শ্রমিক কল্যাণে মজুরি বীমা এবং শিশু শিক্ষা ভাতা চালুর সুপারিশ সিপিডির

বাংলাদেশের সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সরকারকে একটি ওয়েজ গ্যারান্টি বীমা স্কিম চালু করার সুপারিশ করেছে।
সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ বলেছেন, 'নিয়োগকর্তাদের চাঁদা দিয়ে বীমা স্কিম গঠন করতে হবে। যাতে কোনো কারণে শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধে ব্যর্থ হলে, এই বীমা স্কিম মজুরি পরিশোধ নিশ্চিত করবে।'
আজ রোববার (১২ জানুয়ারি) সকালে রাজধানীর সিপিডি কার্যালয়ে ক্রিশ্চিয়ান এইডের সহযোগিতায় আয়োজিত 'শ্রমিকের জীবনমান, কর্মপরিবেশ ও অধিকার সংক্রান্ত সংস্কার উদ্যোগ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য প্রস্তাবনা'- শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত সুপারিশগুলোর মধ্যে কিছু ছিল দীর্ঘমেয়াদি, কিছু মধ্যমেয়াদি এবং কিছু ছিল স্বল্পমেয়াদি।
স্বল্পমেয়াদে সিপিডি ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে শিশু শিক্ষা ভাতা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে।
সিপিডি জাতীয় পর্যায়ে ধীরে ধীরে একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করার সুপারিশ করেছে, যা সকল শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক খাত এবং যেসব খাত এখনও ন্যূনতম মজুরি বোর্ড বিধিমালার আওতায় আসেনি সেগুলোতে কার্যকর হবে।
মধ্যমেয়াদি সুপারিশ হিসেবে সিপিডি আগামী এক বছরের মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি আগে নির্ধারিত সব খাতভিত্তিক ন্যূনতম মজুরির বড় ধরনের সংস্কারের সুপারিশ করেছে। এক্ষেত্রে প্রথমে সবচেয়ে পুরনোগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে।
থিংক ট্যাঙ্কটি বলেছে, যেসব চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক; বিশেষ করে যারা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সাময়িকভাবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের জন্য ন্যূনতম মজুরি আইনগতভাবে নিশ্চিত করা উচিত।
তারা সব ধরনের ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ভাতা (যেমন- আবাসন ভাতা) নির্দিষ্ট পরিমাণের পরিবর্তে মূল বেতনের শতাংশ হিসেবে নির্ধারণের সুপারিশ করেন।
দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশ হিসেবে সিপিডি বলেছে, সব শিল্পকে এমডব্লিউবি কাভারেজের আওতায় আনা উচিত এবং যেখানে ট্রেড ইউনিয়নের উপস্থিতি কম সেগুলোতে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতি দিনের বিলম্বের জন্য অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার জন্য একটি নতুন আইনি বিধান চালু করা। বিশেষত ইচ্ছাকৃতভাবে, বারবার বারবার ন্যূনতম মজুরি না দেওয়ার জন্য জরিমানা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো।
তারা আরও সুপারিশ করেছে, অতিরিক্ত সময়ে কাজের জন্য বেতন না দেওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইনের আওতায় আনা উচিত এবং ন্যূনতম মজুরি ও বেতন সংক্রান্ত জাতীয় বিধি-বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড / ক্রেতাদের জবাবদিহি করা উচিত।
পাশাপাশি সিপিডি প্রস্তাব করেছে যে, ডিআইএফইকে নতুন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের পর চার মাসের মধ্যে একটি বেতন বাস্তবায়ন মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে এবং যে সব প্রতিষ্ঠান নিয়ম অনুসরণ করছে না, তাদের নাম প্রকাশ্যে প্রকাশ করতে হবে।
তারা আরও বলেছে, একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি দিবস ঘোষণা করা উচিত এবং প্রতি বছর এটি উদযাপন করা উচিত, যাতে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
বেতন পরিশোধের পদ্ধতি সম্পর্কে সিপিডি প্রস্তাব করেছে যে, বেতন এবং অন্যান্য আর্থিক সুবিধা অবশ্যই আনুষ্ঠানিক এবং ব্যাংকিং চ্যানেল এবং/অথবা মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)/ডিজিটাল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (ডিএফএস) এর মাধ্যমে প্রদান করা উচিত এবং শিল্পাঞ্চলের কাছাকাছি শ্রমিকদের জন্য নাইট ব্যাংকিং সেবা চালু করা উচিত
সবার জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি
সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন। এতে তিনি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি এবং সবার জন্য একই শ্রম আইনের সুপারিশ করেন।
তিনি বলেন, 'রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) এবং এর বাইরে আলাদা শ্রম আইন থাকতে পারে না। এটি বৈষম্য।'
তিনি আরও প্রস্তাব করেন, 'প্রতিটি খাতের জন্য একটি নির্দেশিকা তৈরি করা উচিত, যাতে নির্দিষ্ট গ্রেডের বিপরীতে একজন শ্রমিক কীভাবে পদোন্নতি পাবেন তা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়।'
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমাদের দেশে ৮ কোটি শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫% শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন, তাদের সুরক্ষা খুবই কম। তাই আমরা অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের নিয়েও কাজ করছি।'
তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও শ্রমিক বেতনের দাবিতে রাস্তায় নামবে, তাদের দমাতে গুলি করা হবে; এটা হতে পারে না। কারখানার ভেতরে কেন কথা হয় না, আলোচনা হয় না কেন?'
তিনি আরও বলেন, 'সার্বজনীন পেনশন স্কিমে হকার, গৃহশ্রমিক, দিনমজুরের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু নেই।'
তিনি বলেন, 'শ্রমখাতের সবাইকে নিয়ে সমন্বিত সুপারিশ দেওয়ার চেষ্টা করছি, যেখানে শ্রম অধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। মজুরির মানদণ্ড, সামাজিক সুরক্ষা ও সাংগঠনিক অধিকার প্রত্যেকের থাকা জরুরি। এতে গতিশীল অর্থনীতিতে ন্যায্য হিস্যা প্রতিষ্ঠিত হবে।'
সিপিডি গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'আমরা বলছি না যে এক বছরের মধ্যে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি একটি স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।'
তিনি বলেন, 'তবে আমরা চাই এই বছরকে শ্রম সংস্কার বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। যাতে এসব সংস্কার তরান্বিত হয়। শ্রম নিয়ে কাজ করা মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।'
বেসিক মজুরি বাড়াতে হবে
শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং শ্রম ফেডারেশনের সভাপতি তাসলিমা আক্তার লিমা বলেন, 'শ্রম অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'নতুন মজুরি কাঠামোতে বেসিক মজুরি বাড়াতে হবে। শ্রমিকরা যাতে ন্যায্য বেতন পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের জীবন, জীবিকা ও জবানের অধিকার নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন করতে হবে।'
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স্ ফেডারেশনের (বিইএফ) মহাসচিব ফারুক আহমেদ বলেন, 'আমাদের দরকষাকষি ও সংলাপের ঘাটতি আছে। এর ফলে টেবিলে আলোচনা না হয়ে রাস্তায় আন্দোলন হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের যৌথ দরকষাকষি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে শ্রমিকের সুরক্ষায় আমরা মালেয়শিয়ার মডেল অনুসরণ করতে বলেছি। কারণ আইএলও কনভেনশনে যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের কাছ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি।'
তিনি আরও বলেন, 'শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক আরও উন্নত করতে হবে। আমরা শ্রম সংস্কার নিয়ে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'