২৭ বছরে কোটি কোটি টাকা খরচের পর স্বাস্থ্য খাত পরিচালনার সেক্টরভিত্তিক কৌশলে পরিবর্তন আসছে

বহুজাতিক ঋণদাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচি (এইচএনপিএসপি)। গত ২৭ বছরে অবকাঠামো ও সেবার পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয়ের পর কর্মসূচিটি এখন পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার মুখে পড়েছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের এই আমব্রেলা কর্মসূচিটি যেভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছিল, তাতে বারবার সম্পদের অপচয় ও কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ফলে পরিকল্পনা কমিশন কর্মসূচিটির পঞ্চম পর্বকে আরও কার্যকর করতে এ পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়নের আহ্বান জানিয়েছে।
তারা বলছেন, বিদ্যমান খাতভিত্তিক বাজেট পদ্ধতি থেকে নিয়মিত রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুই বছরের একটি এক্সিট প্ল্যান প্রস্তুত করছে। এই রূপান্তর রুটিন ব্যয়, যেমন বেতন, ওষুধ, রোগীদের পুষ্টি, বিদ্যুৎ ও রক্ষণাবেক্ষণের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, এ রূপান্তর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে আরও সহজ করবে ও স্বাস্থ্যসেবার দক্ষতা বাড়াবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সাইদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সেক্টর কর্মসূচি থেকে বের হয়ে আসার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনাধীন। এর উদ্দেশ্য চিকিৎসাসেবা ও স্বাস্থ্যসেবাকে সমন্বিত করা।
'পুরো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে একটি ছাতার নিচে সাজানোর চেষ্টা থেকে আমরা এটি করছি। এখন ফ্রাগমেন্টেড, একেকটা লাইন টুকরা টুকরা হয়ে আছে; সেটাকে একত্রিত করার জন্য এটি করা হচ্ছে,' বলেন তিনি।
তবে তিনি স্বীকার করেন, এই রূপান্তর সহজ নয়, কারণ দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য খাত এই কর্মসূচির ওপর নির্ভরশীল। সুষ্ঠু রূপান্তর নিশ্চিত করতে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কাজ করছে মন্ত্রণালয়, যাতে বাংলাদেশের চাহিদার উপযোগী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়।
২০২৫ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পঞ্চম এইচএনপিএসপির অধীনে ৩৮টি অপারেশনাল প্ল্যানের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১.০৬ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করেছিল। ১৯৯৮ সালে চালু হওয়া খাতভিত্তিক পদ্ধতি অনুসারে এটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল।
তবে জুলাই থেকে একাধিক মূল্যায়ন বৈঠকের পর পরিকল্পনা কমিশন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, এসব পরিকল্পনার বেশিরভাগই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মূল দায়িত্বের মধ্যে পড়ে—এবং পরিকল্পনাগুলো প্রকল্পভিত্তিক নয়, বরং রাজস্ব বাজেটের আওতায় বাস্তবায়ন করা উচিত।
কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি দেখিয়েছে, খাতভিত্তিক পদ্ধতিতে রাজস্ব ও নন-রেভিনিউ বাজেটের জটিলতার ফলে কীভাবে অনেক হাসপাতালের ভবন ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা সরঞ্জাম অব্যবহৃত পড়ে থেকেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করেন, 'ধরা যাক, কোনো কার্যক্রমের আওতায় একটি উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, কিন্তু সেটি চালানোর জন্য কোনো টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেওয়া হয়নি। একদিকে উন্নয়ন ব্যয়, অন্যদিকে এটি রাজস্ব ব্যয়—এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।' তিনি বলেন, কাঙ্ক্ষিত সুফল নিশ্চিত করার জন্য মূল স্বাস্থ্যসেবাগুলো মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বাজেটের অধীনে আনা প্রয়োজন।
১৯৯৮ সালের আগে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতোই বিষয়ভিত্তিক পৃথক পৃথক প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হতো। ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মত ১২৬টি প্রকল্প একীভূত করে ১৯৯৮-২০০৩ (৫ বছর) মেয়াদে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচি (এইচপিএসপি) শীর্ষক ১ম সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২য়, ৩য় ও ৪র্থ সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত পঞ্চম এইচএনপিএসপিতে ৩৮টি অপারেশনাল প্ল্যান রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ২৩টি এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ১৫টি অপারেশনাল প্ল্যান বাস্তবায়নের প্রস্তাব রয়েছে। এ কর্মসূচির লক্ষ্য স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বাড়ানো, মাতৃমৃত্যুর হার কমানো এবং পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা।
এ পরিকল্পনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, রোগ নিয়ন্ত্রণ, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, মাতৃ ও শিশুর যত্ন, চিকিৎসা শিক্ষা, টিকাদান কর্মসূচি, পরিবার পরিকল্পনা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের মতো বিস্তৃত সেবা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সাফল্য
সেক্টর কর্মসূচির আওতায় কলেরা, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কালাজ্বর ও জলাতঙ্ক নির্মূলে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশকে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে কালাজ্বর নির্মূলের স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
২০১৪ সালে দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল ৫৭ হাজার ৪৮০ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৪৫ জনের। ২০২৩ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় ১৬ হাজার ৫৬৭ জন্য ও মারা যায় ৬ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব রোগের পুনরুত্থান রোধে এগুলোকে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
পঞ্চম এইচএনপিএসপিকে স্বাস্থ্য খাতের সেক্টর কর্মসূটি হিসেবে বিবেচনা করে একটি সুপরিকল্পিত এক্সিট প্ল্যান প্রকল্প প্রস্তাবনায় সংযোজনের সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত অপারেশনাল প্ল্যানগুলোর জন্য অতি জরুরি বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন পরিকল্পনা নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে গত ৬ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পুনর্গঠিনত অপারেশনাল প্ল্যান পাঠাতে বলা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিকল্পনা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ড. হালিমুর রশীদ জানান, ২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত দুই বছরের জন্য অপারেশনাল প্ল্যান চালানোর বিষয়ে বলা হয়েছে তাদের। এর মধ্যে ৭ মাস চলে গেছে। আর এক বছর চার মাস সময় আছে। সেই অনুযায়ী তাদের প্ল্যান জমা দিতে বলা হয়েছে।
'এ মাসের মধ্যে এক্সিট প্ল্যানে যাওয়ার জন্য কাজ করছি। যতগুলো অপারেশন প্ল্যান আছে সবাইকে আলাদা আলাদা করে প্ল্যান দিতে হবে এ মাসের মধ্যে,' বলেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'প্ল্যানিং কমিশন থেকে আমরা যে সিদ্ধান্ত পেয়েছি, সেখানে বলা আছে, এটাকে সর্বশেষ সেক্টর প্রোগ্রাম ধরে একটি এক্সিট প্ল্যান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এক্সিট প্ল্যানের জন্য আমরা একটা কমিটিও করেছি, কমিটি কাজ করছে। পিইসির সিদ্ধান্তের চাহিদা পূরণ করার জন্য একটা এক্সিট প্ল্যান করছি। এজন্য আমরা সবার কাছে এক্সিট প্ল্যান চেয়েছি। এমন হতে পারে যে আমরা দুই বছরে এক্সিট করতে পারি বা তিন বছরে। আমরা দেখতে চাচ্ছি আমাদের জরুরি কাজ কোনগুলো, যেগুলো অপারেশনাল প্ল্যানে না হলে চলবে না। এ মাসে মিটিং হতে পারে।'
চার সেক্টর কর্মসূচির বাজেট
১ম সেক্টর কর্মসূচি থেকে ৪র্থ সেক্টর কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে যথাক্রমে ৬ হাজার ১১৭.১৩ কোটি টাকা, ১৬ হাজার ৪৫৬.৪৬ কোটি টাকা, ১৯ হাজার ৫৭১.০৬ কোটি টাকা এবং ৪৯ হাজার ৩৭৪.৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে।
প্রথম থেকে চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচিতে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়ন ধারাবাহিকভাবে কমে যথাক্রমে প্রায় ৩৮ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশে নেমেছে। অন্যদিকে প্রথম থেকে চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচিতে সরকারের অর্থায়ন ধারাবাহিকভাবে বেড়ে যথাক্রমে প্রায় ৬২ শতাংশ থেকে ৮৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, অপারেশন প্ল্যানের আর প্রয়োজন নেই। কমিউনিটি ক্লিনিকের বেতন-ভাতা, ওষুধ ও টিকার মতো জরুরি সেবাগুলোর অর্থায়ন করে অন্যান্য কার্যক্রম নিয়ে নতুনভাবে ভাবা প্রয়োজন।
'অপারেশনাল প্ল্যান তো আমরা ২৫ বছর চালালাম; খুব বেশি লাভ হলো না,' বলেন তিনি।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরসহ যেসব কার্যক্রম অপারেশনাল প্ল্যানের মাধ্যমে চলছে, সেগুলো নিয়মিত কর্মসূচিতে চালাবে। নিয়মিত কার্যক্রম হবে, রেভিনিউ থেকে বাজেট যাবে। পাঁচ বছর পরপর পরিকল্পনা তৈরি, পরিচালকের বেতনসহ অন্যান্য খরচ অনর্থক ব্যয় বাড়ায়। বরং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভাগগুলোকে শক্তিশালী করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। চ্যালেঞ্জ থাকলেও তিনি এই এক্সিট প্ল্যানকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল টিবিএসকে বলেন, স্বল্প-মেয়াদের জন্য সরকার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সেটি ভালো।