যুক্তরাজ্যে হাসিনা-ঘনিষ্ঠদের অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির সন্ধান

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগী এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর যুক্তরাজ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রভাবশালী এসব ব্যক্তিদের যুক্তরাজ্যে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ডের (বাংলাদেশি টাকায় অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকা) সম্পত্তি রয়েছে।
তাদের মালিকানায় প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে—যার মধ্যে রয়েছে ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে সুবিশাল অট্টালিকা (ম্যানশন)। তবে, সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ এর থেকেও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম অবজারভার এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার (৩০ নভেম্বর) যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এই অনুসন্ধান নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে জানা গেছে, বিভিন্ন অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা এই অঢেল সম্পত্তির মালিকদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তাদের সকলের পরিবারের সদস্যরা।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই অভিযোগকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে দাবি করেছেন। তাদের ভাষ্য, নতুন সরকার তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে এই অভিযোগ তুলছে।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর গ্রেপ্তার হন সালমান এফ রহমান। অভিযোগ ছিল, তিনি নৌপথ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। সালমান এফ রহমান তখন শেখ হাসিনার বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন এবং তাকে সরকারের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে দেখা হতো।
এখন তার বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তার এবং তার পরিবারের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে প্রায় ১ বিলিয়ন পাউন্ডের অপরিশোধিত ঋণের অভিযোগ তদন্ত করছে।
সালমান পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাজ্যের গ্রোসভেনর স্কয়ারে সাতটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মালিক বা অংশীদার। এর মধ্যে ২০২২ সালের মার্চে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস ভিত্তিক একটি কোম্পানির মাধ্যমে ২৬ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ডে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেন সালমানের ছেলে আহমেদ শায়ান রহমান। গ্রোসভেনর স্কয়ারে তার আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যেটির মূল্য ৩৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন পাউন্ড।

এছাড়া, সালমানের ভাগনে আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের নিয়ন্ত্রণাধীন অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে গ্রোসভেনর স্কয়ারে এবং তার আশেপাশে আরও চারটি সম্পত্তি কেনা হয়েছে, যার মোট মূল্য ২৩ মিলিয়ন পাউন্ড।
আহমেদ শায়ান রহমান এবং আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের আইনজীবীরা দাবি করেছেন, তাদের মালিকানাধীন সম্পত্তিগুলো সব আইন মেনে কেনা হয়েছে, এবং তারা মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত সকল বিধি-নিষেধও অনুসরণ করেছেন।
তাদের আইনজীবীরা বলেছেন, আহমেদ শায়ান রহমান এবং আহমেদ শাহরিয়ার রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের তদন্ত সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানেন না এবং তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের তদন্ত মূলত একটি ব্যবসায়িক বিরোধের কারণে। তারা আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার হয়ত শুধু রাজনৈতিক বিরোধীদের লক্ষ্যে করেই এসব তদন্ত চালাচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর এসব দাবি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, 'এটি একটি বৈধ আইনি প্রক্রিয়া। যারা বাংলাদেশের সম্পদ নিয়ে গেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনতে চাই।'
আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীও, এখন তদন্তের আওতায় আছেন। তার ব্যাংক হিসাব বিএফআইইউ জব্দ করেছে। আদালত তার ও পরিবারের সদস্যদের অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তার ওপর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে।
যুক্তরাজ্যের ল্যান্ড রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের ৩০০টির বেশি সম্পদ রয়েছে। এগুলোর মূল্য অন্তত ১৬ কোটি পাউন্ড।
সাইফুজ্জামানের বৈশ্বিক সম্পত্তি সাম্রাজ্য নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে 'দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস' শিরোনামের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, তার সম্পত্তির মূল্য আনুমানিক ৫০ কোটি মার্কিন ডলার।
এছাড়া, তিনি বর্তমান লন্ডনে ১৪ মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়িতে থাকছেন বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট (আই-ইউনিট)।
তবে শুধু সাবেক মন্ত্রীরাই নয়, বরং আওয়ামী লীগের শাসনামলে উত্থান হওয়া কিছু ব্যবসায়ীও বিশাল পরিমাণ ব্রিটিশ সম্পত্তি জমিয়েছেন।

দেশটির কেন্সিংটনে আরেক ব্যবসায়ী, নাসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান নজরুল মজুমদারের মালিকানাধীন একাধিক সম্পত্তি রয়েছে। তার বিরুদ্ধেও অর্থপাচারের অভিযোগে তদন্ত করছে সিআইডি, সম্পত্তি জব্দ করেছে বিএফআইইউ।
বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশা করছে যে, মজুমদার ও তার পরিবারের সদস্যরা কীভাবে কেন্সিংটনের পাঁচটি বিলাসবহুল সম্পত্তি কেনার জন্য ৩৮ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন, তা তারা তদন্ত করবে।
অবজারভারের স্থানীয় অনুসন্ধানগুলো অনুযায়ী, বর্তমানে বেশিরভাগ সম্পত্তি ভাড়া দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে মজুমদারের জন্য একটি স্থিতিশীল আয়ের উৎস তৈরি হয়েছে।
মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, অবৈধ উপায়ে এসব সম্পত্তি কেনার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
বাস্তবে, বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন সম্পত্তির পরিমাণ সম্ভবত অনেক বেশি, যা অবজারভারের প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে অনেক বড়।

২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমি মালিকানা সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করে। তবে, মালিকানা সহজেই লুকানো যেতে পারে, যখন সম্পত্তির মালিকানা কোনো অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যেমন একটি অজ্ঞাত ট্রাস্টের মাধ্যমে।
এখন, দৃষ্টি নিবদ্ধ হচ্ছে সিটি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মাবলির দিকে, যারা হাসিনা সরকারের সদস্যদের সম্পত্তি পরিচালনায় সহায়তা করেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এপিপিজি (অ্যান্টি-করাপশন) চায় যে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পত্তি বিনিয়োগকারীদের ওপর যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করেছে কিনা, তা তদন্ত করা হোক।
নজরুল মজুমদার এবং তার কোম্পানি ব্রিটিশ ইউবিএস এবং কোউটস ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেংসিংটন এলাকায় সম্পত্তি কিনেছেন।
সালমান এফ রহমানের ছেলে তার ২৬ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ডের গ্রোসভেনর স্কয়ার প্যাড ক্রেডিট সুজি-এর যুক্তরাজ্য শাখা থেকে মর্টগেজ নিয়ে কিনেছেন, এতে সহায়তা করেছে আইন সংস্থা চার্লস রাসেল স্পীচলিস।
তিনি এবং তার চাচাতো ভাই, আহমেদ শাহরিয়ার, বার্কলেজ ব্যাংক থেকে মর্টগেজ নিয়ে সম্পত্তি কিনেছেন। জাসওয়াল জনস্টন নামের আরেকটি লন্ডনভিত্তিক আইন সংস্থাও সালমান এফ রহমানের পরিবারের সদস্যদের সম্পত্তি লেনদেনে প্রায়শই কাজ করেছে।
'লন্ডনে আসা সম্পদের উৎস বিশ্লেষণ করতে শক্তিশালী মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং বাস্তবায়ন প্রয়োজন,' বলেছেন জো পাওয়েল এমপি, অ্যাপিজি চেয়ারম্যান। 'বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের যে প্রচেষ্টা সম্পদ উদ্ধার করার জন্য, আমি তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাই', যোগ করেন তিনি।
শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও যুক্তরাজ্যের সিটি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক, যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়মাবলির তত্ত্বাবধানের জন্য দায়ী। ২০২২ সালে জানা যায়, টিউলিপ সিদ্দিকের মা ও শেখ হাসিনার বোন, শেখ রেহানা—আহমেদ শাহান রহমানের মালিকানাধীন লন্ডনের একটি বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকতেন।
তবে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে কোনো অপকর্মের অভিযোগ নেই, এবং জানা গেছে যে তিনি বাংলাদেশ সংক্রান্ত কোনো নীতিনির্ধারণে নিজেকে বিরত রেখেছেন।
এ মাসে, এপিপিজি (অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ) এর সদস্যরা যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন রেগুলেটরি সংস্থা এবং আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে চিঠি লিখে তাদের কাছে অনুরোধ করেছেন যে, তারা কি সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে সহায়তা করা ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের যথাযথ অনুসন্ধান করেছে কিনা তা তদন্ত করুক। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই দাবি করেছে যে, তারা যথাযথ অনুসন্ধান করেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সতর্ক করেছে যে যুক্তরাজ্য এখনও 'সন্দেহজনক সম্পদ বিনিয়োগের জন্য প্রধান গন্তব্যস্থল'।
বারক্লেস, কাউটস, চার্লস রাসেল স্পিচলিস এবং ইউবিএস (যা ক্রেডিট সুইসের মালিক) এনিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে। অরবিস লন্ডনও কোনো মন্তব্য করেনি। মার্কেট ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনস, চার্লস ডগলাস সলিসিটর্স, মভিং সিটি এবং জাসওয়াল জনস্টনসহ সব প্রতিষ্ঠানই জানিয়েছে, তারা সকল প্রাসঙ্গিক মানিলন্ডারিং বিধি মেনে যথাযথ অনুসন্ধান করেছে এবং গ্রাহকদের সম্পদের উৎস যাচাই করেছে।
ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নীতি পরিচালক ডানকান হেমস বলেছেন, সরকারকে 'বিশ্বব্যাপী মিত্রদের এবং বাংলাদেশের অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করে একটি নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা সন্দেহজনক সম্পদ আটকাতে সাহায্য করবে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন