হিটলারের ভয়ংকর শুল্কনীতির পাগলা ঘোড়া: জার্মান অর্থনীতিকে যা খাদের দিকে দাবড়ে নিল
বৈশ্বিক ব্যবস্থার কথিত জোয়াল থেকে জার্মানিকে 'মুক্ত' করার চেষ্টা করতে গিয়ে নাজি সরকার দেশটির জাতীয় অর্থনীতিকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়। দ্য আটলান্টিকে 'হিটলারস টেরিবল ট্যারিফস' শীর্ষক প্রবন্ধে এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন টিমথি ডব্লিউ রেব্যাক। হিটলারের জার্মানি নিয়ে বেশ কিছু বইয়ের লেখক, ইতিহাসবিদ, ইনস্টিটিউট ফর হিস্টোরিক্যাল জাস্টিস অ্যান্ড রিকনসিলেশনের পরিচালক টিমথি ডব্লিউ রেব্যাক। তার অতি সাম্প্রতিক বই 'টেকওভার: হিটলারস ফাইনাল রাইজ ইন পাওয়ার'।
কল্পনা করুন, ঐতিহাসিক একটি মুহূর্তের। সময়টা ১৯৩৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বুধবারের কথা। জার্মানির মসনদে ৪৮ ঘণ্টার একটু বেশি সময় আগে বসেছেন অ্যাডলফ হিটলার। দেশজুড়ে এক অদ্ভুত আলোড়ন। একদিকে অর্থনৈতিক মন্দার দগদগে ক্ষত। বেকারত্ব। হাহাকার। রাজনৈতিক অস্থিরতা। অন্যদিকে এক নতুন নেতার আবির্ভাব। 'সোনার জার্মানি শ্মশান কেন' বোল তুলে যিনি আকাশছোঁয়া প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ফিরিয়ে আনবেন জার্মানির হারানো গৌরব। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। আর অমিত শক্তিধর এক জার্মানির স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। হিটলার এলেন। দেখলেন। আর ক্ষমতায় বসেই যে জিনিসটাকে তিনি তার অর্থনৈতিক ঝুলি থেকে ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে বের করলেন, তা হলো শুল্ক বা ট্যারিফ। তার ভাষায়, এই শুল্কই হবে জার্মান জাতির 'মুক্তির' চাবিকাঠি। বিশ্বায়নের শৃঙ্খল ছিঁড়ে জার্মান দেশকে আবার স্বনির্ভর করে তুলবে। ফিরিয়ে আনবে জার্মানির অতীত সম্মান আর গর্ব। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এই 'ব্রহ্মাস্ত্র' আসলে পরিণত হয়েছিল এক ভয়ংকর বুমেরাংয়ে। জার্মান অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে তা যেন লাল ঘোড়া দাবড়ানোর মতো হয়ে ওঠে। পাগলা ঘোড়ার মতো উল্টো দিকে ছুটতে শুরু করল, আর সেই ঘোড়ার লাগাম ধরে ছিলেন খোদ ফিউরার; যিনি অর্থনীতি বুঝতেন কম। কিন্তু ক্ষমতা আর যুদ্ধের নেশায় ছিলেন মত্ত। চলুন, সেই অদ্ভুত, আত্মঘাতী শুল্কনীতির আদ্যোপান্ত গল্পটা শোনা যাক–কীভাবে এক স্বৈরাচারীর জেদ আর ভুল নীতি একটা গোটা দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
হিটলার চ্যান্সেলর হিসেবে শপথ নিলেন ৩০ জানুয়ারি, ১৯৩৩। আর ঠিক তার ৪৮ ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই ১ ফেব্রুয়ারি বুধবার তার মন্ত্রিসভায় আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়াল শুল্ক। হিটলারের সদ্য নিযুক্ত অর্থনীতি-বিষয়ক মন্ত্রী আলফ্রেড হুগেনবার্গ, যেন তৈরিই ছিলেন। তিনি সগর্বে ঘোষণা করলেন, কৃষি খাতের দীর্ঘদিনের দাবি অর্থাৎ আমদানি করা কৃষিপণ্যের ওপর চড়া শুল্ক 'অবশ্যই পূরণ করতে হবে'। তবে সাথে একটা লেজুড় জুড়তে ভুললেন না, 'একই সাথে শিল্পের যাতে ক্ষতি না হয়, সেটাও দেখতে হবে।' কিন্তু কীভাবে এই বিপরীতমুখী স্বার্থ রক্ষা হবে? তার কোনো স্পষ্ট কর্মসূচি তো দূরের কথা, ধারণাও দিলেন না তিনি।
মন্ত্রিসভায় তখন দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কনস্টানটিন ফন নিউরাথ প্রমাদ গুনছেন। একদিকে অস্ট্রিয়া থেকে আসা কাঠের ওপর সম্ভাব্য শুল্কের প্রভাব, অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে ঝুলে থাকা প্রায় ২০০ মিলিয়ন রাইখসমার্কের (মুদ্রাস্ফীতি ধরলে আজকের হিসাবে প্রায় ১.১৪ বিলিয়ন ডলার) বিশাল বাণিজ্য চুক্তি–এসব নিয়ে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। অর্থমন্ত্রী কাউন্ট জোহান লুডভিগ গ্রাফ শোয়েরিন ফন ক্রোসিক আরও বেশি উদ্বিগ্ন। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তির মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। তিনি জোর দিয়ে বললেন, অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার! চারপাশে যখন এমন অর্থনৈতিক ঝড়ের প্রস্তুতি চলছে, তখন হিটলারের মনোযোগ কোথায়? তার মাথায় তখন ঘুরছে অন্য হিসাব। তিনি তার মন্ত্রীদের সাফ জানিয়ে দিলেন, তার কাছে এই মুহূর্তে একটাই অগ্রাধিকার–আসন্ন ৫ মার্চের রাইখস্ট্যাগ (জার্মান সংসদ) নির্বাচন। যেকোনো মূল্যে এই নির্বাচনের আগে দেশে 'অগ্রহণযোগ্য অস্থিরতা' এড়াতে হবে। কারণ তিনি জানতেন, এই নির্বাচনই হবে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার মূল চাবিকাঠি। অর্থনীতির ভালোমন্দের চেয়ে তার কাছে তখন রাজনৈতিক জয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বোঝাই যাচ্ছিল, অর্থনীতির স্টিয়ারিং হুইলে এমন একজন বসেছেন, যার পথের দিশা নিয়ে নিজেরই কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই।
হিটলারের আর্থিক বিষয় নিয়ে যে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল, তা নয়। সত্যি বলতে, তার অর্থনীতি বোধ ছিল অতীব কাঁচা। আর অর্থনীতি নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মারাত্মক সরল। তার নিজেরই ঘাড়ে তখন ঝুলছে ৪০০,০০০ রাইখসমার্কের বিপুল অঙ্কের করের বোঝা! অর্থনীতি নিয়ে তার জ্ঞান কতটা 'গভীর' ছিল, তা তার একটি কথাতেই ফুটে উঠেছে। তিনি দাবি করেন, মুদ্রাস্ফীতি তখনই হয়, যখন আপনি তা চান। মুদ্রাস্ফীতি হলো শৃঙ্খলার অভাব। আমি নিশ্চিত করব দাম স্থিতিশীল থাকবে। এর জন্য আমার এসএ (ঝঅ) আছে। ভাবুন একবার! অর্থনীতির মতো জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য হিটলার নির্ভর করছেন তার কুখ্যাত আধা সামরিক গুন্ডাবাহিনী, এসএ বা ব্রাউনশার্টসের ওপর! দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য লাঠিপেটা! এ যেন এক কসাইয়ের হাতে সার্জনের ছুরি তুলে দেওয়া।

আর জার্মানির যাবতীয় অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য তার তৈরি করা সহজ সমাধান ছিল ইহুদিদের ঘাড়ে দোষ চাপানো। তার বিকৃত চিন্তাভাবনায়, জার্মান জাতির সব সংকটের মূলে ছিল এই ইহুদিরাই। অর্থনৈতিক যুক্তি বা তথ্যের ধার তিনি ধারতেন না। তার কাছে সমাধান ছিল একটাই– 'ধর তক্তা মার পেরেক'। অর্থাৎ শত্রু চিহ্নিত করো আর তাকে শেষ করে দাও। এই বিপজ্জনক সরলীকরণই ছিল তার অর্থনৈতিক দর্শনের ভিত্তি।
হিটলার নিজে অর্থনীতি না বুঝলেও তার একজন 'অর্থনৈতিক গুরু' ছিলেন। নাম গটফ্রিড ফেডার। ইনি ছিলেন নাজি পার্টির দীর্ঘদিনের প্রধান অর্থনীতিবিদ। পার্টির সেই কুখ্যাত ২৫ দফা কর্মসূচির অন্যতম কারিগর ছিলেন এই ফেডার। এ কর্মসূচিতে সমাজতন্ত্র আর উগ্র জাতীয়তাবাদের এক অদ্ভুত খিচুড়ি পাকানো হয়েছিল। বিশ্বে এল নতুনবাদ বলে হিটলারের চেলারা রাসভ কণ্ঠে স্লোগান দিয়েছিল কি না জানা নেই।
১৯৩২ সালের মে মাসে যখন হিটলার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছেন, সে সময় ফেডার একটি ৩২ পৃষ্ঠার নীলনকশা তৈরি করেন। ব্যাটে-বলে এক হয়ে ভাগ্যের লীলায় যদি হিটলার হঠাৎ করেই চ্যান্সেলর বনে যান! আহ! তবে যেন অন্ধকারে হাতড়াতে না হয়। সাথে সাথেই এই নীলনকশাকে বাস্তবায়নের কাজে লাগানো যায়! আর ফেডারের এই নীলনকশার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কী? হ্যাঁ, সেই শুল্ক!
ফেডারের মস্তিষ্কপ্রসূত এই অর্থনৈতিক দর্শন ছিল একেবারে বিশুদ্ধ নাজি ঘরানার। উগ্র জাতীয়তাবাদ আর স্বনির্ভরতার এক 'ঘুটা'। তার সাফ কথা, জাতীয় সমাজতন্ত্রের দাবি এই যে জার্মান শ্রমিকদের চাহিদা সোভিয়েত দাস, চীনা কুলি এবং নিগ্রোদের দ্বারা পূরণ হবে না। ভাবটা এমন যেন, জার্মানিতে যা কিছু দরকার, তা জার্মানদের দিয়েই বানাতে হবে, জার্মানরাই কিনবে। বাইরের দুনিয়ার সাথে লেনদেন? নৈব নৈব চ! ফেডার বিশ্ব অর্থনীতিকে দেখতেন হয় 'উদার', নয়তো 'মার্ক্সবাদী' হিসেবে–দুটোই তার চোখে সমান ঘৃণ্য। তিনি চেয়েছিলেন কঠোর 'আমদানি বিধিনিষেধ' আরোপ করে জার্মান অর্থনীতিকে জার্মানদের হাতে ফিরিয়ে দিতে, জার্মান শ্রমিক আর কৃষকদের 'বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করতে'। এই ছিল তার 'জার্মানি ফার্স্ট' নীতির অর্থনৈতিক রূপ–এক বিচ্ছিন্ন, আত্মকেন্দ্রিক দুর্গ তৈরির নীলনকশা।
কিন্তু এই দুর্গ তৈরির ভাবনাটা যে কতটা বিপজ্জনক, তা হিটলারের নিজের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কনস্টানটিন ফন নিউরাথ ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, এই নীতি হিতে বিপরীত রূপ নিয়ে বিধ্বংসী বাণিজ্য লড়াই বাধিয়ে দেবে। শুধু তা-ই নয়, তিনি এমনও আশঙ্কা করছিলেন যে এই শুল্কের ধাক্কায় ডিমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যেতে পারে। বেড়ে যেতে পারে প্রায় ৬০০ শতাংশ; কিন্তু হিটলারের তাতে কী আসে যায়! ফেডারের এই আত্মঘাতী শুল্কনীতি তার কানের কাছে যেন এক মধুর সংগীত। কারণ, এটা তার সেই প্রিয় বোলচাল। জার্মান জাতিকে বিশ্বায়নের 'শৃঙ্খল' থেকে 'মুক্ত' করার যে গল্প তিনি ফেঁদেছিলেন, তার সাথে মিলে গেছে একেবারে খাপে খাপ। যুক্তি বা অর্থনীতিকে ছাপিয়ে উঠেছিল অন্ধ জাতীয়তাবাদী এক আবেগ।
সবচেয়ে বড় পরিহাসটা কী জানেন? হিটলার যখন এই অর্থনৈতিক ভাঙচুরের খেলা শুরু করছেন, জার্মানির অর্থনীতি তখন কিন্তু খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করছে। ১৯২৯ সালের বিশ্বব্যাপী মহামন্দা জার্মানিকেও প্রায় পথে ধসিয়ে দিয়েছিল। কলকারখানা বন্ধ। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার। প্রতি তিনজনে একজন শ্রমিক বেকার! কিন্তু হিটলার ক্ষমতায় আসার ঠিক আগের মাসেই–১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে, জার্মান অর্থনৈতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে বলা হতো যে মন্দার সবচেয়ে খারাপ সময়টা কেটে গেছে। অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধারের পথে চলছে। বরাত জোরে, হিটলার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন এমন এক অর্থনীতি, যাকে শুধু একটু যত্নআত্তি করলেই চলত। তার প্রধান কাজ হওয়া উচিত ছিল এই অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে কোনোভাবেই বিগড়ে না দেওয়া।

গোড়াতে বাজার কিন্তু হিটলারকে স্বাগতই জানিয়েছিল! তার চ্যান্সেলর হওয়ার খবরে জার্মান শেয়ারবাজার, বা 'বোয়ের্স' বেশ চাঙা হয়ে ওঠে। খোদ দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয় এই তেজিভাবের কথা। বিনিয়োগকারীরা হয়তো ভেবেছিলেন, এবার বুঝি সুদিনের দেখা মিলবে!
কিন্তু হায়! তাদের সেই আশা দ্রুতই মিলিয়ে যেতে শুরু করে। হিটলারের আগ্রাসী শুল্কনীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে ফিসফাস। আন্তর্জাতিক চুক্তি ছিঁড়ে ফেলার হুমকি। আর তার সংবিধানবিরোধী কার্যকলাপের খবর বাজারে আসতেই বিপদের ঘণ্টা বেজে ওঠে। যে শেয়ার বাজার শুরুতে লাফিয়ে উঠেছিল, তা থমকে যায়। উল্টামুখো গতি নেয়। নামতে শুরু করে। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কালো মেঘের আনাগোনায় ভরে ওঠে আবার জার্মানির আকাশ। নতুন ক্যাপ্টেন জাহাজকে নিরাপদ বন্দরের দিকে নয়, বরং এক অজানা ঝড়ের দিকে নিয়ে চলেছেন।
অভিজ্ঞ মহল থেকে কিন্তু সতর্কতার অভাব ছিল না। রক্ষণশীল সেন্টার পার্টি হিটলারকে খোলাখুলিভাবেই সাবধান করে দিয়েছিল যেন তিনি 'অসাংবিধানিক, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর, সামাজিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল এবং জার্মান মুদ্রা বিপন্নকারী পরীক্ষা-নিরীক্ষা' থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু সবচেয়ে জোরালো এবং যুক্তিপূর্ণ সতর্কবার্তাটি এসেছিল এডওয়ার্ড হ্যামের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন একজন সাবেক অর্থনীতি-বিষয়ক মন্ত্রী এবং জার্মান শিল্প ও বাণিজ্য সমিতির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি হিটলারকে রীতিমতো চিঠি লিখে অর্থনীতির কিছু মৌলিক পাঠ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
হ্যাম মনে করিয়ে দেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির ভিত্তি হলো বিশ্বাস। আইনের শাসন এবং চুক্তি মেনে চলার মানসিকতা। তিনি পরিসংখ্যান তুলে ধরে দেখান, জার্মানি হয়তো কৃষিপণ্য আমদানি করে (বছরে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন রাইখসমার্ক), কিন্তু তার বিনিময়ে শিল্পপণ্য রপ্তানি করে তার প্রায় চার গুণ (বছরে প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন রাইখসমার্ক)! আর এই বিশাল রপ্তানির ওপর নির্ভর করে দেশের প্রায় ত্রিশ লক্ষ শ্রমিকের রুটি-রুজি। হ্যাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হিটলারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, যদি শুল্কের প্রাচীর তুলে এই বাণিজ্যকে 'শ্বাস রোধ' করা হয়, তবে তা হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল। এর ফলে জার্মান শিল্প উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়বে। বাড়বে বেকারত্ব। অন্যদিকে অর্থনীতিতে নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়। শুধু তা-ই নয়, এর প্রতিক্রিয়ায় অন্য দেশগুলোও যখন পাল্টা শুল্ক বসাবে, তখন পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে। তাই তার বিনীত অনুরোধ ছিল, শুল্কনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে 'সর্বোচ্চ সতর্কতা' অবলম্বন করা হোক। জার্মান শিল্প ও বাণিজ্য সমিতিও প্রকাশ্যে একই সুরে কথা বলে। হিটলারকে মনে করিয়ে দেয় যে জার্মানির মতো একটি রপ্তানিনির্ভর দেশের জন্য বাণিজ্যনীতিতে হঠকারিতা আত্মহত্যার শামিল।
কিন্তু হিটলার কি এসব কথাবার্তায় কান দেওয়ার পাত্র? মোটেই না। তিনি বাজারকে আশ্বস্ত করার কোনো চেষ্টাই করলেন না। তার সেই এক গোঁ–শুল্ক অপরিহার্য! তিনি নাকি এক ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ পেয়েছেন তার পূর্বসূরিদের কাছ থেকে! শুধু তা-ই না, সেটাকে ঠিক করতে তার সময়ও লাগবে! চ্যান্সেলর হিসেবে তার প্রথম বেতার ভাষণে তিনি হুংকার ছাড়লেন, চার বছরের মধ্যে জার্মান কৃষককে দুর্দশা থেকে বাঁচাতে হবে! চার বছরের মধ্যে বেকারত্ব সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে উঠতে হবে!
হবে তো বলা হতো; কিন্তু কীভাবে? তার কোনো বিস্তারিত পরিকল্পনা তিনি দিলেন না। আর মজার ব্যাপার হলো, এই সময়ে তিনি তার একদা অর্থনৈতিক গুরু গটফ্রিড ফেডারের থেকেও দূরে সরে যেতে শুরু করেন। ধনীদের ওপর বেশি কর বসানো, বড় কোম্পানির ওপর সরকারি নজরদারি, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বন্ধ করার মতো ফেডারের পুরোনো সমাজতান্ত্রিক মার্কা প্রস্তাবগুলোকে তিনি তত দিনে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন।
কেন এই ডিগবাজি? কারণ, হিটলারের মাথায় তখন ঘুরছে অন্য চিন্তা–৫ মার্চের নির্বাচন। তার হিসাবে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেতে তার দরকার প্রায় ১৮ থেকে ১৯ মিলিয়ন ভোট। তিনি ভালো করেই জানতেন, এমন কোনো নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেই, যা এত বিশাল আর ভিন্নমতাবলম্বী ভোটারদের মন জয় করতে পারে। তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই তার অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে ধোঁয়াশায় ঢেকে রাখলেন। সাধারণ ভোটার হয়ত অর্থনীতির কচকচানি নিয়ে মাথা ঘামাবে না, কিন্তু বাজার? বাজার ঠিকই এই অনিশ্চয়তার গন্ধ পেয়েছিল। ফলাফল? হিটলারের নিয়োগের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির যেটুকু উত্থান হয়েছিল, তা-ও মিলিয়ে গিয়ে এক স্থায়ী মন্দা দেখা দিল।
হিটলারের এই অদ্ভুত শুল্কনীতির পক্ষে যুক্তি খাড়া করার জন্য এগিয়ে এলেন রাইখের পুষ্টি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা, হান্স জোয়াকিম ফন রোহর। তিনি জাতীয় বেতারে এসে শুল্কের এক অভিনব ব্যাখ্যা দিলেন। তার যুক্তি ছিল, যেসব জিনিস জার্মানিতে কম উৎপাদিত হয়, সেগুলোর আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দামি করে দিলেই নাকি দেশের কৃষকেরা সেগুলো বেশি বেশি করে উৎপাদন করতে শুরু করবে! আর বিদেশি জিনিসের দাম বেশি হলে শহরের লোকেরাও দেশি জিনিস কিনবে। বাহ! কী সহজ সমাধান!
উদাহরণ হিসেবে তিনি আনলেন সেকালে জার্মানদের খাদ্যতালিকায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ 'শমালৎস' বা শূকরের চর্বির কথা। রোহরের তত্ত্ব অনুযায়ী, যদি 'শমালৎস' বা শূকরের চর্বির আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়, তবে জার্মান কৃষকেরা বেশি লাভজনক 'বেকন উৎপাদনকারী' হালকা ওজনের শূকর পালা ছেড়ে দিয়ে বেশি চর্বি উৎপাদনকারী কিন্তু বেশি খাবার গ্রহণকারী 'লার্ড উৎপাদনকারী' বেশি ওজনের শূকর পালতে শুরু করবে!
কিন্তু এই যুক্তি যে কতটা খোঁড়া, তা ধরতে সাধারণ বুদ্ধিই যথেষ্ট ছিল। সমালোচকেরা সাথে সাথেই আঙুল তুললেন। প্রথমত, বেকন বিক্রি করে লাভ বেশি, লার্ড বিক্রি করে তত নয়। দ্বিতীয়ত, বেশি ওজনের 'লার্ড শূকর' পালতে খাবারও লাগে বেশি। ফলে বাড়তি দাম পেয়েও কৃষকের লাভ তো হবেই না, উল্টা লোকসানের পাল্লা ভারী হতে হতে সে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে! এ ছাড়া সমালোচকেরা মনে করিয়ে দিলেন, গত ২০০ বছর ধরে চলে আসা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যব্যবস্থা মোটের ওপর সবার জন্যই লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে। হিটলারের এই আত্মকেন্দ্রিক 'জাতীয় অর্থনীতি' আর তার আত্মঘাতী শুল্কনীতি দেশকে এক 'গুরুতর সংকটে' ফেলবে, লক্ষ লক্ষ মানুষ চাকরি হারাবে! আর এসব ঘটবে অন্য দেশগুলো প্রতিশোধমূলক শুল্ক চাপিয়ে দেওয়ার আগেই!
সব জল্পনা-কল্পনা, সব সতর্কবাণীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ১৯৩৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) হিটলার তার সেই ভয়ংকর শুল্কনীতি ঘোষণা করলেন। শুল্ক বৃদ্ধির হার এতটাই বেশি ছিল যে তা পর্যবেক্ষকদের হতবাক করে দেয়। 'বাস্তবে সমস্ত প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে!' জার্মানির ঐতিহ্যবাহী ও প্রভাবশালী পত্রিকা 'ভসিসচে জাইতুং' তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে লিখল, এটি জার্মান অর্থনীতির জন্য এক 'পথের বাঁক', মনে হচ্ছে ইউরোপের সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশটি বুঝি এবার সত্যি সত্যিই 'লাঙল আর জোয়ালের যুগে' কদম বাড়াল! কোনো রাখঢাক না করেই 'দ্য নিউইয়র্ক টাইমস' লিখল, আসলে এ হলো ইউরোপীয় প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে জার্মানির 'বাণিজ্যযুদ্ধ' ঘোষণা।
এই শুল্কের কোপটা সবচেয়ে বেশি পড়ল স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো আর নেদারল্যান্ডসের ওপর। প্রায় সমস্ত কৃষিপণ্য, এমনকি টেক্সটাইলের ওপর থেকেও জার্মানি একতরফাভাবে 'বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত বাণিজ্য মর্যাদা' তুলে নিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়ানো হলো ৫০০ শতাংশ! ভাবা যায়? ডেনমার্কের মতো দেশ, যাদের গবাদিপশুর বিশাল বাজার ছিল জার্মানি, তারা রাতারাতি পথে বসার উপক্রম হলো। কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল চরম আতঙ্ক। ডেনমার্ক, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস–সবাই গর্জে উঠল। তারা হুমকি দিল 'প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার', যা জার্মান শিল্প রপ্তানির ওপর 'স্পষ্ট আঘাত' হানবে।

আর তাদের হুমকি যে ফাঁকা বুলি ছিল না, তা দ্রুতই টের পাওয়া গেল। খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিউরাথ কিছুদিন পরেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে হিটলারকে করুণ সুরে জানালেন, 'আমাদের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে... প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পথে।' তিনি জানালেন, ডাচ্দের সাথে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ, সুইডেন, ডেনমার্ক, এমনকি ফ্রান্স আর যুগোস্লাভিয়ার সাথেও সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। অর্থমন্ত্রী ক্রোসিকের কপালে হাত! এই শুল্কের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি খাতকে বাঁচাতে জার্মান সরকারের ঘাড়ে অতিরিক্ত ১০০ মিলিয়ন রাইখসমার্ক ঘাটতি বাজেট চেপে বসতে পারে!
হিটলার যেদিন এই আত্মঘাতী বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করলেন, সেদিন সন্ধ্যায়ই তিনি হাজির হলেন বার্লিনের সবচেড়ে বড় মুক্ত প্রাঙ্গণ স্পোর্টপালাস্ট ময়দানে। হাজার হাজার উন্মত্ত সমর্থকের সামনে এ যেন তার বিজয় মিছিল! গায়ে সেই পরিচিত বাদামি স্টর্ম-ট্রুপার ইউনিফর্ম, হাতে লাল জমিনের ওপর কালো স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা আর্মব্যান্ড। চ্যান্সেলর হিসেবে এটাই তার প্রথম জনসভা।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি হুংকার ছাড়লেন। বললেন, পূর্ববর্তী সরকারগুলোর ব্যর্থতায় দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে, একে নতুন করে গড়তে হবে। ভার্সাই চুক্তির অপমান আর আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার 'পাগলামি' থেকে জার্মান জাতিকে মুক্তি দিতে হবে। তিনি ডাক দিলেন 'শুদ্ধিকরণের'। আমলাতন্ত্র, জনজীবন, সংস্কৃতি, এমনকি গোটা জার্মান জাতিকেই নাকি 'শুদ্ধ' করতে হবে! তিনি জার্মান আত্মনির্ভরশীলতার জয়গান গাইলেন। তার প্রতিটি কথার পরতে পরতে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল–এই যে নতুন শুল্কনীতি, এটাই ফিরিয়ে আনবে হারানো জার্মান সম্মান এবং গৌরব। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, কখনো বিদেশের সাহায্যের ওপর বিশ্বাস কোরো না। কখনো আমাদের নিজেদের জাতির বাইরে, আমাদের নিজেদের জনগণের বাইরের সাহায্য-সহায়তার ওপর বিশ্বাস করা যাবে না। জার্মান জনগণের ভবিষ্যৎ আমাদের নিজেদের মধ্যেই নিহিত।
কিন্তু লক্ষ করার বিষয় হলো, তার এই দীর্ঘ ভাষণে তিনি একবারও সেদিন সকালে শুরু করা বাণিজ্যযুদ্ধের কথা উল্লেখ করলেন না! যেমন উল্লেখ করলেন না ঠিক তার আগের দিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা করা জার্মানির পুনরায় বিশাল সমরসজ্জার পরিকল্পনার কথা। সেই বৈঠকের ভেতরের খবর কিন্তু ছিল আরও ভয়ংকর। সেখানে হিটলার স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, পুনরায় বিশাল সমরসজ্জার নীলনকশায় বিলিয়ন বিলিয়ন রাইখসমার্ক প্রয়োজন... জার্মানির ভবিষ্যৎ শুধু এবং একচেটিয়াভাবে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনের ওপর নির্ভর করছে।
তাহলে ছবিটা কী দাঁড়াল? একদিকে হিটলার মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেশপ্রেম আর আত্মনির্ভরশীলতার বুলি আওড়াচ্ছেন, বলছেন শুল্কনীতি এনে দেবে অর্থনৈতিক মুক্তি আর জাতীয় সম্মান। অন্যদিকে পর্দার আড়ালে তিনি তার প্রতিবেশীদের সাথে এক আত্মঘাতী বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও পঙ্গু করে দিচ্ছে। আর তার আসল লক্ষ্যটা লুকিয়ে আছে আরও গভীরে–দেশের সমস্ত সম্পদ ঢেলে দিয়ে এক বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলার নীলনকশা চলছে। এই নীলনকশা একদিন গোটা বিশ্বকে যুদ্ধের আগুনে ঠেলে দেবে।
হিটলারের সেই 'ভয়ংকর শুল্কনীতি' তাই নিছকই একটা ভুল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না। এটা ছিল তার বৃহত্তর মতলবের একটা অংশ। এক আগ্রাসী, যুদ্ধবাজ স্বৈরাচারের ক্ষমতার আস্ফালন, যা জার্মানিকে শুধু অর্থনৈতিকভাবেই দেউলিয়া করেনি, বরং তাকে অনিবার্যভাবে এক বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এই বাণিজ্যযুদ্ধ ছিল সেই আসন্ন মহাযুদ্ধেরই এক অশুভ মহড়া, এক পাগলা ঘোড়ার লাগামছাড়া দৌড়, যার শেষ হয়েছিল এক ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞে। আর এই গল্পের শিক্ষা? যখন যুক্তি আর বিবেচনার বদলে অন্ধ আবেগ, উগ্র জাতীয়তাবাদ আর ক্ষমতার লোভ নীতি নির্ধারণ করে, তখন তার পরিণতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে, হিটলারের এ শুল্কনীতিই তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ হয়ে ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে।