‘জীবনের ৭৫ বছরে এমন ভয়াবহ বন্যা আর দেখিনি’

কুমিল্লার প্রত্যন্ত গ্রামের চরে বাস করলেও বন্যার জন্য আবু বকর সিদ্দিকীকে কখনও আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়নি।
তবে এবারের ভয়াবহ বন্যা ছিল ব্যতিক্রম।
বন্যায় আবু বকরের পাকা ধানের খেত নষ্ট হয়ে গেছে, কিনারা গ্রামের চর দুপ্পায় তার ৩০ বছরের পুরনো বাড়ি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তিনি সপরিবাড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
'শেষজীবনে এরকম দুর্ভোগ পোহাতে হবে, চিন্তা করিনি। ৭৫ বছরের জীবনে কখনও আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হয়নি, ত্রাণ নিতে হয়নি। এই বন্যায় আধাপাকা ধানের সাথে সাথে বাড়িটাও পচে খসে পড়ছে। ৩০ বছরের পুরান বাড়ি ছিলো আমার,' কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্র মন্নারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বসে আবু বকর এভাবেই হতাশার কথা জানাচ্ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালের বন্যা এমন ভয়াবহ ছিল না। ওই বন্যার সময় তারা বাড়িতেই ছিলেন। 'কিন্তু এবার গত চার দিন থেকে স্কুলে আছি। গতকাল থেকে পানি কমছে, তবে খুব ধীরে।'
এবারের বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর একটি কুমিল্লা। বন্যায় এ জেলার লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মন্নারা আলহাজ্ব ছালামত উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় ও মন্নারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি বহুতল ভবনে প্রায় ২ শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসেছে। একেকটি শ্রেণিকক্ষে চার থেকে পাঁচটি পরিবার বাস করছে।
৬০ বছর বয়সি আলেয়া বেগম বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে আসার সময় তিনি বাড়ির দুটি গরু ও তিনটি হাঁস নিয়ে আসেন। কিন্তু এত মানুষের মধ্যে এদের রাখতে অসুবিধা হচ্ছে। যদিও তবে একসঙ্গে থাকায় ত্রাণ ও খাবার পেতে সুবিধা হয়েছে।
'অনেক দূরের ছাত্ররা কিছু ত্রাণ দিলেও সরকার এখনও কিছু দেয়নি,' বলেন তিনি।
আবু মুসা নামের একজন কৃষক বলেন, তার তিন বিঘা জমির সব ফসল শেষ হয়ে গেছে।
'দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বাঁচতে পারছি, এতেই খুশি। এখন সব নতুন করে শুরু করতে হবে। কিন্তু কীভাবে, সেটা জানি না। আগে কখনও এরকম সর্বস্বান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি,' বলেন তিনি।
মাছ চাষিদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি
উপজেলার মক্রবপুর ইউনিয়নের পূর্ব পাড়ায় মো. আহমাদুল্লাহর ৭টি মাছের ঘের ছিল।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পুকুরে প্রায় ১ কোটি টাকার রুই ও কার্প-জাতীয় মাছ ছাড়া হয়েছিল। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর চেষ্টা করলেও পানি বিপৎসীমার অনেক ওপরে উঠে যায়।
বন্যার ফলে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার লোকসান গুনতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
একই এলাকায় হেলাল উদ্দীন ও ফখরুল ইসলাম দুজনে যৌথভাবে ১০ একর জায়গায় ১২টি ঘেরে মাছচাষ করতেন।
দুজনে জানান, গত ২২ ও ২৩ আগস্ট হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায় তারা এতগুলা পুকুর রক্ষায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হিমশিম খান। 'কিন্তু পানির উচ্চতা অতিরিক্ত বাড়ায় নিরুপায় হয়ে নিজেদের সর্বনাশ দেখলাম,' বলেন তারা।
একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ওয়াহাব মিয়া, নূরুল হাসানসহ উপজেলার শতাধিক মাছ চাষি।
ওয়াহাব মিয়া বলেন, 'সরকারের কাছে আহ্বান, আমাদের ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ করে একটা ব্যবস্থা করতে। কারণ আমাদের অনেকেই ঋণগ্রস্ত আছি। আমার নিজেরও ১ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। ঋণও আছে ৮০ লাখ টাকার মতো।'
নিউ হোপ ফিড মিল বাংলাদেশের এরিয়া ম্যানেজার (অ্যাকোয়াটিক) মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আট বছর ধরে মাছ চাষ নিয়ে কুমিল্লা ও ফেনীতে কাজ করছি। আমার সময়ে কখনও বন্যায় এভাবে মাছচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হননি।'
তিনি জানান, শুধু নাঙ্গলকোটেই ৩ হাজারের মতো মাছের ঘের আছে। এখানে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে।
'এ কারণে গত সপ্তাহ থেকে আমাদের ফিডের চাহিদা ৭০ শতাংশ কমে গেছে। মাছ চাষিদের এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর লেগে যাবে,' বলেন তিনি।