জুলাই পরবর্তী পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশকে এক ধাপ এগিয়ে চিন্তা করতে হবে

নতজানু নীতি ছেড়ে বাংলাদেশকে এখন এক ধাপ এগিয়ে চিন্তা করতে হবে। এজন্য দরকার ক্ষমতার ভারসাম্য ও জনবান্ধব পররাষ্ট্রনীতি। এখন সময় এসেছে বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে পুরো বিশ্বে নজড় দেওয়ার। বাংলাদেশ কারো ওপর নির্ভরশীল না, বরং পরস্পর নির্ভরশীলতা আছে। এজন্য বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে হবে।
আজ মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ এর মিলনায়তনে 'পোস্ট জুলাই রেভ্যুলেশন ফরেন পলিসি অব বাংলাদেশ: ন্যাভিগেটিং নিউ হরাইজনস' শীর্ষক দিনব্যাপী আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা। জাতীয় নাগরিক কমিটির এই আয়োজনে পররাষ্ট্রবিষয়ক চারটি ভিন্ন সেশন অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, 'এখন আমাদের এক্সপানসন করতে হবে। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের কালচারাল এক্সপানসন (সাংস্কৃতিক বিস্তার) করতেই হবে। বাংলাদেশের কালচারকে গ্লোবাল কালচারে পরিণত করতে হবে।'
ভারতের ইঙ্গিত দিয়ে সারজিস বলেন, 'তারা তাদের ডমিনেন্স (আধিপত্য) ছড়িয়েছে বিভিন্নভাবে। আমাদেরও কালচার ও ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে চেষ্টা করতে হবে।'
সারজিস আলম বলেন, 'ভারতের আসলে কেন বাংলাদেশকে প্রয়োজন— সেই ন্যারেটিভ বিল্ড আপ করতে হবে। প্রভূসুলভ সম্পর্কের ইতি ঘটাতে হবে। আমরা মনে করি, আমরা (ভারতের ওপর) ডিপেন্ডেন্ট না, আমরা (বাংলাদেশ ও ভারত) মিউচুয়ালি ডিপেন্ডেন্ট। আমাদের এখন সময় এসেছে— বঙ্গোপসাগরে অতিক্রম করে সারাবিশ্বে নজর দেওয়ার। আমাদের দৃষ্টি এখন তীক্ষ্ম হতে হবে। আমাদের এক স্টেপ সামনে থেকে চিন্তা করতে হবে। আমি নতুন কাউকে ন্যাভিগেট করতে পারি, আর না পারি— আমার (বাংলাদেশের) ওপর কেউ নজরদারি করতে পারবে না।'
সংলাপে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, 'ভারত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এবং চারদিক দিয়ে পরিবেষ্টিত। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকলে অশান্তি হয়। ভারত চাইবেই বাংলাদেশকে হাতের মুঠোয় নিতে। কারণ, এরসঙ্গে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। আর শুধু ভারতকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সব দেশই নিজের স্বার্থ দেখে। বাংলাদেশ শুধু নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছিল।'
তিনি বলেন, সামনে ভারত ও চীন এ অঞ্চলে অত্যন্ত প্রভাবশালী হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দক্ষতার সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি মোকাবিলা করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা সার্কভুক্ত ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর কথা বলেছেন। এখানে কাজ করা প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান এ এস এম আলী আশরাফ বলেন, 'দেখতে হবে, কাদের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বেশি। রাতারাতি এই বাণিজ্য অংশীদার পরিবর্তন করা যাবে না। এদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে— বাজার আরও বিস্তৃত করায় মনোযোগ দিতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'নিজেদের স্বার্থেই প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ যেভাবে নিজেকে তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছে, সেই অবস্থানও ধরে রাখতে হবে।'
এ এস এম আলী আশরাফ বলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এখন নানা প্রোপাগান্ডা আছে যে এখানে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে এটা খুব সাবধানে দেখতে হবে। উগ্রবাদ নিয়ে বাইরে কোনো উদ্বেগ আছে কি না, সে বিষয়গুলো পররাষ্ট্রনীতিতে বিবেচনায় আনতে হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, 'অগণতান্ত্রিক সরকার যখন থাকে, তখন তাদের ক্ষমতার উৎস হয়— রাষ্ট্রযন্ত্র এবং বাইরের শক্তি, যা গত ১৬ বছর ছিল। পররাষ্ট্রনীতি ছিল নতজানু।' তিনি বলেন, বিএনপি সব সময় সমতার ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলেছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেছেন, '১৯৭২ সালে আমরা একটি দেশের কাছে ফরেন পলিসি বিক্রি করে দিয়েছিলাম। সেই জায়গা থেকে আজ পর্যন্ত আমরা উঠে দাঁড়াতে পারিনি। আমরা একটি দেশের সেবা দাস হিসেবে কাজ করেছি। গত ১৫ বছর আমরা সেটারও নমুনা দেখেছি। খুনিরা সে দেশে বসে এখন আমাদের নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে।'
নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, একটি দল ক্ষমতায় ছিল, যখন ক্ষমতা ছেড়েছে–- তখন তারা একটি দেশে পালিয়েছে। অন্য কোনো দেশে জায়গা পায় নাই। আমাদের ফরেন পলিসি বলতে, একটি দেশকে শুধু দেওয়ার সম্পর্ক ছিল। বড় করে যদি বলি- তাহলে বলতে হবে যে, বাংলাদেশের কোনো মিশন বা ভিশন বিশ্বে আমরা তুলে ধরতে পারি নাই।
তিনি আরও বলেন, আমরা যখন ক্ষমতায় যাব, গ্লোবাল স্টেজের ক্ষেত্রে ব্যালেন্স অব পাওয়ারের (ক্ষমতার ভারসাম্যের) প্রতি আমরা আগ্রহ প্রকাশ করব। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন- 'আপনারা আমাদের কাছে করিডর চাচ্ছেন, আমাদের তো মন চায় একটু হিমালয়ে যাওয়ার জন্য। হিমালয় থেকে যদি বে অব বেঙ্গল পর্যন্ত একটি সড়ক করা যায়। আমাদের পণ্যগুলো যদি নেপাল, চীনে দিতে পারতাম, আমরা উপকৃত হতাম। গত ১৫ বছর আমরা সব কিছু দিয়েই গেছি।'