পিংক সল্ট: চট্টগ্রামের তরুণ উদ্যোক্তার হাত ধরে নতুন ব্যবসায়ের সূচনা


২০১৬ সালে প্রায় ৭০টি ছাগল ও অল্প সংখ্যক গাভী নিয়ে খামার শুরু করেন তরুণ উদ্যোক্তা মোহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত। এর বছরখানেক পরেই তিনি দেখতে পান, ছাগলগুলো অসুস্থ হড়ে পড়ছে এবং গাভীগুলোর দুধ উৎপাদন কমে যাওয়াসহ নানান রকমের রোগবালাই দেখা দিচ্ছে।
এমনকি, প্রয়োজনীয় টিকা দেওয়ার পরেও পশুগুলোর শরীরের লোম ঝড়ে যাচ্ছিল, দেওয়াল বা ময়লা চেটে খাওয়া শুরু করল এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বে অপরিপক্ক সন্তান জন্মদানের মতো ঘটনাও ঘটতে শুরু করল।
বিষয়টি ইয়াসিন তার ছোট ভাই জার্মানির হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজের (মৎস্যবিদ্যা) ছাত্র ওমর ফারুকে জানান। জানার পর ফারুক বলেন, মিনারেল ঘাটতির কারণে ছাগলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এজন্য ইয়াসিনকে তিনি অ্যানিমল লিক সল্টের ব্লক খোঁজার পরামর্শ দেন, যা রক সল্ট ব্লক নামেও পরিচিত।
কিন্তু চট্টগ্রামের ভোগ্যপণের অন্যতম বাজার খাতুনগঞ্জ ও আসাদগঞ্জে খুঁজেও পণ্যটির দেখা মিলেনি।
এরপর ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে মাইনিং বা সরবরাহকারী খোঁজ করতে থাকেন ইয়াসিন।
এরমধ্যে করোনার সময় ছাগলের খামারটি বন্ধ হয়ে যায়।
তবে হার মানেননি ইয়াসিন। সনদপ্রাপ্ত পাকিস্তানের সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। সরকারি অনুমোদনসহ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ইয়াসিনের প্রতিষ্ঠান ওয়ার্দা অ্যান্ড জুবায়ের এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২০২৩ সালের মে মাসে প্রথমবারের মতো ২৫ টন অ্যানিমল লিক সল্ট (পিংক মিনারেল অ্যানিমেল লিক সল্ট) আমদানি করে।
ইয়াসিন আরাফাত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শুরুটা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। বাংলাদেশে এর আগে এই পণ্য আমদানির রেকর্ড ছিল না। ফলে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে বোঝাতে হয়েছে। অবশেষে তাদের বোঝানো গেছে। পরে তারা অনুমোদন দিয়েছে।"
"বর্তমানে মমতা ডেইরি, মোল্লা ডেইরি, আবুল খায়ের ডেইরি, নাহার এগ্রোর মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের ক্লাইন্ট," যোগ করেন তিনি।
ওয়ার্দা অ্যান্ড জুবায়ের এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড গত ১৮ মাস ধরে পিংক মিনারেল ব্রান্ড এর অ্যানিমেল লিক সল্ট ব্লক আমদানি করে বিভিন্ন পর্যায়ের খামারীদের সরবরাহ করছে।
অ্যানিমল লিক সল্টে ৮৪ ধরনের মিনারেল রয়েছে। গরু ও ছাগলের সামনে ৩ কেজির কম-বেশি ব্লক ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পশুগুলো তা চেটে খায়। একটি গরু একটি ব্লক ২৫ দিনেরও বেশি সময় খেতে পারে। আর ছাগলের ক্ষেত্রে তা দেড় থেকে দুই মাস পর্যন্ত যায়। প্রতিকেজি সল্ট ১৮৫-১৯০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
ওজি এগ্রোর ইনচার্জ রুহুল আমিন লাবি টিবিএসকে বলেন, "আমরা প্রায় চার বছর ধরে ব্যবহার করছি। এর আগে খাতুনগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করতাম। কিন্তু সেটি তেমন ভালো না। ওয়ার্দা অ্যান্ড জুবায়ের এগ্রোর কাছ থেকে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে সংগ্রহ করে খামারে ব্যবহার করছি। এটির মান অনেক ভালো।"
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর টিবিএসকে বলেন, "চট্টগ্রামের অনেক খামার রক সল্ট (অ্যানিমল লিকস সল্টের ব্লক) ব্যবহার করছে। তারা ভালো ফলাফলও পাচ্ছে। গবাদিপশুর দেহের মিনারেল ঘাটতি পূরণ করছে। আমরাও উৎসাহিত করছি খামারিদের। যাদের ভালো ম্যানেজমেন্ট আছে, তারা এটি ব্যবহার করছে।"
মানুষও ব্যবহার করছে পিংক সল্ট
পিংক সল্টের উৎস হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত খনি অঞ্চল; প্রধানত পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের খেওড়া খনি। প্রাচীন কালে মাইনিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা উত্তোলন করতে হয়।
সাধারণ লবণের মূল উপাদান সোডিয়াম ক্লোরাইড। এখান থেকে শুধু সোডিয়াম ক্লোরাইডই পাওয়া যায়। কিন্তু পিংক সল্টে সোডিয়াম ক্লোরাইডের পাশাপাশি থাকে অনেক ধরনের ম্যাক্রো-মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট। সোডিয়াম ক্লোরাইডের পাশাপাশি আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ক্রোমিয়াম, সালফেট, জিংকসহ অনেক নিউট্রিয়েন্ট পাওয়া যায় এই লবণ থেকে।
ফলে এটি খেলে খারাপ কোলেস্টেরল কমার পাশপাশি ওজন দ্রুত কমে, পরিপাকতন্ত্রকে সুস্থ থাকে, রক্তচাপের ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, স্ট্রেস এবং বিষণ্নতা কমে, শরীর ও হাড়ের ব্যথার উপশম হয়, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, আর্থ্রাইটিস রোগীদের উপকার হয়, এমনকি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে।
খনি থেকে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ্যানিমল লিক্স সল্টের ব্লক ও পিংক সল্ট উৎপত্তি হয়। ইয়াসিন গবাদিপশুর পণ্যটির পাশাপাশি পিংক সল্ট নিয়েও ইন্টারনেটে পড়াশোনা করেন। এরপর ২০২৩ সাল থেকে পণ্যটি আমদানির জন্য উদ্যোগ নেন পাকিস্তানের পিক মিনারেল প্রাইভেট লিমিটেড থেকে।
পিংক সল্ট বর্তমানে শুধু 'হাউস অফ হারমনি' নামে একটি অর্গানিক ফুড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে পাইকারিতে দিচ্ছে ইয়াসিনের প্রতিষ্ঠান। কেজি ৯৮০ থেকে ১,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইয়াসিন বলেন, "দেশে বিদেশিরা এই লবণ অনেকে আনেন। আবার অনেক সুপারশপেও পাওয়া যায়। তবে বাজারে একই ধরনের পণ্য আছে। সেগুলো কিছু কিছু নকলও আছে। এ কারণে আমি আইএসও, জিএমপি, এফডিএ, বিআরসি, কোশার, এইচএসিসিপিসহ ৮টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সনদপ্রাপ্ত কোম্পানি থেকে পণ্য সংগ্রহ করছি। এরপর তা আমার কারখানায় এনে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্যাকেটজাত করছি।"
ধীরে ধীরে এর চাহিদা বাড়ছে বলে ইয়াসিন।
বাজারের নকল বা অন্য পণ্যের সঙ্গে মিক্স হতে পারে এই আশঙ্কায় হাউস অফ হারমনি ছাড়া অন্যকোনো প্রতিষ্ঠানে পাইকারিতে পণ্য বিক্রি করছে না ওয়ার্দা অ্যান্ড জুবায়ের এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
ইয়াসিন আরও জানান, "আমাদের কাছে অনেকে এসেছেন পাইকারিতে কেনার জন্য। কিন্তু নকল হওয়ার আশঙ্কায় আমরা সম্মত হইন। আগামী মাসেই পিংক মিনারেল নামের একটি ব্র্যান্ডের মাধ্যমে নিজেরা সরাসরি পিংক সল্ট বাজারজাত করবো।"
রপ্তানিসহ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ এলাকায় প্রায় ৪০ শতক জমিতে ওয়ার্দা অ্যান্ড জুবায়ের এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ছোট একটি কারখানা গড়ে তুলেছেন ইয়াসিন। ইউরোপের বাজারে প্যাকেজাত করে পণ্যটি রপ্তানির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
এছাড়া, উপকারী পিংক সল্ট দিয়ে তৈরি রেডি টু কুক ফুড বা ফ্রোজেন ফুড তৈরি করে বাজারজাত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোম্পানিটি ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড এর নিবন্ধন পেয়েছে। প্রায় ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সবমিলে ৩০ জন জনবল কর্মরত আছেন।
ইয়াসিন বলেন, "ইউরোপের বাজারে চীন বা ভারত একই পণ্য প্যাকেজজাত করে বাজারজাত করছে। তারা পারলে, আমরা কেন পারব না?"
"আমি বিদেশে রপ্তানির পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। আগামী মাসেই পিংক সল্ট দিয়ে তৈরি ফ্রোজেন ডালপুরি, মাল্টি গ্রান্ড রুটি, ফিশবল, মিটবল, চিকেন নাগেট বাজারজাত করা হবে বলে আশা করছি," যোগ করেন ইয়াসিন।