ইসি গঠন: দুঃসাহসী স্বপ্ন হলেও এখনও আশাবাদী

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নির্বাচন ব্যবস্থার সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য যেসব 'ফেরেশতা' কাজ করতে চলেছেন, তাদের নাম প্রকাশের বিষয়টি ইসি সার্চ কমিটি শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির ওপর চাপিয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাবিত চূড়ান্ত ১০ নাম সাধারণ মানুষ জানতে পারবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত তিনিই নিবেন।
প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ না করা নিয়ে সার্চ কমিটি যে যুক্তি দিয়েছে তা শুনে ফাঁকা বক্তব্য মনে হবে। একইসঙ্গে আগের পদক্ষেপটির থেকে ভিন্নপথে হাঁটছে কমিটি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ আরও চার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ প্রার্থীর নাম পাঠানোর আগে সার্চ কমিটি নির্দ্বিধায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে প্রস্তাবিত তিনশর বেশি নাম সম্বলিত প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করে।
তবে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করতে সার্চ কমিটি আইনত বাধ্য নয় বলে জানিয়েছে। আইনিভাবে বিষয়টি অবৈধ না হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুযায়ী সময়ের দাবি ভিন্ন। আর তাই কমিটির উচিত হবে এবারও প্রথম তালিকা প্রকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
প্রথম তালিকা প্রকাশের পর এর বৈধতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলেনি। ইসি গঠন আইনে কমিশন গঠনের জন্য প্রস্তাবিত নামের তালিকা প্রকাশে কোনো বাধা নেই। আর তাই তালিকা প্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কম।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মিলিত ও জোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশিত তালিকাটি অসম্পূর্ণ হলেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদের জন্য কয়জনের নাম জমা পড়েছে ও কারা সেসব নাম প্রস্তাব করেছে, এ বিষয়ে তালিকায় কিছু বলা হয়নি। সিইসি পদে সাবেক দুই প্রধান বিচারপতির নাম অন্তর্ভুক্ত করাটা ছিল বিস্ময়কর। যারা নাম প্রস্তাব করেছেন তারা নিশ্চিতভাবেই প্রধান বিচারপতির উচ্চপদ কতটা গুরুত্ব বহন করে সেটি ভুলে গেছেন।
আরও কিছু বিষয় আছে। অন্তত সাতজনের নাম তালিকায় দুবার জায়গা করে নিয়েছে। বিষয়টি সার্চ কমিটিতে নিযুক্ত সচিব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা তুলে ধরেছে। কিছু নাম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
তারপরও গল্পের অপর পিঠটাও দেখা দরকার।
আগামী বছরের শেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন ও পরিচালনায় গঠিত হতে চলা নতুন নির্বাচন কমিশনের পাঁচ পদের জন্য অগোছালোভাবে প্রকাশিত নামগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষ সরব।
২০১৩ ও ২০১৭ সালে গঠিত আগের দুই সার্চ কমিটি কোনো তালিকা প্রকাশ করেনি। তালিকা প্রকাশের কৃতিত্ব পুরোপুরি সার্চ কমিটির না হলেও এবারের কমিটির উদ্যোগটি ছিল প্রশংসনীয়। কমিটি চূড়ান্ত তালিকাও প্রকাশ করবে বলে আশা করা হয়েছিল।
তবে রোববার সার্চ কমিটি নিজে থেকে তালিকা প্রকাশ না করার বিষয়টি নিশ্চিত করে। তালিকা প্রকাশের সম্পূর্ণ দায় রাষ্ট্রপতির ওপর চাপিয়ে কমিটি জানায়, রাষ্ট্রপতি যদি চূড়ান্ত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশের নির্দেশ দেন তবেই তারা নাম প্রকাশ করবে।
সার্চ কমিটির সাথে আলোচনায় প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশসহ সুশীল সমাজের সদস্যরা বেশকিছু প্রস্তাব রেখেছিলেন। সর্বশেষ এই সিদ্ধান্ত তাদেরও হতাশ করেছে।
উদাহরণ হিসেবে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিকের কথা ধরা যাক। তিনি বলেছেন, "পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আমাদের (সার্চ কমিটির সাথে) এই আলোচনায় যাওয়া উচিত হয়নি।"
তিনি আরও বলেন, গত দুই সার্চ কমিটির চেয়ে বর্তমান সার্চ কমিটি বেশ স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। তবে চূড়ান্ত তালিকায় প্রস্তাবিত নাম প্রকাশিত না হলে এর স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে তার ধারণা।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, "ইসি গঠন আইনে বর্ণিত পদ্ধতির সঙ্গে আমরা শুরু থেকেই ভিন্নমত পোষণ করছি। আইন অনুযায়ী চূড়ান্ত প্রার্থীদের নাম প্রকাশে সার্চ কমিটির বাধ্যবাধকতা নেই। এ কারণে কমিটি অহেতুক কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না।"
"আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কতটুকু তা সবাই জানে। তাই রাষ্ট্রপতি এই নামগুলো প্রকাশ করবেন এমন আশা করে লাভ নেই," বলেন তিনি।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল: সার্চ কমিটিকে প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার কথা কি রাষ্ট্রপতি বলবেন? না কি তার দপ্তর বঙ্গভবন এই কাজ করবে?
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ছাড়া যেকোনো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতীত রাষ্ট্রপতির একার পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।
সুতরাং রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে নাম প্রকাশের বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনের মন্তব্য যুক্তিসংগত।
সার্চ কমিটি যদি সিদ্ধান্তে অটল থেকে প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে, তাহলে তারা ভালো কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপনের সুযোগ হারাবে।
গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের সম্ভাব্য পদাধিকারীদের নাম আগে থেকে জানা কোনো নতুন বিষয় নয়।
বহু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে যোগ্য লোক বাছাই করতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গণশুনানির ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্য কীভাবে নিয়োগ দেয়, তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। এখানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালের কথাই বলা যেতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের মতো বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগদানে প্রার্থী মনোনয়নের জন্য কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা ও অন্যান্য উচ্চপদস্থদের নিয়ে নেপাল একটি সাংবিধানিক পরিষদ চালু করে।
পরিষদের মনোনীত নামগুলো সংসদীয় কমিটিতে শুনানির জন্য পাঠানো হয়। মনোনীত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে জনগণের কাছে অভিযোগ দায়েরের আহ্বান জানিয়ে প্রার্থীদের নাম প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে সংসদের কোনো ভূমিকা নেই। কার্যকর নজরদারি ও ভারসাম্যের অভাবে সংসদের প্রধান নির্বাহী বিপুল ক্ষমতা ভোগ করেন।
২০০৭ সালে চূড়ান্ত প্রার্থীদের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর আগে সংসদীয় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির কাছে পাঠানোর খসড়া প্রস্তাব রাখে ইসি। কিন্তু সেই প্রস্তাবনা আলোর মুখ দেখেনি।
প্রায় প্রতিটি প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে একটি বিষয় এক। আমরা যখন আরও ভালো কিছু করার চেষ্টা করি, তখন অন্তত একটি মাঝারি মানের ফলাফল দেখতে পাই। অসাধারণ কিছু করাটা আমাদের সাধ্যের বাইরে। বছরের পর বছর ধরে বিষয়টি আমাদের জাতীয় চরিত্রের অন্যতম দিক হিসেবে প্রকাশ লাভ করেছে।
পরিশিষ্ট
নিচের কথাগুলো বেশ আশাবাদী ও দুঃসাহসী ভাবনা থেকে লেখা।
কর্মজীবনে নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বের জন্য সমাজে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি থাকা বেশ কয়েকজন প্রার্থীকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা দিয়েছে সার্চ কমিটি। রাষ্ট্রপতির কাছে চূড়ান্ত তালিকা পাঠানোর আগে নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব নিয়ে কমিটি তাদের কাছে গেছে।
এদের মধ্যে কেউ কেউ নির্বাচনকে বর্তমান দুরাবস্থার হাত থেকে উদ্ধারের মতো কঠিন কাজটি সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জ নিতে সম্মত হয়ছেন। কিন্তু যেকোনো উপায়ে নির্বাচনে জেতার বর্তমান অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে তারা অবগত। আর তাই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে নতুন নির্বাচন কমিশন পূর্ণ সহায়তা লাভ করবে, ক্ষমতাসীন দলের কাছে এমন আশ্বাসই চান তারা।
লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
মূল লেখা: EC formation: Still nursing a wild but optimistic dream