চ্যাটজিপিটি’র ভাইরাল জিবলি-স্টাইল ছবিতে মত্ত নেট দুনিয়া, বাড়ছে কপিরাইট নিয়ে উদ্বেগ

জাপানের কিংবদন্তি অ্যানিমে নির্মাতা হায়াও মিয়াজাকি। 'স্পিরিটেড অ্যাওয়ে' কিংবা 'মাই নেবার টটোরো'—হায়াও মিয়াজাকির হাতে গড়া স্টুডিও জিবলির এসব অ্যানিমেশন বিশ্বের অগণিত দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। আর সেই অনন্য শিল্পশৈলী যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ছবিতে ফুটে উঠতে শুরু করল, তখন উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দেখা দিল একগুচ্ছ প্রশ্নও। জিবলি ঘরানার শিল্পকর্ম তৈরির এই প্রযুক্তি যেমন অনেককে মুগ্ধ করেছে, তেমনি কপিরাইট ও নৈতিকতা ঘিরে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
জার্মানির আখেন শহরের উদ্যোক্তা জানু লিনগেসওয়ারান অবশ্য সেই বিতর্কে মাথা ঘামাচ্ছিলেন না। তার ভাবনা ছিল স্রেফ সৃজনশীলতার আনন্দ। তাই তিনি নিজের তিন বছরের র্যাগডল জাতের পোষা বিড়াল মালির একটি ছবি আপলোড করলেন চ্যাটজিপিটি'র নতুন ইমেজ জেনারেটরে। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর পরিচিত বিড়ালটি পরিণত হলো এক মনোমুগ্ধকর জিবলি-ঘরানার চরিত্রে—যেন 'কিকি'স ডেলিভারি সার্ভিস' বা 'মাই নেবার টটোরো'-র কোনো দৃশ্য থেকে উঠে আসা এক অ্যানিমেটেড প্রাণী।
'আমি ফলাফলে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম,' বললেন লিনগেসওয়ারান। 'এটা এতটাই ভালো হয়েছে যে, আমরা এটি প্রিন্ট করে ঘরের দেয়ালে টাঙানোর কথা ভাবছি।'
এখানেই শেষ নয়। বিখ্যাত অনেক ছবি—যেমন ২০২৪ অলিম্পিকসে সিলভার জেতা তুর্কি শুটার ইউসুফ দিকেচের ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে তোলা ছবি বা সেই ভাইরাল 'ডিজাস্টার গার্ল' মিম—সবকিছুই রঙিন জিবলি-শৈলীতে রূপান্তরিত হতে শুরু করল।
ওপেনএআই বর্তমানে কপিরাইট সংক্রান্ত একাধিক মামলার মুখোমুখি, তবে তারা 'জিবলিফিকেশন' নিয়ে বেশ ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান পর্যন্ত নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল ছবিকে জিবলি স্টাইলে রূপান্তরিত করেছেন।
মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রযুক্তিগত প্রতিবেদনে ওপেনএআই জানায়, নতুন এই টুলটি শিল্পীদের নান্দনিকতার অনুকরণে 'রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি' গ্রহণ করবে।
ওপেনএআই-এর বক্তব্য অনুযায়ী, তাদের ইমেজ জেনারেটর এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে এটি জীবিত শিল্পীদের নির্দিষ্ট শৈলী অনুকরণ করতে দেবে না। অর্থাৎ, যদি কেউ কোনো জীবিত শিল্পীর নাম উল্লেখ করে তার শৈলীতে ছবি তৈরি করতে চায়, তবে সিস্টেম তা প্রত্যাখ্যান করবে।
তবে, টুলটি স্টুডিও জিবলি বা ডিজনির মতো বিখ্যাত অ্যানিমেশন স্টুডিওগুলোর আর্ট অনুমোদন করবে। এর মানে হলো, নির্দিষ্ট কোনো জীবিত শিল্পীর কাজ অনুকরণ করা নিষিদ্ধ হলেও, বিখ্যাত অ্যানিমেশন স্টুডিওগুলোর সামগ্রিক শৈলীকে অনুসরণ করে ছবি তৈরি করা সম্ভব। তাই ব্যবহারকারীরা জিবলি-স্টাইলের ফ্যান-আর্ট বা মিম তৈরি করতে পারছেন।
স্টুডিও জিবলি অবশ্য সম্প্রতি ইন্টারনেটে চলা এই ট্রেন্ড নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। জাপানি স্টুডিওটি ও তাদের উত্তর আমেরিকার ডিস্ট্রিবিউটর (পরিবেশক) এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য পাঠানো ই-মেইলের তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দেয়নি।
তবে এই জিবলি ট্রেন্ড যত ছড়িয়েছে, ততই সামনে এসেছে নৈতিকতার প্রশ্ন। ৮৪ বছর বয়সী হায়াও মিয়াজাকি বরাবরই প্রযুক্তি-নির্ভরতার প্রতি সন্দিহান। সোশ্যাল মিডিয়ায় জিবলি-শৈলীর এআই চিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর, মিয়াজাকির এআই-সংক্রান্ত পুরোনো মন্তব্যও নতুন করে আলোচনায় আসে। ২০১৬ সালে একটি ডকুমেন্টারির ফুটেজে দেখা যায়, মিয়াজাকিকে যখন একটি এআই-নির্ভর অ্যানিমেশন দেখানো হয়েছিল, তখন তিনি একে 'অত্যন্ত বিকৃত' বলে মন্তব্য করেছিলেন।
অ্যানিমেশনটির উপস্থাপক দেখান, কীভাবে একটি শরীর কেবল মাথার সাহায্যে নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, এআই এমন 'বীভৎস গতিবিধি' সৃষ্টি করতে পারে, যা মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। এমনকি এটি জম্বিদের চলাফেরা তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে তিনি দাবি করেন।

এটি শুনেই মিয়াজাকি একটি গল্প শুনান।
'প্রতিদিন সকালে আমি আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতাম, যিনি শারীরিকভাবে অক্ষম। তার জন্য একটি 'হাই-ফাইভ' করাও কষ্টকর; তার শক্ত হয়ে যাওয়া পেশির কারণে সে সহজে হাত বাড়াতে পারে না। তাকে মনে পড়লে, আমি এসব (এআই-অ্যানিমেশন) দেখেও আগ্রহ পাই না। যারা এটি তৈরি করেছে, তারা কষ্ট কি বোঝে না', বলেন মিয়াজাকি।
তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানান, 'আমি কখনোই আমার কাজে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চাই না।'
'আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এটি জীবনের প্রতি এক ধরনের অবমাননা,' যোগ করেন মিয়াজাকি।
এআই-সৃষ্টি করা জিবলি-শৈলীর চিত্র নিয়ে আইনগত প্রশ্নও উঠেছে। আইন প্রতিষ্ঠান প্রাইয়ার ক্যাশম্যান-এর অংশীদার জশ ওয়েইজেনবার্গ বলেন, 'প্রশ্ন হলো, এই এআই মডেল কি মিয়াজাকি বা স্টুডিও জিবলির কাজ থেকে প্রশিক্ষিত হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তাহলে তারা কি সে অনুমতি নিয়েছে?'
ওপেনএআই-এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
ওয়েইজেনবার্গ আরও বলেন, যদি কোনো কাজ লাইসেন্স পেয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে একটি কোম্পানির পক্ষ থেকে এমন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যুক্তিযুক্ত হতে পারে। কিন্তু যদি এই ধরনের ব্যবহার অনুমতি ও ক্ষতিপূরণের বাইরে হয়, তবে এটি 'সমস্যাজনক' হতে পারে, তিনি জানান।
ওয়েইজেনবার্গ বলেছেন যে, সাধারণভাবে 'স্টাইল' কপিরাইট আইনে সুরক্ষিত নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে 'স্টাইল' বলতে মানুষ যা বোঝাতে চায় তা আসলে 'কোনো শিল্পকর্মের আরও সুনির্দিষ্ট, সনাক্তযোগ্য, পৃথক উপাদান' হতে পারে।
মানে হলো, সাধারণভাবে কোনো শিল্পের 'স্টাইল' কপিরাইটের আওতাভুক্ত নয়। যেমন, কোনো শিল্পের বিশেষ ধরণ—যেমন আঁকার একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা রঙের ব্যবহার—এগুলো কপিরাইট সুরক্ষিত হয় না। তবে, যখন মানুষ 'স্টাইল' বলতে কোনো কিছু বোঝায়, তখন তারা হয়তো শিল্পকর্মের বিশেষ ও স্বতন্ত্র উপাদানগুলোকে বুঝাতে চায়, যা সনাক্তযোগ্য এবং তা কপিরাইটের আওতায় আসতে পারে।
তিনি বলেন আপনি যদি হাউলস মুভিং ক্যাসল বা স্পিরিটেড অ্যাওয়ে-এর কোনো দৃশ্য স্থির করে দেখেন, তাহলে সেখানে নির্দিষ্ট কিছু উপাদান স্পষ্টভাবে চেনা যায়। আর যদি এআই-উৎপন্ন ছবিগুলো দেখেন, তাহলে সেগুলোতে একই বা অত্যন্ত মিল থাকা উপাদান পাওয়া যেতে পারে। তাই শুধু এটুকু বলা যে 'স্টাইল' কপিরাইটের আওতায় পড়ে না—এই যুক্তিতে বিষয়টি শেষ হয়ে যায় না।
শিল্পী কারলা অরটিজ, যিনি মিয়াজাকির সিনেমাগুলো দেখে বড় হয়েছেন এবং যিনি অন্যান্য এআই ইমেজ জেনারেটরের বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের মামলা করছেন, বলেন, এটি স্পষ্ট উদাহরণ যে ওপেনএআই-এর মতো কোম্পানিগুলো শিল্পীদের কাজ এবং তাদের জীবিকা নিয়ে মোটেও চিন্তা করে না।
'এটি জিবলির ব্র্যান্ডিং, তাদের নাম, তাদের কাজ, তাদের খ্যাতি ব্যবহার করে (ওপেনএআই) পণ্যের প্রচার,' অরটিজ বলেন। 'এটি অবমাননা, এটি শোষণ।'
অরটিজ আরও ক্ষুব্ধ হন যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বৃহস্পতিবার এই মিম ট্রেন্ডে অংশ নেয়। হোয়াইট হাউসের অফিসিয়াল একাউন্টে জিবলি-শৈলীতে একটি ছবি পোস্ট করা হয়, যেখানে ডোমিনিকান রিপাবলিকের এক নারী দেখানো হয়, যাকে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার করেছেন। হোয়াইট হাউস এবং ওপেনএআই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
অরটিজ সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখেছেন, 'মিয়াজাকির কাজের মতো অসাধারণ কিছু দেখা, যা এত সুন্দর, এমনকি সেটিকে বিকৃত করে কিছু অসুন্দর তৈরি করা, সেটা খুবই বেদনাদায়ক'। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে স্টুডিও জিবলি ওপেনএআই-এর বিরুদ্ধে মামলা করবে।