মার্কিন প্রতিবেদনটি সমাজে অরাজকতা সৃষ্টিতে উৎসাহ দিতেই করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে: সরকার

ঢাকা যেখানে মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসংঘের ব্যবস্থাপত্র ও যুক্তরাষ্ট্রের সুপারিশের সঙ্গে 'ঘনিষ্ঠ সংযোগ' বজায় রাখছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থা (এইচআর)-এর প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলোর জবাবদিহিতাকে 'অত্যন্ত খাটো' করে দেখেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত মানবাধিকার প্রতিবেদনের বিষয়ে রোববার (১৭ এপ্রিল) বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'এই প্রতিবেদনটি সমাজ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে এক অরাজক সমাজ সৃষ্টিতে উৎসাহ দিতেই করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।' এতে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা আগ্নেয়াস্ত্রের স্বেচ্ছাচারী ব্যবহারের মাধ্যমে নরহত্যার অনুমোদন দেয় না।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জে সাত-খুনের মামলায় ১৬ র্যাব কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যা মামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তার সম্প্রতিক মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতা ও বিচারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিবৃতিতে বলা হয়, 'প্রতিটি গুলি ব্যবহারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। আর যদি বেআইনীভাবে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে, তবে ওই সদস্যের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।'
এতে বলা হয়েছে, এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাউকে গ্রেপ্তার করলে, ঘটনাটি অবশ্যই ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে অবহিত করতে হয়। প্রতিটি ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেটই সিদ্ধান্ত নেন, গ্রেপ্তারটি আইনসঙ্গত হয়েছে কিনা। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কোনোভাবেই 'বেআইনীভাবে গ্রেপ্তার' করে দায়মুক্তি পায় না।
প্রতিবেদনের সূত্রটিকে প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিবেদনটিতে বেশ কিছু তথ্যগত ভুল রয়েছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, 'যদিও আমরা তাদের এই তথ্যের স্বীকৃতি দেই না, তারপরও আইন ও শালিশ কেন্দ্র (এএসকে) যেখানে জানিয়েছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ২৭৫টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেখানে মার্কিন প্রতিবেদনটি এএসকে'র তথ্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে বলেছে, ২০১৮ সালের মে থেকে জুনের মধ্যে ৬০৬টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার এটি অস্বীকার করছে না যে, অনেক ক্ষেত্রেই মানবাধিকার রক্ষা করতে আরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ঢাকা এ ব্যাপারে সঠিক লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, 'সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিধিবিধান মেনে চলছে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের গঠনমূলক সুপারিশ গ্রহণ করতে প্রস্তুত।'
'বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার তার জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে দেশের মানুষের অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করতে এবং তাদের কল্যাণে প্রচেষ্টা অব্যহত রাখবে।'
পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মার্কিন প্রতিবেদনে জোরপূর্বক শ্রম নিষেধের বিষয়টি তুলে ধরে সমালোচনা করা হয়েছে; কিন্তু এতে বাংলাদেশ কীভাবে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে উন্নতি ঘটাচ্ছে, সে বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনটি এমন একটি দেশে প্রকাশিত হয়েছে, যে দেশ আইএলও'র ৮টি মৌলিক শর্তের মধ্যে মাত্র ২টি পূর্ণ করেছে। সেখানে বাংলাদেশে এই শর্তের সবগুলোই পূর্ণ করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশ সরকার মনে করে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের নামে এলজিবিটি অধিকার এবং সমকামী বিবাহের মতো অন্যান্য কয়েকটি দেশের মূল্যবোধ আরোপ করার প্রবণতা দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত।'
মন্ত্রণালয় বলেছে, মার্কিন প্রতিবেদনে ২০১৮ সালের নির্বাচনসহ বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, যেখানে বস্তনিষ্ঠতার অভাব রয়েছে।
বলপূর্বক গুমের ঘটনা উল্লেখ করার ক্ষেত্রে মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়নি যে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার ঘটনার সময় 'জোরপূর্বক' নিখোঁজের রিপোর্ট করার জন্য আদালতে মামলা করেছিল কিনা।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'এই ধরনের মামলা না থাকলে বা নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগে ভুক্তভোগী পরিবার স্বেচ্ছায় মামলা দায়ের না করলে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অপহরণ করেছে বলে উপসংহার টানা বরং বেআইনি।'
মন্ত্রণালয় বলেছে, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ সর্বত্র বিদ্যমান একই ধরনের অপব্যবহার ও লঙ্ঘনের বিষয়ে অনেক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারে।
মার্কিন প্রতিবেদনে আশ্চর্যজনকভাবে পর্যাপ্ত স্বীকৃতি ছাড়াই কয়েকটি রোহিঙ্গা ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ সরকার ১৯৫১ সালের কনভেনশনের পক্ষ না হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার ও কল্যাণের লক্ষ্যে শ্রদ্ধাশীল পরিবেশের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে।
এছাড়াও প্রতিবেদনে গভীর সাগরে রোহিঙ্গাদের মর্মান্তিক প্রাণহানীর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করার ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
এতে আরো বলা হয়, 'বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে সমালোচনামূলক মন্তব্য করার সময় সূত্রগুলো প্রায়শই মানবাধিকার বিষয়গুলোর 'পরিসংখ্যান' ভুলে যায়।
মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশ ১৭০ মিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যার একটি দেশ, যেটি তার জনগণের সব ধরণের মানবাধিকার মানসম্মত শর্তে নিশ্চিত করার চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে গণমুখী উন্নয়ন করছে।
গত ১৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী "২০২১ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস" প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর শ্রম অধিকার, পুলিশ ও নিরাপত্তা সমস্যা, নারী ইস্যু এবং অন্যান্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে 'তথ্য-ভিত্তিক' এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।