল সে। প্রবেশপথে সবসময় দামি গোলাপের তোড়া সাজানো থাকে, ওটার মিষ্টি সুবাস নাকে আসতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। কিন্তু লবিতে পা রাখতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তা মোটেই সুখকর মনে হলো না।
কালো পোশাক পরা দুজন পুলিস অফিসার সতর্ক পদক্ষেপে পায়চারি করছে খোলা জায়গাটায়। সাথে দুটো জার্মান শেফার্ড। কুকুর দুটোর গায়ে চেক ভাষায় 'পুলিস' লেখা বুলেটপ্রুফ ভেস্ট। শুঁকে শুঁকে কী যেন খুঁজছে প্রাণী দুটো।
ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। ফ্রন্ট ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেল ল্যাংডন। 'সব ঠিক আছে তো?'
'ওহ, হ্যাঁ, মি. ল্যাংডন!' প্রায় কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে ওকে অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে এলো পরিপাটি পোশাক পরা ম্যানেজার। 'সব ঠিক আছে, প্রফেসর। কাল রাতে একটা ছোটোখাটো সমস্যা হয়েছিল, কিন্তু পরে দেখা গেল—ওটা নিছক ভুল বোঝাবুঝি,' মাথা নেড়ে আশ্বাস দিল সে। 'স্রেফ সাবধানতার জন্য এই ব্যবস্থা। আপনি তো জানেনই, ফোর সিজনস প্রাগে নিরাপত্তাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।'
পুলিসের লোকগুলোর দিকে তাকাল ল্যাংডন। ছোটোখাটো সমস্যা? হাবভাব দেখে তো ব্যাপারটাকে মোটেই ছোটোখাটো মনে হচ্ছে না।
'আপনি কি সুইমিং ক্লাবে যাচ্ছেন, স্যার?' ম্যানেজার জিজ্ঞেস করল। 'একটা গাড়ি ডেকে দেব?'
'না, ধন্যবাদ,' দরজার দিকে এগোতে এগোতে জবাব দিল ল্যাংডন। 'আমি দৌড়েই যাব। ভোরের তাজা হাওয়াটা ভালো লাগে।'
'কিন্তু বাইরে তো বরফ পড়ছে!'
বাইরে তাকাল নিউ ইংল্যান্ডের সন্তান রবার্ট ল্যাংডন। বাতাসে হালকা বরফের কুচি উড়তে দেখে ম্যানেজারের দিকে ফিরে হাসল। 'এক ঘণ্টার মধ্যে না ফিরলে ওই কুকুরগুলোর একটাকে পাঠিয়ে দেবেন আমাকে খুঁজে বের করতে।'