অভিনেত্রী ইস্যু এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

ইউটিউবে নতুন একটি ভিডিও সবার মনোযোগ আকর্ষণ করছে। ভিডিওটি ডিএমপি পুলিশ কমিশনারের। সাড়া জাগানোর কারণ ভিডিওটি একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রীকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে তুমুল আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে এই অভিনেত্রী ইস্যু। গত প্রায় ১৫ দিন ধরে তা গণমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
এই অভিনেত্রীর গ্রেফতার, পুলিশ রিমান্ড, জামিন আবেদন নাকচ, জেল হাজতে প্রেরণ ইত্যাদি নিয়ে মেতে রয়েছে মিডিয়া। গণমাধ্যম পরিচালনাকারীরা তাদের পাঠক-দর্শকের চাহিদার কথা জানেন। দোকানদার যেমন ক্রেতার চাহিদার কথা মাথায় রেখে পসরা সাজিয়ে বসেন, এটাও অনেকটা তেমন।
ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের ভেরিফাইড ইউটিউব চ্যানেলে গত ১১ তারিখে ঢাকা মহনগর পুলিশ কমিশনারের সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতার ৯ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডের ভিডিওটি আপলোড করা হয়। ঢাকার পুলিশ কমিশনার যা বলেছেন তা খুব উদ্বেগজনক।
এই অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি কিছু প্রভাবশালী মানুষের সংস্পর্শে এসে তাদের দুর্বল মুহূর্তের চিত্র ধারণ করে সেগুলো দিয়ে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করতেন। স্বাভাবিক প্রশ্ন, কারা যেতেন সেখানে? তাদের নাম, ছবি কেন প্রকাশ পেল না? নাকি তারা সবাই খুব 'সরল মনে' সেখানে যেতেন। খারাপ চিন্তা কেবল অভিনেত্রীর মাথায়?
প্রশ্নগুলো জটিল মনে হলেও উত্তর খুব সোজা। অভিযুক্ত চিত্রনায়িকা দাবি করেছেন, তার মদের লাইসেন্স আছে। কমিশনার মহোদয় এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, "আমরা তার লাইসেন্স এবং উদ্ধারকৃত মদের পরিমাণ যাচাই করে দেখছি।"
তাহলে যাচাইয়ের আগে কেন গণমাধ্যমে তা প্রকাশ করা হলো? এ প্রশ্নের উত্তর নেই।
পুলিশ কমিশনার বলেছেন, প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ও পুরুষ পরস্পরের সাথে যে কোনো ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন, আমাদের আইনে কোনো বাধা নেই। তবে যদি কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য 'সম্পর্ক স্থাপন' করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তবে তা আমলযোগ্য। নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে প্রতারণা থাকলে তা অপরাধ।
তাহলে পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েনের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী? বাংলাদেশের আইনে তিনি কোনো অপরাধ করেননি। তিনি 'শক্তি' প্রয়োগ বা 'প্রতারণা' কোনোটাই করেন নি। 'ক্ষতিগ্রস্ত' নারী কোন অভিযোগ আনেনি। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
পুলিশ কমিশনার বলছেন, সাকলায়েনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগটি আইনে নিষেধ না থাকলেও 'চাকরি বিধি'তে এটা অনৈতিক এবং অপরাধ। তবে কি এই বিধি আমাদের সংবিধানে দেওয়া অধিকার ও আইনের দেওয়া রক্ষাকবচের সঙ্গে সাংঘর্ষিক?
পুলিশ কমিশনার সাহেব বলেছেন, সমাজের বিত্তশালী কেউ কেউ যোগাযোগ করে বলেছেন, তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক গ্রেফতারকৃতরা নাকি তাদের নাম বলেছে, এ কথা বলে ভয় দেখানো হচ্ছে।
আমাদের দেশে অডিও, ভিডিও ফাঁস হওয়া নতুন কিছু নয়। এই ফাঁস হওয়া অডিও-ভিডিওগুলো যথেষ্ট চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সেটি রাজনৈতিক নেতার মধ্যকার সংলাপ বা কোনো অপরাধী ও পুলিশের মধ্যকার সংলাপই হোক না কেন।
আমরা সর্বশেষ ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ ও এক অভিভাবকের মধ্যকার সংলাপ শুনেছি। এই ট্যাপিং কারা করে? কীভাবে গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়? এর মধ্য দিয়ে কেউ বৈষয়িক স্বার্থ পুরণ করছে কি না বা মানুষের গোপনীয়তার অধিকার বিঘ্নিত হচ্ছে কি না- এরকম হাজারো প্রশ্ন মানুষের মনে।
কমিশনার মহোদয় ঐ আলাপচারিতায় স্পষ্ট করে বলেছেন, "আমরা কোনো তালিকা করছি না"। তিনি আরও যোগ করেছেন, "কেউ কোনো নাম বললেই পুলিশ তা আমলে নেয় না"।
পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য সঠিক হলে আলোচিত গ্রেফতারের সময় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা কেন বলা হয়েছিল? সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে, "আমরা গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে অনেকগুলো নাম পেয়েছি। সেগুলো যাচাই করে তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান পরিচালনা করা হবে"।
এছাড়া, যা "হবে" তাই বা কেন আগাম জানানো হয়? এতে গ্রেফতার অভিযানে কি কোনো সুফল পাওয়া যায়? সাধারণ জ্ঞান কী বলে? একজন ডেপুটি কমিশনার ও কমিশনারের কথা দুই রকম, এটা উদ্বেগজনক। যে কোনো সুশৃঙ্খল বাহিনীর আচরণে বিশৃঙ্খলা দেখা গেলে জনমনে সংশয় তৈরি হয়। মানুষের নিরাপত্তার বোধ বিনষ্ট হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার এই শোকের মাসে কেন এমন একটি বিষয় সামনে নিয়ে আসা হলো? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে তাকালে সেখানে বঙ্গবন্ধু হত্যা বা এদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার যে ষড়যন্ত্র তা নিয়ে কোনো আলোচনা দেখি না।
আলোচনা কেবল গ্রেফতারকৃত অভিনেত্রী ও অন্যান্যদের নিয়ে। এই গ্রেফতার নিয়ে পুলিশ বা প্রশাসন থেকে যা বলা হচ্ছে, মানুষ তা বিশ্বাস করে না। বরং, মানুষ এখন বিশ্বাস করে, 'হানি ট্রাপে' আটকে পড়াদের উদ্ধারের প্রচেষ্টা এগুলো।
বোট ক্লাবের ঘটনায় দেখেছি, কত দ্রুততার সাথে গ্রেফতার, ফোটোসেশন, পত্রিকায় প্রকাশ, থানা-কোর্ট-জেলহাজত-জামিন ও মুক্তিলাভের মতো এতগুলো ঘটনা ঘটে গেল। একমাসেরও কম সময়ের মধ্যে চার্জশিট প্রদান।
পুলিশের এ এক বিস্ময়কর সাফল্য! আইন কি সত্যিই স্বাভাবিক গতিতে চলছে? জাতীয় স্বার্থ ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে এ প্রশ্নের মীমাংসা জরুরি।
সুশাসন, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের স্বার্থে পুলিশ কারো দ্বারা কোনোভাবে ব্যবহৃত হোক, সেটা কাম্য নয়। একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই অভিনেত্রীর বিষয়ে আবেদন করেছেন এবং তার আবেদনের ভাষা যথার্থ। তার আবেদনের পর ঘটনা থেমে না থাকলেও আমরা আশা করছি, একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে।