জাতিসংঘের প্রতিবেদন: বিজিবিকে যেভাবে ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে ব্যবহার করেন আসাদুজ্জামান

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন এবং র্যাব যেভাবে হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছিল, ঠিক সেভাবে আন্দোলনকারীদের ভয় দেখাতে আরও হেলিকপ্টার মোতায়েনের বিশেষ দাবি করেছিলেন তিনি।
আজ বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘের প্রকাশিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে সাবেক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার বরাতে বলা হয়, গত ১৮ জুলাই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে 'কোর কমিটি' নামের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যাতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে তিনি অন্যান্য শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সামনে বিজিবি কমান্ডারকে আরও সহজে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিতে বলেন।
ওই বৈঠকে উপস্থিত একজন ওএইচসিএইচআর- এর সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ী, পরের দিন অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে শেখ হাসিনাও আন্দোলন দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদেরকে আন্দোলনকারীদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে 'আন্দোলনের মূল হোতাদের, সমস্যা সৃষ্টিকারীদের গ্রেপ্তার, তাদের হত্যা এবং তাদের লাশ গুম করার' নির্দেশ দেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯ জুলাই ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা 'আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ডের সঙ্গে স্পষ্টই অসামঞ্জস্যপূর্ণ'।
এদিকে, নিয়মিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর 'কোর কমিটি'র বৈঠক হচ্ছিল। এসব বৈঠকে সামগ্রিক নীতি, বাহিনী মোতায়েন এবং কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ অভিযান নিয়ে আলোচনা করা হতো।
মন্ত্রীর সভাপতিত্বে 'কোর কমিটি'র বৈঠকে ব্লক রেইডসহ গণহারে গ্রেপ্তার অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
দ্রুতই প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশের প্রতিফলন দেখা যায়। ওএইচসিএইচআর-এর হিসাব অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা ১৮ জুলাই প্রায় ১০০ জনের থেকে ১৯ জুলাইয়ে প্রায় ৩০০ জনে পৌঁছায়।
ওএইচসিএইচআর-কে দেওয়া বিজিবির আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন অনুসারে, শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে কামাল প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর মহাপরিচালক এবং তার সামরিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের 'সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের' মৌখিক নির্দেশ দেন।
প্রতিবেদনে কামালের যাত্রাবাড়ী সফরের বিষয়টিও উঠে এসেছে।
এই ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে কামালকে একজন পুলিশ কমান্ডার বলছেন: 'আমাদের গুলিতে একজন মরে, বা একজন আহত হয়, শুধু সে একা পড়ে যায়। বাকি সবাই দাড়িয়ে থাকে।'
এদিকে, ওএইচসিএইচআর-এর কাছে বিজিবি তার প্রতিবেদনে বলেছে, তারা তাদের সৈন্যদের শুধুমাত্র প্রাণহানির শঙ্কা সৃষ্টি হয় এমন পরিস্থিতিতে শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছে এবং বিজিবি সৈন্যরা শুধুমাত্র সতর্ক করতে গুলি চালিয়েছে, এতে কেউ হতাহত হয়নি।
তবে বিজিবির এসব তথ্য ওএইচসিএইচআর-কে সরবরাহ করা এনএসআই-এর রিপোর্টের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ওই রিপোর্টে বিজিবির হাতে তিনটি হত্যার বিস্তারিত তথ্য এবং সম্ভাব্য আরও একটি হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেওয়া হয়েছে (বিজিবি নাকি পুলিশের হাতে এ হত্যা হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি)।
এতে আরও বলা হয়, ওএইচসিএইচআর-এর সংগৃহীত প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যে ১৯ জুলাই বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) কাছে রামপুরা ও বাড্ডা এলাকায় বিক্ষোভকারীদের ওপর বিজিবি ও পুলিশের যৌথভাবে প্রাণঘাতী গুলি চালানোর তথ্য পাওয়া গেছে।
অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য, গোলাবারুদের প্রভাব বিশ্লেষণ এবং ওএইচসিএইচআর-এর পাওয়া ছবি থেকে জানা যায়, বিজিবি এবং বাংলাদেশ পুলিশ সরাসরি রাইফেল ও শটগান দিয়ে ওই এলাকায় আন্দোলনরত এবং চলাচলরত জনগণের দিকে প্রাণঘাতী গুলি চালিয়েছিল।
এছাড়া, জাতিসংঘ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কার্যক্রম সীমিত করে শুধুমাত্র সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কাজে লাগানো এবং সে অনুযায়ী তাদের সম্পদ ও আইনি ক্ষমতা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে।