জাপানে হায়াও মিয়াজাকির শেষ সিনেমা দেখতে প্রেক্ষাগৃহে ভক্তদের দীর্ঘ সারি!

প্রায় এক দশক পর অ্যানিমেশন মাস্টার হায়াও মিয়াজাকির নতুন সিনেমা 'হাউ ডু ইউ লিভ' জাপানের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। গত শুক্রবার মুক্তির পর থেকে সিনেমাটি দেখতে উৎসুক জাপানিজদের প্রেক্ষাগৃহের সামনে দীর্ঘ সারি ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে ও ভিড় করতে দেখা গিয়েছে।
৮২ বছর বয়সী বিখ্যাত নির্মাতা মিয়াজাকি জানান, এটিই তার শেষ সিনেমা। তবে সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়ে গেলেও এখনো এর গল্প, চরিত্র ও সংগীত সম্পর্কে কোনো তথ্যই প্রকাশ করা হয়নি।
গত শুক্রবার জাপানের আবহাওয়া ছিল বেশ গরম ও আর্দ্র। তবে এগুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি মিয়াজাকির উৎসুক ভক্তদের জন্য। ঠিক তেমনি একজন ২২ বছর বয়সী কলেজ শিক্ষার্থী ইয়োকো ওয়াটাবিকি। এ ভক্ত সিনেমাটি দেখতে টোকিওর সিটি সেন্টারে জুলাই মাসের তীব্র গরম ও ভিড়ের মাঝেই উপস্থিত হয়েছিলেন।
এতসব কষ্টের মাঝেও সিনেমাটি উপভোগ করতে পারা যেন ওয়াটাবিকির জন্য বেশ আনন্দের ব্যাপার। এমনকি সিনেমাটি উপভোগের জন্য তিনি সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া এড়িয়ে চলেছেন; যাতে করে সিনেমা সম্পর্কিত কোনো স্পয়লার দেখতে না হয়।
ওয়াটাবিকি বলেন, "২০১৬ সালে সিনেমাটি নির্মাণের ঘোষণার পর থেকেই আমি এটি বড় পর্দায় দেখার জন্য উন্মুখ ছিলাম। অনেকের মতো আমিও মিয়াজাকির সিনেমা দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। নতুন সিনেমাটি আসলে কী নিয়ে, সেটি জানতে আমি বেশ রোমাঞ্চিত।"
শুধু ওয়াটাবিকিই নয়, সমগ্র জাপানে এমন হাজারো মানুষ গত শুক্রবার প্রেক্ষাগৃহে মিয়াজাকির সিনেমাটি দেখতে ভিড় করেছিল। মিয়াজাকি অ্যানিমেশন কোম্পানি স্টুডিও জিবলির সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাবান অ্যানিমেশন নির্মাতা। তিনি কাজের মধ্যে প্যাস্টেল রঙের থিম ও ফ্যান্টাসি স্টোরিলাইন ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
তবে অন্যসব সিনেমার মতো 'হাউ ডু ইউ লিভ' সিনেমাটি মুক্তির ক্ষেত্রে ততটা জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়নি। ট্রেইলার, চরিত্র, প্লট ইত্যাদি প্রকাশ না করে শুধু একটি পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রকাশিত পোস্টারটিও বেশ সাধাসিধে; অস্পষ্টভাবে একটি পাখির ছবি ফুটে উঠেছে এমন।
১৯৩৭ সালে জাপানিজ লেখক গেঞ্জাবুরো ইয়োশিনোর প্রকাশিত উপন্যাস থেকে সিনেমাটির নামকরণ করা হয়েছে। 'হাউ ডু ইউ লিভ' উপন্যাসটিতে একজন কিশোর ও তার আংকেলকে কেন্দ্র করে দারিদ্র্য এবং আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কিত বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে।
কিন্ত মিয়াজাকির নতুন সিনেমার গল্প এ উপন্যাসটির মতো নয়, বরং ভিন্ন ধরনের। স্টুডিও জিবলির প্রযোজক ও স্টুডিওটির বর্তমান পরিচালক তোশিও সুজুকি এটি নিশ্চিত করেছেন।
গল্প সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা সিনেমাটি দর্শকদের মধ্যে যেন এটি আরো বেশি রহস্যের সৃষ্টি করতে পেরেছে। একইসাথে মিয়াজাকির অসংখ্য ভক্তদের সিনেমাটি ঘিরে প্রত্যাশাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বিষয়টি।
সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত মিয়াজাকির সিনেমাটি স্টুডিও জিবলির প্রথম আইম্যাক্স সিনেমা। ২০১৩ সালে মিয়াজাকির 'দ্য উইন্ড রাইজেস' মুক্তির পরেই তিনি সর্বশেষ সিনেমাটি তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এ সম্পর্কে তেরুমাসা সেতো নামের এক চিত্রগ্রাহক বলেন, "মিয়াজাকির শেষ নির্মাণ ঠিক কেমন হতে পারে আমি সেটি উপভোগ করতে চাই। সেজন্য আজ আমি প্রেক্ষাগৃহে যাচ্ছি। সিনেমাটি সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ না করার বিষয়টি মিয়াজাকির নিজের কাজের প্রতি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের পরিচয়। তার মতো এমন বিখ্যাত ব্যক্তির পক্ষেই এ সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব।"
তেরুমাসা জানান, একজন পোর্ট্রেট ও ল্যান্ডস্কেপ চিত্রগ্রাহক হিসেবে তিনি মিয়াজাকির পূর্ববর্তী বহু কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। বিশেষ করে কালার ব্যালেন্স ও কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে তিনি স্টুডিও জিবলির কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
গত জুনে এক প্রেস কনফারেন্সের স্টুডিও জিবলির প্রয়োজক সুজুকি সিনেমাটির প্রি-রিলিজ প্রচারণা না করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। তিনি মনে করেন, তথ্যে পরিপূর্ণ এই যুগে বিশদ বিবরণ না করাটাই যেন মনোমুগ্ধকর বিনোদনের একটি রূপ।
ঐ প্রেস কনফারেন্সে সুজুকি বলেন, "আমি ঠিক জানি না, এই কৌশল কাজ করবে কি-না। কিন্তু আমি এই সিদ্ধান্তের ওপর বিশ্বাস রাখছি।"
প্রেস কনফারেন্সে সুজুকি রিপোর্টারদের কোনো ধরনের প্রশ্নের জবাব দেয়নি। পরিচালক মিয়াজাকি নিজেও সুজুকির সিনেমার প্রমোশন না করার এই কৌশল ঠিক কতটুকু কার্যকরী হবে, সেটি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তবে শেষমেষ এ খ্যাতিমান নির্মাতা সুজুকির ওপর আস্থা রেখেছেন।
'মাই নেইবর টটোরো' কিংবা ২০০৩ সালে অস্কারজয়ী 'স্পিরিটেড অ্যাওয়ে' এর মতো বহু কালজয়ী সিনেমা নির্মাণের মধ্যে দিয়ে স্টুডিও জিবলি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বছরের পর বছর ধরে স্টুডিও থেকে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো সামাজিক নানা সমস্যাকেও তুলে ধরেছে।
১৯৮৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'গ্রেভ অফ দ্য ফায়ারফ্লাইস' তেমনি একটি সিনেমা। এই সিনেমায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানিজদের জীবনের দুঃখ, কষ্ট ও সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বক্স অফিসেও স্টুডিও জিবলির সিনেমাগুলো বেশ সফল। যেমন, স্পিরিটেড অ্যাওয়ে সিনেমাটি ২২৯ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে যা জাপানের অ্যানিমে সিনেমার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে 'প্রিন্সেস মনোনোক' আয় করেছে ১৪৬ বিলিয়ন ডলার; জাপানিজ এনিমের ইতিহাসে যেটির অবস্থান সাত নম্বরে।
শুধু অ্যানিমেশন সিনেমা তৈরি নয়, বরং গত ডিসেম্বরে স্টুডিও জিবলির পক্ষ থেকে একটি থিম পার্কও খোলা হয়েছে। সেখানে জিবলির কালজয়ী সব কাজকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
যদিও 'হাউ ডু ইউ লিভ' সিনেমার মধ্যে দিয়ে নির্মাতা মিয়াজাকি অবসরে চলে যাচ্ছেন; তবে ভবিষ্যতেও স্টুডিও জিবলি বিখ্যাত সব সিনেমা দর্শকদের ভবিষ্যতেও উপহার দেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সুজুকি।
চিত্রগ্রাহক তেরুমাসা মিয়াজাকির মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটির নামটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আশা প্রকাশ করেন যে, সিনেমাটি হয়তো সামাজিক কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে ফুটিয়ে তুলবে।
তেরুমাসা বলেন, "কোভিড মহামারি থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে অনেক পরিবর্তন করে দিয়েছে। এই পরিবর্তনের উপলব্ধির ফলে জীবনযাপনের ধরণ বোঝা সম্ভব হবে এবং অন্যদের প্রতি আমাদের আরও সহানুভূতিশীল করে তুলবে। আমি মনে করি, মিয়াজাকির সিনেমাটি আমাদের ভাবনার জগতে পরিবর্তন আনবে। এটাই সিনেমার আসল শক্তি।"