আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে কেন ব্যাঙকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে?

ঝুম বৃষ্টিহ চ্ছে বাইরে। বাসে সিট না মেলায় ইঞ্জিন কভারে বসেই ফিল্ডওয়ার্ক শেষে যাচ্ছি ঢাকার উদ্দেশে গঙ্গা নিম্ন অববাহিকার এক এলাকা থেকে। সারারাত ইঞ্জিন কভারে যেহেতু বসে যেতে হবে তাই ঘুমানোর কোন উপায় নেই। সামনে বৃষ্টিভেজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ পড়ল রাস্তা পারাপার হওয়া ব্যাঙের দিকে। কিন্তু যা দেখলাম তা দুঃখজনক, অধিকাংশ ব্যাঙই মারা পড়ছে ব্যস্ত রাস্তার গাড়ির চাকার নিচে। দেখে এটাই মনে হলো, আমাদের দেশে মেগা ফনারা যেরকম সংরক্ষণে গুরুত্ব পাচ্ছে, আমাদের খুব কাছাকাছি বসবাসকারী প্রকৃতির পরম বন্ধু ব্যাঙ কি সংরক্ষণের ব্যাপারে আদৌ গুরুত্ব পাচ্ছে? বা আমাদের কি কোনো দরকার আছে ছোট এই প্রাণীটিকে বাঁচানোর?
পুরো বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকাই জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। আর জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্যাঙ। আন্তর্জাতিক সংস্থা Amphibian Species of The World প্রকাশ করেছে সারা বিশ্বে ব্যাঙের প্রজাতির সংখ্যা ৭ হাজার ৬০৩টি। এর মধ্যে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চ ল্যাবরেটরির একটি গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের বিগত ৫০ বছরের ব্যাঙের ওপর প্রায় ১৫০ প্রকাশিত গবেষণাপত্র পর্যালেচনা করে দেখা যায়, বর্তমানে ব্যাঙের সংখ্যা ৬৩টি।
ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণী ব্যাঙ যেমন প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ায় তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর তার সাথে মানুষের উপকার করছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে।
উদাহরণস্বরূপ: ব্যাঙ তার শরীরের দ্বিগুণ পোকামাকড় খেতে পারে। ফসলের খেতে এই পোকামাকড় ফসলের ক্ষতি করে। এতে করে অতিরিক্ত কীটনাশক যেমন প্রয়োগ করতে হয় না, তেমন ঠিক থাকে ফসলের গুণগত মান ও মাটির গুনাগুণ। আর ঠিক থাকে প্রকৃতির ভারসাম্য। আবার ব্যাঙের মূত্রে ইউরিয়া-জাতীয় পদার্থ থাকে যা জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং ফসলের উৎপাদন তরান্বিত করে। একটি হিসাবে দেখা গেছে, একটি ব্যাঙ তার পুরো জীবনে প্রায় ৪ লক্ষ টাকার ফসল রক্ষা করে।
ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়াসহ বিভিন্ন মশাবাহিত রোগের বাহক মশার লার্ভা ব্যাঙাচি অবস্থায় খেয়ে থাকে ব্যাঙ। যা কিনা মশা দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন, নগরায়নের ফলে তাদের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে যেমন, ঠিক তেমনি তাদের প্রজনন ক্ষেত্রও নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে কমছে তাদের সংখ্যা। প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। আর তার থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো মানবজাতি।
একটি ব্যাঙের উপস্থিতি নির্দেশ করে পরিবেশ কতটা সুস্থ অবস্থায় আছে। এই হিসাবে সে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার একটি নির্দেশক হিসাবে কাজ করে।
কিন্তু পরিবেশের এই পরম বন্ধু ব্যাঙ বাংলাদেশে কি অবস্থায় আছে বা এদের খবর কি?
আমাদের দেশে বিগত ৫০ বছরের বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে ব্যাঙের প্রজাতিগত সংখ্যা ৬৩টি। কিন্তু আমাদের বন্যপ্রাণীবিষয়ক বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই সংখ্যাটি ১০০-র উপর। আর বিগত ১২ বছরে বাংলাদেশ মোট ২৪টি নতুন ব্যাঙের সন্ধান মিলেছে, যার মধ্যে ৯টি ব্যাঙই শুধু যে বাংলাদেশের জন্য নতুন তা নয়, পুরো পৃথিবীর জন্যই নতুন। ২০১৫ সালে আইইউসিএন বাংলাদেশের মূল্যায়িত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪৯ প্রজাতির উভচরের মধ্যে ৯ প্রজাতির ব্যাঙকে বিলুপ্তির ঝুঁকির লাল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কিন্তু আমাদের সংরক্ষিত এলাকাগুলোর বাইরে এই নতুন আবিষ্কৃত ব্যাঙ বা বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা ব্যাঙের একটি বড় অংশ রয়েছে। আমাদের হুমকিগ্রস্ত ৯টি ব্যাঙের মধ্যে ৬টি ব্যাঙই সংরক্ষিত এলাকার বাইরে এমনকি নতুন আবিষ্কৃত ২৪টি ব্যাঙের মধ্যে ৯টি আবিষ্কৃত হয়েছে সংরক্ষিত এলাকার বাইরে থেকে। এমনকি ঢাকাইয়া ঝিঁঝি ব্যাঙ পাওয়া গেছে দূষিত শহর ঢাকা থেকে। উত্তরপূর্বাঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত সব ব্যাঙই কয়েকটি সংরক্ষিত এলাকা থেকে। এই তথ্য এটাই নির্দেশ করে যে, ব্যাঙ নিয়ে এই অঞ্চলে আরও বিস্তৃত গবেষণা হলে নতুন নতুন আরও অনেক ব্যাঙের তথ্য বের হয়ে আসবে।
আমাদের উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের চিরসবুজ বা মিশ্র চিরসবুজ বন বন্যপ্রানীর জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হলেও আমাদের সারা দেশই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, গঙ্গা অববাহিকায় তিন ধরনের বিপন্ন প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়া যায় এবং ২ প্রজাতির নতুন ব্যাঙ এখান থেকে পাওয়া গেছে। এরকম প্রতিটি অঞ্চলই ব্যাঙের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু আমাদের সংরক্ষিত এলাকার বাইরে ব্যাঙেরা আজ হুমকির সম্মুখীন। ক্রমশ ধ্বংস হচ্ছে জলজ পরিবেশ আর জলজ পরিবেশে টিকে থাকা ব্যাঙের সংখ্যাও ক্রমশ কমে যাচ্ছে। জলজ পরিবেশ দূষণ, জলজ পরিবেশের গুণগত মান নষ্ট হওয়া, জলজ পরিবেশের নিয়ামকগুলোর মান নষ্ট হওয়া, জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, শহরের আয়াতন ক্রমশ বৃদ্ধি, ক্রমশ প্রাকৃতিক পরিবেশের বিলুপ্তি, রাস্তায় অতিরিক্ত যানবাহনের ফলে ব্যাঙের দুর্ঘটনায় মৃত্যু, পাহাড়ে অবৈধভাবে ব্যাঙ শিকার ইত্যাদি কারণে প্রাণীটিরর সংখ্যা আজ কমে যাচ্ছে। সংরক্ষিত এলাকার বাইরে আমাদের অগোচরে কত ব্যাঙ যে নেই হয়ে যাচ্ছে, তা আমরা চিন্তাও করতে পারছি না।
তাই সময় এসেছে আমাদের এই সংরক্ষিত এলাকার বাইরে পরিবেশের এই পরম বন্ধু ব্যাঙের সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়ার। বড় কোনো প্রাণী যেরকম সংরক্ষণে গুরুত্ব পায় ঠিক ওই রকম না হলেও ন্যূনতম গুরুত্ব যেন বাংলাদেশে এই ছোট ব্যাঙেরা পায়।
- লেখক: ওয়াইল্ডলাইফ ইকোলজিস্ট, সিইজিআইএস বাংলাদেশ