আপনি কি আপনার ইমার্জেন্সি ফান্ড গঠন করেছেন?

আমাদের দেশে পার্সোনাল ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট মূলত নতুন একটা বিষয়। আমরা বেশিরভাগ লোকই যার সম্পর্কে জানি না। যেহেতু জানি না, তাই সে ব্যাপারে পরিকল্পনা করার কথা মাথায় আসার কথাও না। পরিকল্পনা বা প্ল্যানিং এর ক্ষেত্রে রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানিং, চাইল্ড এডুকেশন প্ল্যানিং, বাড়ি কেনার জন্য প্ল্যানিং, সন্তানকে বিদেশে পাঠানোর জন্য প্ল্যানিং, ওয়েলথ বিল্ডিং প্ল্যানিং এগুলো যতটা সুপরিচিত; ইমার্জেন্সি ফান্ডের ব্যাপারে যে প্ল্যানিং করতে হয়– বিষয়টা তত পরিচিত নয়। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মানুষেরা নিজেদের ইমার্জেন্সি চাহিদা পূরণের জন্যেও যে ফান্ড থাকতে হবে– এটা নিয়ে চিন্তা করেন না। কারণ এখানে একজন আত্মীয় আরেকজন আত্মীয়কে সাহায্য করে, একজন বন্ধু আরেকজন বন্ধুকে সাহায্য করে। কিন্তু, আমার মনে হয়, আমরা নিজেরা একটু সচেতন হলে, যখন আমাদের পরিবারে বিশেষ কোন ইমার্জেন্সি আসে, সেটা মেডিকেল ইমার্জেন্সি হোক বা চাকরি হারানো– তখন সেটাকে আমরা নিজেরা সমাধান করতে পারি, অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই– যদি আমরা নিজেরা একটু প্রস্তুত থাকি।
ইমার্জেন্সি ফান্ড ম্যানেজমেন্ট মূলত পার্সোনাল ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্টের একটা অংশ। এখন একটু জানার চেষ্টা করি, ইমার্জেন্সি ফান্ড মূলত কি? ধরুন আপনি চাকরি করছেন বা কোনো ব্যবসা করছেন। হঠাৎ আপনার চাকরি চলে যেতে পারে বা আপনি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন এবং আপনার আয় না থাকতে পারে। যখন আপনার আয় থাকবে না, তখন তো আপনার খরচ থাকবে। আপনি তো টাকা ছাড়া একদিনও চলতে পারবেন না। আপনার জীবনের এই বিশেষ কোনো সময়ে 'ইমার্জেন্সি মিট' করার জন্যে যে টাকা লাগে সেটাই আসলে ইমাজেন্সি ফান্ড।
ইমার্জেন্সি ফান্ড আপনার আয় যখন থাকবে, তখন জমিয়ে জমিয়ে রাখবেন। অর্থাৎ আপনি চাকরি থাকতেই মাসে মাসে সংগ্রহ করে একটা জায়গায় রাখবেন, যেন আপনি ইমার্জেন্সি পরিস্থিতিতে পড়লে তখন ব্যবহার করতে পারেন। প্রশ্ন হচ্ছে ইমার্জেন্সি ফান্ড কত দিনের জন্য রাখবেন এবং কী পরিমাণ টাকা রাখবেন? তারপর ওই টাকা আপনি কোথায় রাখবেন?
ইমার্জেন্সি ফান্ড মূলত কয় মাসের জন্যে রাখতে হবে? এটা নির্ভর করছে আপনি কি ধরনের চাকরি করছেন; আপনার শারীরিক অবস্থা; পারিপার্শ্বিক অবস্থা; পারিবারিক অবস্থা কেমন তার ওপর ভিত্তি করে। আপনার যদি চাকরি একমাত্র আয়ের পথ হয়ে থাকে তাহলে এক রকম। আপনার যদি মনে হয়, আপনি চাকরি করছেন, পাশাপাশি আপনার অন্যান্য ইনকামও আছে, যেমন আপনার বাড়ি ভাড়া আসে, আপনার অনান্য প্যাসিভ ইনকামও আছে তাহলে আবার অন্যরকম। তার মানে যদি আপনার অনান্য ইনকামের উৎস থাকে তাহলে আপনার প্ল্যানিং এক রকম, আর যদি শুধু আপনি চাকরি নির্ভর হয়ে থাকেন- তাহলে আপনার প্ল্যানিং অন্যরকম। আমরা ধরে নিচ্ছি যে, আপনি শুধু চাকরির উপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে এটা নির্ভর করবে পুরোপুরি আপনার পারিবারিক অবস্থা, আপনার শারীরিক অবস্থার ওপর, অর্থাৎ সবকিছু আপনি কেন্দ্রিক।
ইমার্জেন্সি ফান্ড মূলত তিন মাস থেকে এক বছরের জন্য রাখা ভালো। আর অতি ভালো হচ্ছে দুই বছরের জন্য রাখতে পারলে। তার মানে যে কয় মাসের জন্য আপনি রাখতে চান, আপনি হিসেব করুন একমাস চলতে আপনার কত খরচ যায়। বাড়ি ভাড়া, খাবার দাবারের খরচ, ইউটিলিটি, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, বাবা-মার জন্য যে টাকা পাঠাতে হয় সেটা, যদি কোন সঞ্চয় স্কিম থাকে সেটা, আরও যদি কোনো বাধ্যতামূলক খরচ থাকে- সেগুলোর সম্মিলিত খরচই হচ্ছে আপনার এক মাসের ইমার্জেন্সি ফান্ড। এবার এক বছরের হলে ১২ দিয়ে গুণ করে হিসাব বের করুন আর ছয় মাসের হলে ছয় দিয়ে গুণ করুন।
একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই ইমার্জেন্সি ফান্ড এর জন্যে আপনার ইন্সুরেন্সের জন্যে যে ফান্ডটা আপনারা কাটবেন, রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানিং-এর জন্য যেটা কাটবেন যেমন ওয়েলথ বিল্ডিং প্ল্যানিং, ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানিং অথবা আপনার সন্তানকে উচ্চ শিক্ষার বিদেশে পাঠানোর জন্য যে প্ল্যানিং– এসব প্ল্যানিং এর আগেই কিন্তু ইমার্জেন্সি ফান্ড আপনার একপাশে সরিয়ে রাখতে হবে। তারপর আপনি এইসব প্ল্যানিং করতে পারবেন। ইমার্জেন্সি ফান্ড হওয়া উচিৎ সবার আগে। তারপর অন্যান্য প্ল্যানিং করা ভাল।
তাহলে এই টাকা আপনি রাখবেন কোথায়?
এটা নিয়েও নানান মানুষের নানান মত আছে। কেউ কেউ বলেন এই টাকা সেভিংস একাউন্টে, কেউ বলেন কারেন্ট একাউন্টে রাখতে, কেউ বলেন এই টাকা ইনভেস্ট করতে। কিন্তু একটা বিষয়ে সবাই একমত যে, আপনি এই টাকাটা এমন জায়গায় রাখবেন- যেন যখন চান তখন সহজেই নগদে রূপান্তর করতে পারেন।
তাহলে নগদ পেতে হলে এটাকে নগদ আকারে রাখতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি আমি সেভিংস একাউন্টে রাখবো? কিন্তু সেভিংস একাউন্ট থেকে আপনি যেকোনো সময়ে টাকা তুলতে পারলেও এখানে আপনাকে খুব অল্প ইন্টারেস্ট দেয়। আবার কারেন্ট একাউন্টে রাখবেন? কিন্তু কারেন্ট একাউন্টে আপনাকে কোনো ইন্টারেস্ট দেয় না। তারপর আপনি কি লংটার্ম এফডিআর- এ রাখবেন; আপনি কি স্টক কিনবেন; আপনি কি সরকারি সঞ্চয়পত্র কিনবেন? এরকম অনেকগুলো বিষয় আছে। কিন্তু, আপনাকে দুটো বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এক হচ্ছে, এমন কোথায় এই টাকা ইনভেস্ট করা যাবে না, যেটা আপনার 'লকড ইন' এর আওতায় পরে। অর্থাৎ, ধরা যাক আপনি এমন কোনো স্টক কিনেছেন– যেটা আপনি আগামী এক বছরের মধ্যে আর তুলতে পারবেন না। এবং দুই হচ্ছে, এমন জায়গায় এই টাকা রাখতে পারবেন না, যেখানে এই টাকা তার মূল্য হারানোর ঝুঁকিতে পড়ে। যেমন স্টক মার্কেটে যদি আপনি রাখেন, আপনার এই টাকা অনেক লাভ হতে পারে আবার অনেক লোকসানও হতে পারে। ধরুন আপনি ১০০ টাকা দিয়ে একটা শেয়ার কিনলেন। কিন্তু, যখন টাকাটা আপনার খুব দরকার, তখন হয়ত দেখবেন সেই শেয়ারের দাম ২০ টাকা। এমন হওয়াটা অসম্ভব কিছু না।
এই ফান্ড মূলত এমন জায়গায় রাখতে হবে, যেন এটা আপনি সহজে তুলে আনতে পারেন, এবং তার সাথে যেন এর মূল্যমান না হারায়। এটা সেভিংস একাউন্টে না রেখে যদি আপনি ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর) করেন, এখন আপনার ৩ মাস মেয়াদি, ৬ মাস মেয়াদি, ১ বছর মেয়াদি এফডিআর- এর সুবিধা আছে তাহলে ভাল মুনাফা বা সুদ পেলেন– আবার প্রয়োজনে সহজে নগদায়নও করতে পারলেন। ধরুন যদি আপনি ৩ মাস মেয়াদি একটা এফডিআর করলেন, যা ৩ মাস পর পর অটোরিনিউ হতে থাকবে তাহলে কোনো সমস্যা থাকল না, আপনি সুদ বা মুনাফা পেলেন– এবার প্রয়োজনে নগদেও পরিণত করতে পারলেন।
এই টাকা স্টক মার্কেটে ইনভেস্ট করতে আমি নিষেধ করছি, তেমন আবার আপনি এটা দিয়ে কোনো প্রোপার্টি কিনতে পারবেন না, কারণ প্রোপার্টি থেকে আপনি টাকাটা সহজে লিকুইড করতে পারবেন না।
অনেকে হয়ত এখন প্রশ্ন করবেন, ক্রেডিট কার্ডকে কি কোনো ইমার্জেন্সি ফান্ড হিসেবে বিবেচনা করা যায়? অনেকে বলবে ক্রেডিট কার্ড আপনার ইমার্জেন্সি ফান্ডের অনেক 'ক্রাইটেরিয়া মিট' করতে পারবে। কিন্তু, আমি মনে করি যে, ইমার্জেন্সি ফান্ড হিসেবে ক্রেডিট কার্ড ভালো কোনো অপশন নয়। কারণ এর রেট অব ইন্টারেস্ট অনেক বেশি, তাছাড়া এর অভ্যাস সহজে ত্যাগ করা যায় না। ক্রেডিট কার্ড আপনার বিপদকে আরও বাড়িয়ে দেবে। ইমার্জেন্সি ফান্ড আপনাকে সুরক্ষা দেবার জন্য, বিপদে ফেলার জন্য নয়।
মনে রাখতে হবে যে, ইমার্জেন্সি ফান্ড আপনার বিপদের সময় খরচ করার জন্য এবং যদি কোনো কারণে, আপনি ইমার্জেন্সি যে পুলটা করেছেন সেখান থেকে, মানে কিছু অংশ যদি আপনি ভেঙ্গে ফেলেন- তাহলে কিন্তু যখনি এটা ভেঙ্গে ফেললেন তার পরের মাসেই এটা পূরণ করে ফেলতে হবে।
আপনারা যারা এখনও ইমার্জেন্সি ফান্ড গঠন করেননি- তারা ইমার্জেন্সি ফান্ড গড়ে ফেলুন। ইমার্জেন্সি ফান্ড গঠন করতে গেলে এটাকে মূল্যায়ন করুন, গুরুত্ব দিন। তার মানে এই না যে, যে পরিকল্পনা আপনার আছে সেগুলো আপনি দূরে সরিয়ে দিবেন। কিন্তু, আবার এটাও না যে সেগুলোর কারণে এই ফান্ডটাকে আপনি গঠন করবেন না। ইমার্জেন্সি ফান্ড গঠন করে আপনার এক জায়গায় রাখতে হবে– তারপর আপনি খানিকটা চিন্তামুক্ত হবেন যে আপনার ইমার্জেন্সি ফান্ড আছে। এখন আপনি নিরাপদ বোধ করবেন, এই কারণে যে আপনার জীবনে যদি এমন কোনো মুহূর্ত আসে যখন তখন আপনি ইনকাম করছেন না, কিন্তু আপনাকে খরচ করতে হবে- তখন আপনি ইমার্জেন্সি ফান্ড এর সহায়তায় নিজেকে, পরিবারকে সেভ করতে পারবেন। বাচ্চার এডুকেশন বন্ধ হবে না। আপনার কারণে আপনার বাবা, মার কষ্ট হবে না।
তাই যারা আজও ইমাজেন্সি ফান্ড গঠন করেন নাই তারা একদিনও দেরি না করে এই ফান্ড গঠনে মনোযোগী হউন। আজ হোক আপনার পারসোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্টের শুরু। শুভ হোক আপনার এই অভিযাত্রা।
- লেখক: সাইফুল হোসেন, কলাম লেখক, অর্থনীতি বিশ্লেষক, বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট ও ইউটিউবার(finfacts)