Skip to main content
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
The Business Standard বাংলা

Thursday
June 05, 2025

Sign In
Subscribe
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
THURSDAY, JUNE 05, 2025
রাসেলস ভাইপার: গুজবের আড়ালে যা কিছু সত্য…

মতামত

শুভব্রত সরকার
27 June, 2024, 01:20 pm
Last modified: 27 June, 2024, 02:57 pm

Related News

  • লাগেজে ৪৭ বিষধর ভাইপার সাপ, মুম্বাই বিমানবন্দরে আটক ভারতীয়
  • সাপের বিষ শরীরে নিয়েছেন শতবার, তার রক্তেই তৈরি হলো ১৯ প্রজাতির অ্যান্টিভেনম
  • অস্ট্রেলিয়ার পাহাড়ে নিখোঁজের ৬ দিন পর সাপে কামড়ানো নারীকে পাওয়া গেল
  • বন্যার পানিতে সাপ: লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীতে কয়েক দিনে সাপের কামড়ে চিকিৎসা নিয়েছে শতাধিক
  • দেশে সর্বপ্রথম কিং কোবরার ডিম থেকে কৃত্রিম উপায়ে ফুটল ২৫টি বাচ্চা

রাসেলস ভাইপার: গুজবের আড়ালে যা কিছু সত্য…

কেউ বলেন বাংলাদেশের বিলুপ্ত চন্দ্রবোড়া সাপ ভারত থেকে ভেসে এসেছে, কেউ বলেন এই সাপের কামড়ের চিকিৎসার নেই, কেউ কেউ মনে করেন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে চন্দ্রবোড়া, কেউ কেউ বলেন এরচেয়ে বিষধর সাপ এদেশে আর একটিও নেই। আসলেই কি এসব ধারণা সঠিক?
শুভব্রত সরকার
27 June, 2024, 01:20 pm
Last modified: 27 June, 2024, 02:57 pm
ছবি: ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন

অজগরের কামড়!

১১ই জুলাই, ২০২৩। চরভদ্রাসন ফরিদপুর। হাজিগঞ্জ গ্রামের সাপুড়ে ওঝা নূর ইসলাম (৩৫) নিত্যদিনকার মতো সাপের বাক্সপেটরা নিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে বের হন খেলা দেখানোর উদ্দেশ্যে। সাপের খেলা দেখিয়েই চলে তার রুটিরুজি। বিভিন্ন সাপের খেলা দেখানো শেষে শুরু করেন অজগরের খেলা দেখানো। খেলা দেখানোর সময় হঠাৎ অসতর্ক হয়ে পড়লে সাপটি কামড়ে দেয় তার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে। নূর সাপুড়ে অত্র এলাকার নামকরা ওঝা। সাপের কামড়ের চিকিৎসার বিভিন্ন টোটকা তার জানা। সাপের কামড়ের ব্যথাকে তিনি পাত্তা দেন না। গুরুর কাছ থেকে পাওয়া টোটকা দিয়ে নিজের মতো করে কামড়ের চিকিৎসা করে বাড়ি ফিরে যান। 

দুপুর নাগাদ হঠাৎই নূর সাপুরের আঙুলের কামড়ের স্থানের ব্যথা তীব্র হয়ে ওঠে। শরীর মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে, শরীরে দেখা দেয় বিষের লক্ষণ। নূর সাপুরের পরিচিত ওঝারা ঝাড়ফুঁক দিয়ে বিষ নামানোর চিকিৎসা চালাতে থাকেন। একসময় নূর সাপুরের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেলে, তার পরিবারের লোকেরা আতংকিত হয়ে দুপুর ১২টা নাগাদ রোগীকে নিয়ে আসেন ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে। কামড় দেওয়া অজগর সাপটিকেও একটি জালের মধ্যে ভরে সঙ্গে নিয়ে আসেন তারা। 

হাসপাতালে আসার পর তারা জানতে পারেন, কামড় দেওয়া সেই সাপটি অজগর ছিল না। সাপটি ছিল চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার (Russell's viper), বাংলাদেশে প্রাপ্ত তীব্র বিষধর সাপগুলোর একটি। কর্তব্যরত ডাক্তাররা সাথে সাথেই নূর সাপুড়ের চিকিৎসা শুরু করেন। ফরিদপুর মেডিকেলে অ্যান্টিভেনম না থাকায় বাইরে থেকে কিনে এনে দেওয়া হয় দুই ডোজ অ্যান্টিভেনম। চন্দ্রবোড়া কামড় দেওয়ার প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর শুরু হয় নূর সাপুড়ের চিকিৎসা। ইতোমধ্যে তার প্রস্রাব, পায়খানা ও বমির সাথে ঘন কালচে রক্ত বের হওয়া শুরু করেছে, চোখে রক্ত জমে টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। 

কিছু সময় পর নূর সাপুরের কিডনি বিকল হওয়ার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে, ফুসফুসে পানি চলে আসে এবং পেট ফুলে যায়। ১২ জুলাই ২০২৩—অবস্থার আরো অবনতি হওয়া শুরু করলে নূর সাপুড়েকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে তাকে আইসিইউ বিভাগে ভর্তি করা হয় ও কিডনি ডায়ালাইসিস প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের ভলান্টিয়াররা অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই ৮ দিনে নূর সাপুড়ের জন্য ১০ ব্যাগের অধিক বি পজিটিভ গ্রুপের রক্ত সংগ্রহ করেন। প্রতিদিন হাসপাতালে গিয়ে রোগীর শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর রাখতেন এই ভলান্টিয়াররা। অবশেষে ১৯ জুলাই ২০২৩ তারিখে কিডনি জটিলতা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ ও অন্যান্য জটিলতায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন নূর সাপুড়ে।

কথা বলছিলাম বাংলাদেশে প্রাপ্ত তীব্র বিষধর সাপেদের মধ্যে অন্যতম একটি চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার নিয়ে। গণমাধ্যমের সংবাদ, ভিডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট, ছবি, গুজব, আলোচনা-সমালোচনার হাত ধরে যা এখন সর্বজন পরিচিত। কেউ বলেন বাংলাদেশের বিলুপ্ত চন্দ্রবোড়া সাপ ভারত থেকে ভেসে এসেছে, কেউ বলেন এই সাপের কামড়ের চিকিৎসার নেই, কেউ কেউ মনে করেন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে চন্দ্রবোড়া, কেউ কেউ বলেন এরচেয়ে বিষধর সাপ এদেশে আর একটিও নেই। এমন আরো অনেক চিন্তাভাবনা জনগণের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শত শত মন্তব্যে ভরে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এই মন্তব্য ও ধারণাগুলো কি আসলেই সঠিক, নাকি এর বাইরেও আরো কিছু বিষয় আছে, আজ কথা বলব সেসব নিয়ে।

ভারত থেকে ভেসে আসা সাপ…

সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের কল্যাণে মানুষের মনে একটি ধারণা জন্মেছে যে, 'চন্দ্রবোড়া সাপ ভারত থেকে পদ্মার পানিতে ভেসে এদেশে এসেছে।'

কিন্তু চন্দ্রবোড়া আদতে বহিরাগত কোনো সাপ নয়। আদিকাল থেকেই বাংলাদেশে পদ্মাবিধৌত বরেন্দ্র অঞ্চলের ঘাসবনসমৃদ্ধ চরাঞ্চলে এর উপস্থিতি ছিল। বাংলাদেশের প্রাণীবিস্তৃতির ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায়, চন্দ্রবোড়া সাপ আমাদের উপমহাদেশে সর্বপ্রথম শনাক্ত করা হয় ১৭৯৭ সালে। জর্জ শ এবং ফ্রেড্রেইক পলিডোর নডার ১৭৯৭ সালে চন্দ্রবোড়া সাপ নথিভুক্ত করেন। এর আগে ১৭৯৬ সালে স্বনামধন্য হার্পেটোলজিস্ট প্যাট্রিক রাসেলের লেখা 'অ্যান অ্যাকাউন্ড অভ ইন্ডিয়ান সার্পেন্টস, কালেক্টেড অন দ্য কোস্ট অভ করোমান্ডেল' বইয়ে চন্দ্রবোড়া সাপের পরিচয় নথিভূক্ত করেছিলেন এবং তার নামের সম্মানেই চন্দ্রবোড়া সাপের নামকরণ রাসেলস ভাইপার করা হয়।

ডা. পরেশ ব্যানার্জি কর্তৃক ১৯২৯ সালে রচিত বই, 'হ্যান্ডবুক অভ স্নেক বাইট' ও ১৯৫৬ সালে রচিত বই, 'স্নেক বাইট—উইথ আ সিস্টেম অভ ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড কেসেস অ্যান্ড নোটস'-এ এ বাংলা অঞ্চলের খুলনা, যশোর, পাবনা ও কুষ্টিয়া থেকে চন্দ্রবোড়ার কামড়ে আক্রান্ত ২২ জন রোগীর কথা জানা যায়। 

তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশ অখণ্ডিত থাকায় বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের আলাদা রেকর্ড হবার কোনো প্রশ্নই ছিল না। কেননা ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশকে একটি অঞ্চল বলেই বিবেচনা করা হতো।

আলাদাভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া সাপ সর্বপ্রথম ১৯৮২ সালে 'বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী' বইয়ে নথিভূক্ত করেন প্রখ্যাত প্রাণিবিদ আলী রেজা খান। এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৯২ সালে আলী রেজা খানের লেখা 'বাংলাদেশের সাপ' বইয়েও চন্দ্রবোড়া সাপের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও ২০২৪ সালে সাবেক শিকারি, প্রখ্যাত প্রাণিবিশারদ ও ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা সরওয়ার পাঠান রচিত 'ছোবল' বইয়ে ১৯৯৫ সালে গাজীপুরের ভাওয়াল বনাঞ্চলে বাচ্চা প্রসবরত চন্দ্রবোড়া সাপের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

লোকজনের মধ্যে ধারণা আছে, চন্দ্রবোড়া সাপ বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। 'আইইউসিএন রেড বুক অভ থ্রেটেনড অ্যামফিবিয়ান অ্যান্ড রেপটাইলস অভ বাংলাদেশ (২০০০)-এর তথ্য মোতাবেক, এরা বাংলাদেশ থেকে কোনোকালেই বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। ২০১৩ সালের আগপর্যন্তও বরেন্দ্র অঞ্চলে অল্প কিছু চন্দ্রবোড়া টিকে ছিল।

এ থেকে পরিষ্কার যে চন্দ্রবোড়া সাপের আদি বাসস্থান বাংলাদেশ। এ কথা অস্বীকার করে চন্দ্রবোড়া সাপ ভারত থেকে ভেসে এসেছে, এমন মনে করার কোনো সুযোগ নেই।

ব্যাপক হারে প্রজননক্ষম চন্দ্রবোড়া ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে…

অনেকেই ধারণা করছেন, চন্দ্রবোড়া সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। সাপটির উচ্চ প্রজনন ক্ষমতাকে এর কারণ হিসেবে মনে করছেন তারা। তাছাড়া গণমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন চটকদার সংবাদ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন ভিডিও ও ছবি তাদের এ ধারণাকে আরও পোক্ত করেছে। 

আলী রেজা খান রচিত, ১৯৮২ সালে প্রকাশিত বই 'বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী- উভচর-সরীসৃপ' (প্রথম খণ্ড), ১৯৯২ সালে প্রকাশিত বই 'বাংলাদেশের সাপ' এবং ২০১৮ সালের ফরিদ আহসান ও আবু সাঈদ কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণাপত্র 'ডিস্ট্রিবিউশন অভ রাসেলস ভাইপার ইন বাংলাদেশ'-এর তথ্য অনুযায়ী, পুরোনো রেকর্ড হিসেবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশের অন্তত ১৭টি জেলায় রাসেলস ভাইপারের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চল, গড়াই এবং পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলে বেশি অবস্থান ছিল রাসেলস ভাইপারের। এছাড়া সে সময় দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া ও টাঙ্গাইলে চন্দ্রবোড়া সাপের উপস্থিতি দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এর আওতা আরও বেড়েছে। ২০২০ সালে নাঈম খন্দকার ও কামরুন্নাহার জেনি কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণাপত্র, 'নিউ ডিস্ট্রিবিউশন রেকর্ডস অভ রাসেলস ভাইপার, ড্যাবোয়া রাসেলি (শ অ্যান্ড নডার ১৯৭৭), ইন বাংলাদেশ' এবং ২০১৮ সালের ফরিদ আহসান ও আবু সাঈদ কর্তৃক প্রকাশিত গবেষনাপত্র 'ডিস্ট্রিবিউশন অভ রাসেলস ভাইপার ইন বাংলাদেশ'-এর নতুন রেকর্ড ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত যাচাইকৃত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শরীয়তপুর, ঝিনাইদহ, রংপুর, নওগাঁ, মাদারীপুর, সাতক্ষীরা, রাজবাড়ী, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, ভোলা, মুন্সীগঞ্জ, দিনাজপুর, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় চন্দ্রবোড়া সাপের উপস্থিতি দেখা গেছে। 

চন্দ্রবোড়ার সংখ্যা কি আসলেই বাড়ছে?

অন্যান্য সাপের তুলনায় চন্দ্রবোড়া সাপের প্রজনন ক্ষমতা বেশি। কারণ, এরা ডিম না পেড়ে সরাসরি বাচ্চার জন্ম দেয়। একবারে ৪০ থেকে ১০০টির অধিক বাচ্চা প্রসব করতে পারে। তবে বাচ্চা টিকে থাকার হার খুবই কম। চন্দ্রবোড়ায় স্বজাতীয় ভক্ষণ দেখা যায়। জন্মলাভের পর পর্যাপ্ত খাবার না পেলে শক্তিশালী বাচ্চাগুলো দুর্বল বাচ্চাদের খেয়ে ফেলে। কিছু বাচ্চা জন্মের সময়ই মারা যায়। এছাড়া অধিকাংশ বাচ্চাই বিভিন্ন শিকারি প্রাণী, যেমন পাখি, গুইসাপ,কোলাব্যাঙ, শেয়াল, খাটাশ ইত্যাদির খাদ্যে পরিণত হয়। প্রথমবার খোলস বদলানোর আগেই অধিকাংশ বাচ্চা নানা কারণে মারা যায়। সর্বোচ্চ ৩-৪ টি বাচ্চা টিকে থাকতে পারে। 

ছবি: ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন

বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্থানগুলোতে সঠিকভাবে জনসংখ্যা জরিপ করা ব্যতীত আসলেই চন্দ্রবোড়ার সংখ্যা বেড়েছে কি না, সেটা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একটি জীবপ্রজাতির জনসংখ্যা নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। বাস্তুতান্ত্রিক খাদ্যচক্রের মাধ্যমে প্রতিটি প্রজাতির জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকে। কোনো একটি স্থানে কোনো প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার মানে হলো, হয় অত্র এলাকার বাহ্যিক কোনো কারণে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে খাদ্য-খাদকের আন্তঃসম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হয়েছে, অথবা প্রাণীর প্রাকৃতিক আবাস নষ্ট হওয়ার কারণে প্রাণীগুলো জনসম্মুখে বেশি আসছে। 

চন্দ্রবোড়ার সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আরও কিছু বিষয় সামনে এসেছে। সেগুলো হলো:

১. নদ-নদীর নাব্যতা সংকটে নতুন নতুন স্থায়ী চর সৃষ্টি হচ্ছে যা চন্দ্রবোড়া সাপের আদর্শ বাসস্থান।

২. বৈশ্বিক উষ্ণায়ন একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। শীতল রক্তবিশিষ্ট হওয়ায় সরীসৃপের জীবনচক্রের ওপর তাপমাত্রার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তাপমাত্রার পরিবর্তনে সরীসৃপের বাসস্থান, প্রজনন কিংবা আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

৩. চরাঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণের ফলে ঘাসবন হ্রাস পেয়ে সাপের প্রাকৃতিক আবাস বিপন্ন হয়েছে। ফলে চন্দ্রবোড়া আবাসস্থল হিসেবে ধানি জমিগুলোকেই বেছে নিচ্ছে। তাছাড়া এই জমিগুলোতে দুই-তিন চাষে ফসলের আবাদ হচ্ছে। ফসলের প্রার্চুযতার কারণে এসব ফসলি জমিতে ইঁদুরের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে চন্দ্রবোড়া পছন্দসই শিকার ইঁদুরের লোভে এদের আবাসস্থলের কাছাকাছি বেশি অবস্থান করছে। যার প্রভাবে সাপ-মানুষের দূরত্ব কমে যাওয়ায় সংঘাত বাড়ছে।

৪. মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত চন্দ্রবোড়ার প্রজনন মৌসুম হওয়ায় এ সময়টাতে এদের আনাগোনা বেশি দেখা যায় যা জুন-জুলাই পর্যন্তও বর্ধিত হতে পারে। 

৫. চন্দ্রবোড়া দক্ষ সাঁতারু নয়, অল্প কিছু সময়ের জন্য সাঁতরাতে পারে। তবে এরা পানিতে ভেসে থাকতে সক্ষম। কুণ্ডলী পাকিয়ে, মাথা কুণ্ডলীর মাঝে কিছুটা ওপরে রেখে ভেসে থাকে। এ সময়, স্রোতের টানে এরা এক চর থেকে অন্য চরে ভেসে চলে যায়। তাছাড়া, বর্ষা মৌসুমে নদীগুলোতে কচুরিপানা বৃদ্ধি পায়। এই কচুরিপানার মাধ্যমেও এরা কখনো কখনো ভেসে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যায়। বর্তমানে নতুন অঞ্চলগুলোতে চন্দ্রবোড়ার উপস্থিতি দেখা যাওয়ার এটিও একটি কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে, দুঃখজনক ব্যাপার হলো যে, বিগত কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চন্দ্রবোড়া নিয়ে যতগুলো ছবি বা ভিডিও সামনে এসেছে, তার অধিকাংশই একই সাপের পুরোনো ছবি বা ভিডিও, যা ভিন্ন ভিন্ন এলাকার বলে প্রচার করা হচ্ছে, অথবা ঘরগিন্নি, অজগর, মেটে সাপ, নোনাবোড়া সাপ ইত্যাদি মেরে তাদেরকে চন্দ্রবোড়া হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। তাই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোতে চন্দ্রবোড়ার সংখ্যা আসলেই বেড়েছে কি না, সেটা যথাযথ জরিপ ও গবেষণার প্রশ্ন রাখে।

চন্দ্রবোড়া কি আক্রমণাত্মক সাপ?

চন্দ্রবোড়া অনেকটাই শান্ত ও অলস প্রকৃতির সাপ। এরা কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়ে পারে। চন্দ্রবোড়া সাপ দিন ও রাতে সমানভাবে সক্রিয় থাকে, সাধারণত নিচু ভূমির ঘাসবন, ঝোপজঙ্গল, উন্মুক্ত বন, কৃষি এলাকায় বাস করে এবং মানববসতি এড়িয়ে চলে। এরা চোখে ভালো দেখতে পায় না। ঘ্রাণশক্তি ও শিকারের নড়াচড়া আন্দাজ করে শিকার করে, মূলত অ্যাম্বুশ প্রিডেটর (Ambush Predator)। শিকারের অপেক্ষায় কুণ্ডলী পাকিয়ে ওত পেতে বসে থাকে। গায়ের বর্ণ মেটে বা বাদামি হওয়ার সহজেই মাটি, পাকা ধানগাছ বা শুকনো ঘাসের বর্ণের সাথে আত্মগোপনে থেকে শিকার করে। বড় কোনো প্রাণী বা মানুষ চন্দ্রবোড়া সাপের মুখোমুখি হয়ে গেলে এরা খুব জোরে 'হিস হিস' শব্দ করে নিজের অবস্থান জানান দেয় ও সতর্ক করে দেয়। এমতাবস্থায় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সেই স্থান পরিত্যাগ করলে সংঘাতের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। সাপ মারতে গেলে অথবা ঝোপের পাশে কাজ করতে গিয়ে বা ধান খেতে কাজ করতে করতে হঠাৎ একেবারে সাপের গায়ের কাছে চলে গেলে এরা নিজের আত্মরক্ষার জন্য কামড় দিতে পারে। 

চন্দ্রবোড়া বাংলাদেশের সব থেকে বিষধর সাপ?

মানুষের মধ্যে একটি ভুল ধারণা কাজ করে যে, চন্দ্রবোড়া বাংলাদেশের সব থেকে বিষধর সাপ। কিন্তু বিষধর সামুদ্রিক সাপসহ বাংলাদেশে প্রাপ্ত যেসব বিষধর সাপের বিষের মাত্রা জানা আছে, তাদের মধ্যে চন্দ্রবোড়ার অবস্থান ৭ম। গোখরা (Cobra) ও কেউটের (Krait) পরে এর অবস্থান। চন্দ্রবোড়ার বিষ খুবই ধীরে কাজ করে, বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়ার কামড় খেয়ে কোনো ধরনের চিকিৎসা ছাড়া ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকারও রেকর্ড আছে।

চন্দ্রবোড়া সাপের বিষ বিভিন্ন প্রোটিন, এনজাইম, বায়োমলিকিউল ও অন্যান্য ধরনের বিষের মিশ্রণ। বিষের প্রকৃতি মূলত হেমোটক্সিন। এছাড়াও নিউরোটক্সিন, মায়োটক্সিন, নেফ্রোটক্সিন, প্রোটিন উপাদান ও বিভিন্ন এনজাইমের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। 'এনজাইম' উপাদানগুলো টিস্যুর মাধ্যমে দ্রুত বিস্তার নিশ্চিত করে। 'ফসফোলাইপেজ' সেল মেমব্রেন ধ্বংস করে এবং হেমোলাইসিস সৃষ্টি করে। এ প্রক্রিয়ায় রক্তের লোহিত কণিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্য উপাদান 'প্রোটিনেজ' দেহের প্রোটিন ভেঙে ফেলে, যা টিস্যু ধ্বংস এবং রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা হ্রাস করে। হেমোটক্সিন রক্তের লোহিত কণিকা ধ্বংস, রক্তনালীতে জায়গায় জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দেয়। ফলে ক্ষত দিয়ে অনবরত রক্ত ঝরতে থাকে । ছোট ছোট শিরার গায়ে ছিদ্র তৈরি হয়ে যায়, ফলে রক্ত বের হয়ে চামড়ার নিচে জমা হয় যা ওপর থেকে লালচে বেগুনি দেখায়। চিকিৎসা না হলে বিষের প্রভাবে টিস্যু নষ্ট হতে পারে, যা টিস্যু নেক্রোসিস অথবা গ্যাংগ্রিনের পর্যায়ে যেতে পারে। আক্রান্ত স্থানে ব্যথা, ফোস্কা পড়া ইত্যাদি দেখা দেয়। বিষের প্রভাবে হৃৎপিণ্ড আক্রান্ত হয়। বিষের নেফ্রোটক্সিন কিডনি আক্রান্ত করে, যা সময়মতো চিকিৎসা না নিলে কিডনি ফেইলিউরের দিকে চলে যেতে পারে। সবসময় না হলেও, কখনো কখনো বিষের নিউরোটক্সিন শ্বাসকষ্ট তৈরি করতে পারে।

চন্দ্রবোড়ার কামড়ে বিষের আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণসমূহ হলো:

১. কামড়ের স্থানে তীব্র ব্যথা এবং সেই জায়গায় ফোলা ভাব দেখা যায়।

২. মাথা ঘোরানো,দুর্বলতা, বমি বমি ভাব অথবা বমি হতে পারে।

৩. রোগীর চোখের পাতা পড়ে যায় ও রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

৪. অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের ফলে চামড়ায় লালচে বেগুনি দাগ দেখা দিতে পারে।

৫. সময়মতো চিকিৎসা না নিলে, চোখ-নাক, মুখ, মলদ্বার ও প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হয়। কামড়ের স্থানের মাংসে পচন ধরে টিস্যু নেক্রোসিস অথবা গ্যাংগ্রিনের পর্যায়ে যেতে পারে।

৬. চরম পর্যায়ে রোগীর কিডনিসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ বিকল হয়ে রোগী মৃত্যুবরণ করেন।

চন্দ্রবোড়ার কামড়ের কি চিকিৎসা নেই?

চন্দ্রবোড়ার কামড়ের চিকিৎসা নেই অথবা অ্যান্টিভেনম দিলেও কাজ করে না বলে মানুষের ধারণা রয়েছে। তবে এ বিষয়টি সত্য নয় বলে জানিয়েছেন টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল ফয়েজ। 

তিনি বলেন, 'চন্দ্রবোড়ার দংশনের শিকার বেশিরভাগ রোগীই মারা যান, অ্যান্টিভেনমে কাজ হয় না—এগুলো ভুল তথ্য। বরং বেশিরভাগ রোগীই সুস্থ হয়ে যান। এই উপমহাদেশে সাপের দংশনের ঐতিহ্যগত চিকিৎসা (ওঝা) প্রচলিত ছিল। আমার চিকিৎসার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, মানুষ সাপে কামড় দেওয়ার পর সর্বপ্রথম যায় ওঝার কাছে। পরে একেবারেই শেষ সময়ে আমাদের কাছে আসে। অথচ সময় হচ্ছে এখানে গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত সময়ে রোগীকে উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা দরকার।'

বাংলাদেশে সমস্ত বিষধর সাপের জন্য একটাই কার্যকর অ্যান্টিভেনম ব্যবহার করা হয়। এর নাম পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম। গত ১৫  মে ২০২৪ চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে এক ব্যক্তি চন্দ্রবোড়ার দংশনের শিকার হলে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পর তিনি সুস্থ হয়েছেন। ডাক্তার তাকে পরবর্তীকালীন চিকিৎসার জন্য পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। এছাড়াও গত মাসে ফরিদপুরের নেছারগঞ্জের অধিবাসী শাহজাহান সর্দার নামের এক কৃষক ধান কাটার সময় পায়ে চন্দ্রবোড়ার কামড়ে আক্রান্ত হলে তাকে দ্রুত ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। অ্যান্টিভেনম চিকিৎসা নিয়ে তিনিও এখন সুস্থ আছেন।

ইউরোপিয়ান জার্নাল অভ ভেটেরিনারি মেডিসিন-এ সালে প্রকাশিত জাকারিয়া আল নোমানের গবেষণাপত্র 'আ রিভিউ অন পটেনশিয়াল অ্যান্টিভেনম ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ'-এ ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের তৈরি পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনমের কার্যকরিতা ও সহজলভ্যতার কথা উঠে এসেছে। এটি এমনভাবে বানানো যে সব রকম সাপের বিষের বিরুদ্ধে কাজ করে। তাই সাপের কামড় খেলে হাসপাতালে সাপ ধরে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই । প্রথমত, সাপ ধরতে গিয়ে সময় নষ্ট হবে। দ্বিতীয়ত, রোগী নিজেই সাপ ধরতে গেলে যে অঙ্গে কামড়েছে সেটা নড়াচড়া করবে এবং বিষ দ্রুত ছড়াবে। তাছাড়া, পুনরায় কামড় খাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল ফয়েযের দেওয়া তথ্য অনু্যায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ২৩৫ জন চন্দ্রবোড়ার কামড়ে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন। এদের মধ্যে ১৭৩ জন রোগী সুস্থ হয়ে ফিরে যান। এর মানে দাঁড়ায়, চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশের কিছুটা বেশি। 

সাপের কামড়ের চিকিৎসায় সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। চন্দ্রবোড়ার বিষে অনেকগুলো জটিল উপাদান রয়েছে। দেরি করলেই এখানে সমস্যা তৈরি হয়। যথাযথ চিকিৎসা করলে বেশিরভাগ রোগীকেই বাঁচানো সম্ভব। চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো বিষক্রিয়ায় সৃষ্ট জটিলতা। মানে অ্যান্টিভেনম নিয়ে সুস্থ হয়ে চিকিৎসা বন্ধ করে দিলে দেহের ভেতর যে জটিলতা থেকে যায়, সেটাই পরে মৃত্যু ঘটায়। হেমোটক্সিন যেহেতু রক্তে প্রভাব ফেলে, তাই যেসব অঙ্গে রক্ত যায়, মানে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ বা কলিজা, বৃক্ক ইত্যাদি আক্রান্ত হয়। এগুলো অ্যান্টিভেনম ঠিক করতে পারবে না, এর কাজ শুধু বিষ নষ্ট করা। তাই চন্দ্রবোড়ার ক্ষেত্রে শুধু অ্যান্টিভেনম নিয়ে চিকিৎসা বন্ধ করে দিলে পরবর্তীতে এসব অঙ্গ বিকল হয়ে রোগী মৃত্যুবরণ করতে পারে। এজন্য পরবর্তীকালীন চিকিৎসা করাতে হয়। রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে এই চিকিৎসা ২ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। 

সর্বশেষ জরিপ অনু্যায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১৫ হাজার সর্পদংশনের ঘটনা ঘটে এবং প্রায় ৭ হাজার ৫০০ মানুষ সাপের দংশনে মারা যাচ্ছে। ২০১৮ সালের ফরিদ আহসান ও আবু সাঈদ কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণাপত্র 'ডিস্ট্রিবিউশন অভ রাসেলস ভাইপার ইন বাংলাদেশ'-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ২০টি রাসেলস ভাইপার দংশনের ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে ৮ জন রোগী ওঝার কাছে চিকিৎসা গ্রহণ করেন এবং বাকিদের মধ্যে অধিকাংশই ওঝার কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করে পরে হাসপাতালে আসেন। এদের অধিকাংশই ওঝার অপচিকিৎসা অথবা দেরি করে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। 

বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজে সাপের কামড়ের চিকিৎসা হয়। মূলত তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অজ্ঞতা ও অসেচতনতা, দারিদ্র্য, ওঝা-কবিরাজের অপচিকিৎসায় ভরসা করা, হাসপাতালে না যাওয়া অথবা দেরি করে যাওয়া, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুন্নত পরিবহন ও যাতায়াত ব্যাবস্থা, ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনমের মজুৎ না থাকা, উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে আইসিইউ ও অ্যান্টিভেনম না থাকা ইত্যাদি বাংলাদেশে সর্পদংশনে মানুষের মৃত্যুর প্রধাণ কারণ হিসেবে সামনে উঠে এসেছে।

চন্দ্রবোড়া ও পরিবেশ

বর্তমান সময়ে অধিক চাষাবাদের জন্য নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বনভূমি ও চরের প্রাকৃতিক প্রাণীর আবাস নষ্ট করা, গণহারে চন্দ্রবোড়া সাপের প্রাকৃতিক শিকারি প্রাণী, যেমন খেঁকশিয়াল, বেজি, তিলা নাগ ঈগল, খাটাশ, বনবিড়াল, প্যাঁচা ইত্যাদি হত্যার কারণে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আর বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণেই রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। 

দেশের প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খল সম্পুর্ন ভেঙে পড়েছে। আগে বনবিড়াল, গোখরা, দাঁড়াশ, খেঁকশিয়াল, প্যাঁচা, কালোবাজসহ বেশ কিছু পাখি মাঠের ইঁদুর খেয়ে সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করত। মানু্ষের নির্মমতায় এরা প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। ফলে মাঠে ইঁদুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যাপ্ত খাদ্য থাকায় চন্দ্রবোড়া সহজেই সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে। 

বেজি, গুইসাপ, খেঁকশিয়াল, খাটাশ, তিলা নাগ ঈগল, কালকেউটে, শঙ্খিনী, প্যাঁচা ইত্যাদি প্রাণী চন্দ্রবোড়ার বাচ্চা খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করত। মানুষের আগ্রাসনে এরাও আজ বিপন্নপ্রায়। ফলে চন্দ্রবোড়া নির্বিঘ্নে বংশবিস্তারের সুযোগ পাচ্ছে। 

তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়া এবং মাটির উপরিভাগের পরিবর্তনের বিষয়টিও চন্দ্রবোড়া ছড়িয়ে পড়ার আরেকটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। 

চন্দ্রবোড়া ইস্যুতে যে গুজব ও ভ্রান্ত সংবাদ প্রচার করে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে, তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে দেশের অন্যান্য বন্যাপ্রাণী ও সাপের ওপরে। সারাদেশে চন্দ্রবোড়া সন্দেহে ব্যাপক হারে ঘরগিন্নি, অজগর, গোলবাহার অজগর, মেটেসাপ, নোনাবোড়া, হেলে, ফনিমনসা, বালুবোড়াসহ আরো অনেক জাতের নির্বিষ বা মৃদু বিষধর সাপ ও গুইসাপ হত্যা করা হচ্ছে যেগুলো মানুষের জন্য মোটেও ক্ষতিকর নয়। এমনটা চলতে থাকলে অতি দ্রুতই আরো বড় ধরনের বাস্ততান্ত্রিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ব আমরা। 

প্রকৃতিতে প্রতিটি প্রাণীরই ভূমিকা রয়েছে। বাস্ততান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষা ও খাদ্যশৃঙ্খলের গতিশীলতা বজায় রাখতে সাপ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। এরা যে শুধু ইঁদুর খেয়ে আমাদের ফসল রক্ষা করে তা-ই নয়, নিজে অন্যান্য শিকারি প্রাণীর খাদ্য হয়ে খাদ্যশৃঙ্খলের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়তা করে।

আমাদের করণীয় কী?

চন্দ্রবোড়ার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো সচেতনতা। আমরা সচেতনভাবে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় অনুসরণ করলেই উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারব। সাপ দেখতে পেলেই মারতে যাওয়া উচিত নয়, দুর্ঘটনাবশত কামড় খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাথা ঠান্ডা রেখে দূরে সরে যেতে হবে। 

বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং ইঁদুর ও পোকামাকড় দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। রাতে যেকোনো কাজ করার সময় আলোর ব্যবহার করতে হবে। মাঠে বা ধানখেতে কাজ করার সময় গামবুট ও মোটা কাপড়ের প্যান্ট পরিধান করতে হবে এবং মাটিতে শব্দ করতে হবে। সাপ যদি আশেপাশে থাকেও, তাহলে চলে যাবে। 

সাপের কামড়ের রোগীকে শান্ত রাখতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে। সাপ ধরার চেষ্টা করা, সাপ মারা বা ওঝার কাছে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করা যাবে না। ওঝা বা কবিরাজরা সাপের বিষের চিকিৎসা করতে পারেন না। যত দ্রুত সম্ভব অ্যান্টিভেনম দিতে হবে, সম্ভব হলে ১০০ মিনিটের মধ্যে।

চন্দ্রবোড়ার বিষ হেমোটক্সিন, তাই বাঁধন দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ভাইপারদের হেমোটক্সিন বিষ রক্তে প্রভাব ফেলে। কামড়ের ক্ষত দিয়ে অনবরত রক্তক্ষরণ হয়। তাই চন্দ্রবোড়ার কামড়ে বাঁধন দেওয়া, ওঝার কাছে নিয়ে কাটাছেঁড়া করা আরও বেশি বিপজ্জনক। 

যেকোনো ধরনের গাছ-গাছড়া, পান, মরিচ খাওয়ানো অথবা স্থানীয় টোটকা চিকিৎসা থেকে বিরত থাকতে হবে। যে অঙ্গে কামড়েছে, সেটা নড়ানো যাবে না ও হাঁটাচলা করা যাবে না। হাঁটলে রক্ত দ্রুত প্রবাহিত হয়, বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। 

অ্যান্টিভেনম নিয়ে সুস্থ হবার পরও চিকিৎসা বন্ধ করা যাবে না। চিকিৎসকের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে, যাতে পরবর্তীতে জটিলতা দেখা দিলে তার চিকিৎসা সময়মতো করা যায়। 

কার্বলিক অ্যাসিড সাপ তাড়াতে কার্যকরী বলে প্রমাণিত নয়। তাই এটা বাড়িতে রাখা যাবে না। দুর্ঘটনাবশত শিশু বা পোষা প্রাণীর গায়ে পড়লে পুড়ে যেতে পারে। যেকোনো ধরনের বণ্যপ্রাণী ধরা, মারা, ধাওয়া করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে।

চন্দ্রবোড়া সাপ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা সৃষ্টি, সঠিক তথ্যের ব্যাপক প্রচারণা ও বিভিন্ন গুজব প্রতিহত করার মাধ্যমে জনগনের মন হতে এ সাপের প্রতি অহেতুক ভীতি দূর করা সম্ভব। দেশের অন্তত উপজেলা পর্যায়ের প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ ও আইসিইউ ব্যাবস্থা এবং সাপের কামড়ের সঠিক চিকিৎসাসেবা চালুর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে আশা রাখি। 

চন্দ্রবোড়া সাপ মেরে ফেলার মাধ্যমে এর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা কোনো সঠিক সমাধান নয়। আমাদের বাস্তুতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিয়াল, খাটাশ, বেজি, প্যাঁচাসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও প্রাণীর প্রাকৃতিক আবাস সংরক্ষণের মাধ্যমেই একমাত্র সঠিক উপায়ে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। 

আমরা প্রকৃতির সাথে যেমন আচরণ করব, প্রকৃতি আমাদের সেভাবেই ফিরিয়ে দেবে। আমাদের বোঝা উচিত, প্রকৃতি বাদ দিয়ে মানুষ এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে না। মানুষ ও সাপের সহাবস্থান নিশ্চিতকরণে বন বিভাগ, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, সর্পবিশারদসহ সব সচেতন নাগরিককে এগিতে আসতে হবে। মানুষ বেঁচে থাকুক, চন্দ্রবোড়া বেঁচে থাকুক, প্রতিটি বণ্যপ্রাণী বেঁচে থাকুক; এই পৃথিবীটা আমাদের সবার। আসুন আমরা নিজেরা সচেতনতা হই, অন্যদেরকে সচেতন করি। নিজেদের টিকে থাকার তাগিদে প্রকৃতি রক্ষা করি।


 

  • শুভব্রত সরকার: পোগ্রাম ম্যানেজার, ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন, ঢাকা

 

Related Topics

টপ নিউজ

রাসেলস ভাইপার / চন্দ্রবোড়া / সাপ / সাপের কামড়

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.

MOST VIEWED

  • নিরাপত্তা উদ্বেগে ১২ দেশের নাগরিকের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা
  • আঞ্চলিক পরমাণু জোট নিজ দেশে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করবে ইরান
  • ডিজিটাল ওয়ালেটের লাইসেন্স পেল গ্রামীণ টেলিকমের প্রতিষ্ঠান 'সমাধান'
  • টাকার নতুন নোটের খোলাবাজারে দ্বিগুণ মূল্য, গ্রাহক হয়রানি চরমে
  • দোকানে হানা দিলো হাতি, খাবার খেয়ে ‘টাকা না দিয়েই’ পালালো!
  • সাভার ট্যানারির কঠিন বর্জ্য থেকে জেলাটিন ও শিল্প প্রোটিন গুঁড়া উৎপাদন করবে চীনা কোম্পানি

Related News

  • লাগেজে ৪৭ বিষধর ভাইপার সাপ, মুম্বাই বিমানবন্দরে আটক ভারতীয়
  • সাপের বিষ শরীরে নিয়েছেন শতবার, তার রক্তেই তৈরি হলো ১৯ প্রজাতির অ্যান্টিভেনম
  • অস্ট্রেলিয়ার পাহাড়ে নিখোঁজের ৬ দিন পর সাপে কামড়ানো নারীকে পাওয়া গেল
  • বন্যার পানিতে সাপ: লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীতে কয়েক দিনে সাপের কামড়ে চিকিৎসা নিয়েছে শতাধিক
  • দেশে সর্বপ্রথম কিং কোবরার ডিম থেকে কৃত্রিম উপায়ে ফুটল ২৫টি বাচ্চা

Most Read

1
আন্তর্জাতিক

নিরাপত্তা উদ্বেগে ১২ দেশের নাগরিকের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা

2
আন্তর্জাতিক

আঞ্চলিক পরমাণু জোট নিজ দেশে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করবে ইরান

3
বাংলাদেশ

ডিজিটাল ওয়ালেটের লাইসেন্স পেল গ্রামীণ টেলিকমের প্রতিষ্ঠান 'সমাধান'

4
অর্থনীতি

টাকার নতুন নোটের খোলাবাজারে দ্বিগুণ মূল্য, গ্রাহক হয়রানি চরমে

5
অফবিট

দোকানে হানা দিলো হাতি, খাবার খেয়ে ‘টাকা না দিয়েই’ পালালো!

6
অর্থনীতি

সাভার ট্যানারির কঠিন বর্জ্য থেকে জেলাটিন ও শিল্প প্রোটিন গুঁড়া উৎপাদন করবে চীনা কোম্পানি

EMAIL US
contact@tbsnews.net
FOLLOW US
WHATSAPP
+880 1847416158
The Business Standard
  • About Us
  • Contact us
  • Sitemap
  • Privacy Policy
  • Comment Policy
Copyright © 2025
The Business Standard All rights reserved
Technical Partner: RSI Lab

Contact Us

The Business Standard

Main Office -4/A, Eskaton Garden, Dhaka- 1000

Phone: +8801847 416158 - 59

Send Opinion articles to - oped.tbs@gmail.com

For advertisement- sales@tbsnews.net