এসময়ে সামাজিক সমঝোতা গুরুত্বপূর্ণ কেন

রাজনীতিতে নাকি 'শেষ কথা' বলে কিছু নেই। আর সে কারণেই রাজনীতি সর্বদা এক অনিশ্চয়তার পথে হাঁটে। ইতিহাস এই বয়ানের পক্ষে দাঁড়ায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প কি জানতেন – নির্বাচনে তার পরাজয় ঘটবে? যেমন জানতেন না '৭১-এ গ্রামের যে ছেলেটি যুদ্ধে গিয়েছিল, দেশ কখন-কীভাবে স্বাধীন হবে। বা একেবারে হাল আমলে আমরা কেউ জানি না- দেশ কোথায় যাচ্ছে। বিরোধীদের দাবি মোতাবিক, নাকি সংবিধান অনুযায়ী? নির্বাচন কোন পথে এগুচ্ছে? দেশের অবস্থা কী দাঁড়াবে? এ রকম নানা প্রশ্ন- যা বিভিন্ন অনিশ্চয়তার জন্ম দিচ্ছে। সমাজকে করে তুলছে অস্থির।
এই অস্থিরতার কারণ, রাজনৈতিক দল বা তাদের নেতারা যা বলেন– তা তারা করেন না। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল, "এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। শিগগিরই নতুন নির্বাচন দেওয়া হবে।" ২০১৮ এর নির্বাচনের কোন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। এই নির্বাচন (২০১৮ সালের) নিয়ে বাজারে অনেক 'অতি কথন' চালু আছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর নতুন নির্বাচনের দাবিতে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে দেশব্যাপী। আন্দোলনের সময় যত কথা বলেছিল, বিরোধীদলগুলো তা রাখতে পারেনি। এ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন নয়, বলেও – ২০১৮- এর নির্বাচনে অংশ নিল তারা। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়- রাজনীতি অনিশ্চয়তায় পড়ে।
গত নির্বাচনের পর সরকার প্রধান জোট শরিকদের জানিয়ে দেন, এবার থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তার মানে হলো, কেবল নৌকায় ভর দিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করলে চলবে না। অনুগত শরিকরা দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কাউকে মশাল কাউকে বা হাতুড়ি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে দেখা যায়। এখন দেখার বিষয় আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে শরিকরা দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে কি-না। এখানেও 'শেষ কথা' বলে কিছু নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পও কিন্তু ক্যাপিটল হিল দখলে নিতে চেয়েছিলেন 'গণতন্ত্র' রক্ষার নামে!
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের জন্মগতভাবেই অর্জিত। ১৯৭১- এর মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি কী হবে তা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যোদ্ধারা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত বুঝতে পারছিলেন না। সেই ধারাই চলছে আজও। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও একাধিকবার অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, তারপরও সাধারণ জনগণ সবসময় ভাবতো একটা কোন সমঝোতা হবেই। কিন্তু, এবার তা ভাবছে না। মাঠের রাজনীতি অতীতে অন্তত দু'বার সমঝোতা হয়েছিল পর্দার অন্তরালে, পক্ষগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই আমরা সেই সমঝোতার কোনো সন্ধান পাচ্ছি না। পক্ষ-বিপক্ষের হুংকার আর গর্জন শুনছি।
এর মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপস্থিতি আরও তীব্র হয়েছে। অতীতেও রাজনৈতিক সংকটে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির উপস্থিতি দেখেছি। জাতিসংঘের পদচারণা দেখেছি। কিন্তু এবারকার মতন এতটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কখনো দেখিনি। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বৈদেশিক আয়ের প্রধান কেন্দ্র। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি দুই ক্ষেত্রেই আমরা মার্কিনীদের উপর নির্ভরশীল। সেই দিকটি আমাদের চিন্তা থেকে হারিয়ে গেছে কিনা– সেটিও একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনকার এই হুংকারে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ফসল কার ঘরে উঠবে আমরা জানি না। কিন্তু, দেশের অর্থনীতি যে একটি চরম সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নাই।
দেশের চলমান মুদ্রাস্ফীতি, পণ্য মূল্য জনজীবনকে দারুণ সংকটের মধ্যে ফেলেছে। প্রতি মাসেই বৈদেশিক মুদ্রা রেমিটেন্স অথবা এক্সপোর্ট- দুই ক্ষেত্রেই চাহিদার তুলনায় ব্যাপকভাবে পিছিয়ে পড়ছি। ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংস্থান করতে পারছে না তাদের কাঁচামাল কিংবা বাণিজ্যিক আমদানির প্রয়োজনে।
দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মালিক পক্ষই কেবলমাত্র আমদানি করার সুবিধাভোগ করছেন। ফলে সমাজের যে প্রচলিত ধারণা সিন্ডিকেট ব্যবস্থা তা সুস্পষ্টভাবে সামনে আসছে। দেশের আমদানি খাত বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে । বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর প্রায় সকলেই ব্যাংক মালিকদের অংশ। অন্যদিকে পণ্যমূল্য নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হচ্ছে মাঝেমধ্যে। দেখতে পারছি ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা বাজার তদারকি করতে সরাসরি খুচরা বিক্রেতার উপর চড়াও হচ্ছে।
দেশের মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে নানান মতামত চলছে। কেউ কেউ বলছেন, আইএমএফ এর পরামর্শে ডলারকে মুক্ত মূল্য করতে হবে– অর্থাৎ বাজার চাহিদা অনুসারে ডলারের মূল্য নির্ধারিত হবে। বিশ্বব্যাংকের এই তত্ত্ব পৃথিবীর নানান দেশে দেওয়া হয়েছে। আর্জেন্টিনা এই তত্ত্বের খপ্পরে পড়ে সবচেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতির শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশে হুন্ডির চাহিদা মূলত অবৈধপথে অর্জিত টাকার সংরক্ষণকারীদের জন্য। যতদিন পর্যন্ত না সুশাসনের মাধ্যমে এই অবৈধ আয় বন্ধ হবে – ততদিন পর্যন্ত হুন্ডি ব্যবস্থা চালু থাকবে। যেকোন ভাবেই মূল্য নির্ধারণ হোক না কেন, হুন্ডির মাধ্যমে যারা বিদেশে টাকা পাচার করে তাদের জন্য ডলারের মূল্যমান কোন বিষয় নয়। এই মুহূর্তে খোলা মুদ্রাবাজারের সাথে ডলারের সরকারিভাবে বেধে দেওয়া ব্যাংক রেটের প্রায় সাত থেকে আট টাকা তফাৎ। ফলে ফ্লোটিং রেট করলেও হুন্ডি বন্ধ হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
কিছু বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠীকে বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য অনুমতি দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এদেশের মানুষ জানে না এসব কোম্পানি তাদের বিনিয়োগের মাধ্যমে কি পরিমাণ মুনাফা করলো এবং বাংলাদেশ সেই টাকার কতটুকুই বা ফেরত পেল। বৈদেশিক মুদ্রার এ তথ্য অপ্রকাশিত। বিদেশে কত মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার জন্য এসব কোম্পানিকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তার সঠিক তথ্য পাওয়া খুব কঠিন। কারণ কোন কোন কোম্পানির বিদেশে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ও বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত বৈদেশিক মুদ্রা যা তারা ওই দেশে বিনিয়োগ করেছে, তার মধ্যে গরমিল আছে বলে শোনা যায়। কিংবা এসব কোম্পানি দেশ থেকে বাইরে বিনিয়োগ করা বৈদেশিক মুদ্রার কতটুকু দেশে ফেরত এনেছে, তার কোন তথ্য আমরা জনগণ জানি না।
মূল সংকট, স্বচ্ছতার ঘাটতি। সঙ্গে অনিশ্চিত রাজনীতি মানুষকে আরও বেশি বিভ্রান্ত করছে। একটি দল যারা ক্ষমতার বাইরে– তারা মূলত বৈদেশিক শক্তিগুলোর উপরে নির্ভর করছে। এ দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য মাঝে মাঝেই বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে দেখা যাচ্ছে, তবে সেই কর্মসূচির মাধ্যমে যে এই সংকট কাটবে, তার কোন ইঙ্গিত আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
অতীতে যখন এই রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় ছিল, তখনকার বিরোধী দলের আন্দোলন রাজপথের এই দলটি ক্ষমতায় থেকে সামাল দিতে পারেনি। কিন্তু, এখন যারা ক্ষমতায় আছে তারা রাস্তার আন্দোলনকে খুব সাংগঠনিকভাবে দমন করতে পেরেছে। বিরোধীরা রাস্তার আন্দোলনে বিজয়ী হবে তেমন কোন সম্ভাবনা দেখা যায় না। এবং তারা যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, এমন পরিস্থিতি হলে আগামী নির্বাচন একতরফা নির্বাচনে পরিণত হয়ে যাচ্ছে কি?
আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের দেশের অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশাল ভূমিকা আছে। শুধু ঋণ কিংবা অনুদানে নয়, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন এক নাম্বার দেশ। আমাদের রপ্তানি পণ্যের এককভাবে সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের মানবাধিকার, সুশাসন ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে তাদের অসন্তুষ্টির কথা তারা আগেই জানিয়েছে। মানবাধিকার, সুশাসন ও গণতন্ত্রের প্রশ্নটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অর্জিত হতে পারে। সেরকম একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রশ্নে মার্কিনীরা শক্ত অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বিনষ্টকারী যেই হোক, তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে না বলে স্পষ্ট করে জানিয়েছে। ফলে সব মহলকে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। যেনতেন নির্বাচন আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনবে।
আজকের ভিসা অবরোধকে যদি আগামীদিনে আরও বড় কোন অবরোধের দিকে ঠেলে পাঠানো হয়– তাহলে আমাদের অর্থনীতি যে মুখ থুবড়ে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে রাখতে হবে, আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির খুবই ভঙ্গুর দশা। আমাদের দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের যে সংখ্যা পরিসংখ্যান ব্যুরো সরবরাহ করে, প্রকৃত চিত্র তার থেকে অনেক বেশি। আর শহুরে দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর দায়ভার এতটাই বেশি যে, তা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে আমাদের গ্রাজুয়েশনের কথা শুনি বটে, তবে প্রকৃত সক্ষমতা অর্জনে আরও অনেকটা পথ যেতে হবে। আর সেজন্যই দরকার সামাজিক সমঝোতা, যা আসলেই ন্যূনতম পর্যায়ে গড়ে উঠবে কিনা সেটি বড় প্রশ্ন।