জটিল মার্কিন নির্বাচনের মারপ্যাঁচ

মার্কিন নির্বাচন ফিরে আসে জাতীয় পর্যায়ে প্রতি দুই বছরে, কিন্তু বিশ্বের দৃষ্টি কাড়ে তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পৃথিবীর এক অদ্ভুত নির্বাচন ব্যবস্থা। দেশটির নির্বাচনে অধিক ভোট প্রাপ্তিই প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চিত করে না। গত নির্বাচনে যেমনটা ঘটেছিল ডেমোক্র্যাট দলের হিলারি ক্লিনটনের ভাগ্যে। ট্রাম্প কম ভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এর আগে আরও তিনবার একই ঘটনা ঘটেছিল ১৮৭৬, ১৮৮৮ ও ২০০০ সালে। সাধারণ ভোট বেশি পাওয়া প্রার্থীরা তখন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি।
এই জটিল নির্বাচনী ব্যবস্থার নাম ইলেকট্রোলার কলেজ ব্যবস্থা। দেশটির জনসংখ্যার ভিত্তিতে সব ক'টি রাজ্যর কংগ্রেস সদস্য সিনেট সদস্য আর ওয়াশিংটন ডিসি মিলিয়ে মোট ইলেকট্রোলার কলেজ ভোটার ৫৩৮। রাজ্যগুলোতে জনসংখ্যার পরিবর্তনে এই সংখ্যা প্রবর্তিত হয়; তবে মোট সংখ্যা একই থাকে।
দেশটির সবচেয়ে বড় রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রায় সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যা আর মোট ৫৫ ইলেকট্রোরাল কলেজ সদস্য। যে রাজ্যে যে দল জয় করে, সেই রাজ্যর সব ক'টি ইলেকট্রোরাল সদস্য সেই দলেরই।
প্রেসিডেন্ট জয়লাভে মোট ২৭০ ইলেকট্রোরাল সদস্য ভোট প্রয়োজন। ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যটি ১৮৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ইলেকট্রোরাল ভোটার এই রাজ্যে ।
১৭৮৯ সালে যখন মার্কিন সংবিধান রচিত হয়, তার আগে সবচেয়ে বড় বিতর্ক হয়- কংগ্রেস সদস্যদের ভোটে নাকি সরাসরি ভোটে- কোন পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে, তা নিয়ে। দীর্ঘ বিতর্কের পর সংবিধান রচনাকারীদের সমঝোতার আবিস্কার এই ইলেকট্রোরাল কলেজ ব্যবস্থা।
প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় মোট রাজ্য ছিল ১৩টি আর ইলেকট্রোরাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ছয়টিতে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জর্জ ওয়াশিংটন প্রথম দুইবার নির্বাচিত হওয়ার পর স্বপ্রণোদিতভাবে তৃতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ান। এর পর থেকে এই ধারণার প্রতি সম্মান জানিয়ে চলছিল সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট। প্রথমবার এর ব্যত্যয় ঘটে ১৯১২ সালের নির্বাচনে, থিয়ডোর রুজভেল্ট দুবার নির্বাচিত হওয়ার পর তৃতীয় দফায় অংশ নিয়ে পরাজিত হন।
এর পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে পোলিও আক্রান্ত হুইল চেয়ার বাসিন্দা ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট চতুর্থবারের জন্য নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচিত হওয়ার সময় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে এবং তিনি স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেন। তারপরই মার্কিন কংগ্রেস ১৯৫১ সালে মার্কিন সংবিধানের ২২তম সংশোধনীর মাধ্যমে দুইবারের অধিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিষিদ্ধ করে। নির্বাচনের দিন ধার্য করা হয় প্রতি চার বছর পর, নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবারের পরের বুধবার। আর নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায়ন হয় পরের বছরের জানুয়ারি মাসে।
এই হলো মোটামুটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি।
প্রতিটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিশ্বের নজর কাড়ে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের গণমাধ্যম নির্বাচনী বছরের নানা খুঁটিনাটি প্রকাশ করে। মার্কিন এই নির্বাচনে সে দেশের গণমাধ্যম সরাসরি পক্ষ অবলম্বন করায় প্রধান গণমাধ্যমগুলো বিভক্ত হয়ে পড়ে।
গণমাধ্যমের এই বিভাজন বিশ্বকে বহু তথ্য প্রদান করে। যেমন, ট্রাম্পের কর ফাঁকি, করোনা নিয়ে বিভ্রান্তি; এমনকি করোনা প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহারের বিষয়ে দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত।
এবারে তেমনই মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন ট্রাম্পবিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত বলা যায়; আবার ফক্স নিউজ ট্রাম্পের অনুসারী। অতীতে বুশ জুনিয়রের সময় নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার তথ্যে 'ওয়েপন ফর মাস ডিস্ট্রাকশন' তত্ত্বের প্রেক্ষিতে ইরাক আক্রান্ত হয়েছিল।
মার্কিন গণমাধ্যম এ কথা বলছে না- ট্রাম্পের এই নির্বাচনী বছরে মার্কিনিরা পৃথিবীর কোথায়ও যুদ্ধে লিপ্ত নেই। অথবা, চীন পৃথিবীর অর্থনীতি যেভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে লুণ্ঠন করছে, তার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের জাতীয়তাবাদী চেতনার কারণে চীনকে একটু হলেও থমকে দাঁড়াতে হচ্ছে। চীনের অর্থনৈতিক সহযেগিতার ইতিহাস খুবই ভয়ঙ্কর। ইতোমধ্যে এশিয়ার বেশ কিছু দেশ এই অভিজ্ঞতার শিকার। পাকিস্তান দেশটি আজ দেউলিয়ার দ্বার প্রান্তে।
মার্কিন গণমাধ্যমে এ কথা উঠে আসে না- ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কীভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। বরং ডেমোক্র্যাট সমর্থকরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে বোমা নিক্ষেপের পরিমাণ দিয়ে। প্রচার করে, ট্রাম্পের নির্দেশে অনেক বেশি বোমা ফেলা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোতে।
ডেমোক্র্যাটরা কখনো গত ৫০ বছরে সে দেশে বসতি স্থাপনে কোনো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেনি। বিশ্ব শান্তির প্রশ্নে মার্কিন জাতীয়তাবাদ প্রধান সে দেশের গণমাধ্যম কিংবা রাজনীতিবিদদের কাছে কিন্তু এই মুহূর্তে পৃথিবীতে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তার গৌরব ডেমোক্র্যাটদের নয়। ডেমোক্র্যাট ক্ষমতায়নের পেছনে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি মধ্যপ্রাচ্যকে আবারও অশান্ত করা।
আমাদের দেশের পদ্মা সেতুর অর্থায়ন যখন রুখে দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক, তখন ক্ষমতায় ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। যে প্রেসিডেন্টের সময়কালে 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, ২০১৪ সালে। ডেমোক্র্যাট দলের ওবামা কিংবা ক্লিনটন- কেউই মার্কিন সমাজের যে বর্ণবাদী নির্যাতন চালানো হয়, তা রোধ করতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেননি।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক