এমসি কলেজের ঘটনা: এ দায় নিতে হবে

মুরারী চন্দ রায় নামকে চিরস্মরণীয় রাখতে তাঁর চতুর্থ প্রজন্ম রাজা গিরিশ চন্দ রায় ১৮৯২ সালে তদানীন্তন আসাম অঞ্চলের শহর সিলেটে এমসি কলেজ বর্তমান বাংলাদেশের সপ্তম পুরাতন কলেজ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল, মাত্র ১৬ জন ছাত্র আর চার জন শিক্ষক নিয়ে।
কলেজের প্রথম অবস্থান ছিল সিলেট মহানগরীর বন্দরবাজারের কাছে রাজা জিসি উচ্চ বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী স্থানে। ১৮৯১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটিতে এফ.এ অর্থাৎ বর্তমানের উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস খোলার অনুমতি দিলে ১৮৯২ সালের ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে এমসি কলেজ যাত্রা করে। কলেজটি ১৯১২ সালে সরকারি কলেজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান ক্লাস ও স্নাতক যুক্ত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কলেজের স্থান পরিবর্তন করে শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বর্তমান সিলেটের টিলাগড়ে ১৪৪ একর জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। তখন কলেজের শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ৫৬৮ জন।
১৯১৯ সালে সিলেটে ভ্রমণে এলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এমসি কলেজের তৎকালীন ছাত্ররা সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। এই কলেজের এক সময়ের কীর্তিমান ছাত্র ছিলেন কর্নেল তাহের, সাইফুর রহমান, আবুল মাল আবদুল মুহিত, নুরুল ইসলাম নাহিদ।
দেশের এই বিখ্যাত কলেজটির লাইব্রেরিতে দুষ্প্রাপ্য বইসহ প্রায় লক্ষাধিক বই রয়েছে। গৌরবোজ্জ্বল এই কলেজটি দেশের শিক্ষা অঙ্গনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বহু বছর ধরে, কিন্তু সম্প্রতি ভয়ঙ্কর এক ঘটনায় কলেজটির নাম আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে, সেই ঘটনা হল ধর্ষণ।
গণমাধ্যমে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ধর্ষণের সংবাদ পাওয়া যায় প্রায় প্রতিদিনই। এই ভূখণ্ড এক সময় দুর্নীতিতেও শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছিল। এবং সম্ভবত কয়েক বছর এই অবস্থান বজায় ছিল। আর এখন, প্রতিদিনের এই ধর্ষণ সংবাদ কি দেশকে ধর্ষক দেশের শীর্ষে পৌঁছে দিল!
দেশে নারী নির্যাতনের জন্য কঠোর আইন মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে, আবার শাস্তির বিধানে মৃত্যুদণ্ডের প্রমাণ সাপেক্ষ্যে বাধ্যতামূলক বিধান রাখা আছে তা সত্ত্বেও দেশে নারীর প্রতি নানা ধরনের সহিংসতা কিংবা ধর্ষণের সংবাদ কমে আসেনি।

দেশের বর্তমান অবস্থায় সব স্তরের মানুষকে গভীরভাবে ভাবতে হবে সংকটের গোড়া কোথায়? সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চলন্ত বাস কিংবা ট্রেন সর্বত্র ধর্ষণ এক সামাজিক ব্যধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখতে পাই আমাদের এই ভুখণ্ডে ধর্মচর্চা আগের তুলনায় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে আইনের কঠোরতাও-- তারপরও সমাজে এই ধর্ষণের মত গভীর ক্ষত তৈরি হওয়ার কারণ কি ?
ধর্ষক হিসাবে যাদের নাম উঠে আসছে তারা বয়সে সবই প্রায় তরুণ। বর্তমান তরুণ সমাজের এই অবস্থা কেন, তা এখন গভীর পর্যালোচনার বিষয়। এই তরুণ সমাজ থেকেই এদেশের বহু সংকটে, আন্দেলনে আমরা নেতা কর্মী পেয়েছি। দেশের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা নীতি আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবী, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন – এসব আন্দোলনে, উপলক্ষে এই তরুণ সমাজ অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছে। ডাকসু নেতৃত্ব ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি ও তার প্রকাশ করা যা আজ আমাদের মানচিত্র। শুধু তাই নয় দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সেই সময়ের সাহসী তরুণরা পথ দেখিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধক্ষেত্রেও তাদের বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল।
১৯৯০ সালে দেশের সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে এই তরুন সমাজের সংগঠিত রূপ ম্লান হওয়া শুরু হয়। রাজনৈতিক সংস্কারের পথ রুদ্ধ করার জন্য এই তরুণ সমাজকে ভিন্ন রাস্তায় পাঠানোর অংশ হিসাবে যে কাজটি করা হয়, তা হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। এর পরই বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলেও স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদের নির্বাচনের দাবী কখনও জোড়ালভাবে সেই সময় কিংবা আজও উত্থাপন করে নাই। আর এই ধারাই চলছে গত ত্রিশ বছর ধরে। আজকের তরুণ ছাত্ররা জানে না ছাত্র সংসদ কাকে বলে।
বাংলাদেশের জন্মের আগে, ২৩ বছর আমরা যখন পাকিস্তানের উপনিবেশ ছিলাম তখনও প্রায় সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস আছে, এবং যে ইতিহাসের সদস্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তিনি ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রী সংসদের ভিপি ছিলেন। আর ডাকসুর ভিপি ছিলেন জনাব তোফায়েল আহমেদ। বঙ্গবন্ধু জনাব তোফায়েল আহমেদকে রাজনৈতিক উপদেষ্টা মনোনীত করেছিলেন। এ সময়ে আরও অনেকেই রাজনীতির মধ্যগগনে ছিলেন, ছাত্র রজনীতির সাথে জড়িত তাদের অনেকেই ছাত্র জীবনে ছাত্র সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী দলের রিজভী আহমেদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ রাকসুর সর্বশেষ নির্বাচিত ভিপি। তাছাড়া রাকসুর আরেক ভিপি ফজলে হোসেন বাদশা রাজশাহী সদর আসনের সাংসদ।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন যেমন আগামী নেতৃত্ব তৈরি করে, তেমনি ছাত্রদের একটি আচরণ বিধি মেনে চলতেও বাধ্য করে। উপনিবেশিক আমলে, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পাকিস্তানেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের কোনো ইতিহাস জানা নেই। ছাত্র সংগঠনগুলোর কখনই নির্বাচনের দাবি জানানোর প্রয়োজন হয় নাই, নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৯০ দশকের শুরুতে ছাত্র রাজনীতির যে মৃত্যু হল, তারই ধারায় নতুন রাজনীতির এই বিকার সৃষ্টি হলো। এবং প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ভিন্নমতের ছাত্র সংগঠন বিলুপ্ত হলো। চাকরি ও ক্ষমতার সর্বত্র একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হলো সরকারী দলের ছাত্র সংগঠন, সর্বত্র দলীয় রাজনীতির পরিবেশ সূচিত হল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশাসন তথা সব স্তরে। ভিসি নির্বাচনেও প্রাধান্য দেওয়া হল দলীয় অনুগতদের আরো ব্যাপক ভাবে। ফলে ভিন্ন মতের ছাত্র সংগঠনের উপস্থিতি নিষিদ্ধ হলো। ৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদল নির্বাসিত করেছিল প্রধান ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে, তেমনি আজ নিষিদ্ধ প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্র দল। যে কারণে কোন নৈতিক বাধার সম্মুখীন হতে হয় না এই ছাত্র সংগঠনগুলোকে, ফলাফল ব্যাপক অনৈতিক কর্মের বিকাশ। এক সময় যেমন ছাত্রদল গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করত প্রশাসনের নিয়োগে, উন্নয়ন-টেন্ডারে তেমনি বহুগুণ ক্ষমতায় কর্মশীল আজকের ছাত্রলীগ। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক টেন্ডার ঘটনায় অপসারিত হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। প্রতিদিন এমনি সব অসংখ্য ঘটনার পর আজ নিয়ন্ত্রণহীন এই তরুণ সমাজ ।
পৃথিবীর উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ আছে। হার্ভাড, অক্সফোর্ড কিংবা পার্শবর্তী দেশ ভারতের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ বহাল আছে। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ছাত্রসংসদগুলো তাদের দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম এই ছাত্রদের বহু কিছু শিক্ষা দেয়। তারা জানতে পারে সংসদ কিভাবে চলে। আইন কিভাবে তৈরি হয়। পৃথিবীর নানা বিখ্যাত জন ছাত্রদের শোনায় কিভাবে সমাজ সংস্কার করতে হয়।
তরুণদের পক্ষ থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন আমাদের দেশের গত দশ বছরে অন্যতম ঘটনা। হাইকোর্টের এক রায়ের ফলে প্রায় ত্রিশ বছর পর ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ধারণা করা হয়েছিল ত্রিশ বছরের এই ধারার পরিবর্তন হবে, কিন্তু হয় নাই।
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে অতীতের মত ছাত্র সংসদ নির্বাচন বর্তমানের এই উচ্ছৃঙ্খল তরুণদের সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারে যদি রাষ্ট্রিয় হস্তক্ষেপ না হয়।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক