রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশগামী পর্যটক ৮০% কমেছে

গেল জুলাই থেকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটর ফোরাম।
চলতি মাসের শুরুতে, গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ভারতীয় দূতাবাস বাংলাদেশের জন্য ভিসা প্রদান সাময়িকভাবে স্থগিত করে।
যেহেতু বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য ভারতই প্রাথমিক গন্তব্য, তাই ভারতের ভিসা বন্ধ হওয়ায় এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে দেশের পর্যটন খাতে। বাংলাদেশ থেকে এখন ভারতগামী পর্যটক স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশেরও কম।
যদিও ভারতীয় দূতাবাস গত বৃহস্পতিবার থেকে পাসপোর্ট বিতরণের মতো সীমিত পরিসরে কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেছে। তবে এখনও পুরোপুরি ভিসা পরিষেবা চালু করা হয়নি।
অন্যদিকে, সামগ্রিকভাবে ভ্রমণ কমলেও থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো এখনও বাংলাদেশিদের জন্য সীমিত সংখ্যক ভিসা ইস্যু করছে।
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটর ফোরামের সভাপতি চৌধুরী হাসানুজ্জামান বলেন, "মূলত ছাত্র আন্দোলনের কারণে জুলাই থেকে সংকটটা শুরু হয়। যেহেতু এই সময়টাতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে ছুটি থাকে, তাই এটা আমাদের জন্য একটা প্রাইম টাইম ছিল।"
"কিন্তু এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম পর্যটক হয়েছে। কর্পোরেট ট্যুর পুরোপুরি বন্ধ এবং অনেকগুলো বাতিলও হয়েছে। আর কিছু এখনও ঝুলে আছে," বলেন তিনি।
ট্যুর অপারেটরদের মতে, আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের জন্য প্রি-প্ল্যান্ড (পূর্ব পরিকল্পিত) ট্যুরগুলো অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়েছে, কারণ ভারত নতুন করে ভিসা ইস্যু করছে না। এ কারণে ট্যুরগুলো লাগাতার বাতিল হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তারা।
অন্যদিকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরসহ ট্যুরিস্ট প্রবণ অন্যান্য দেশের ভিসাগুলোও বিলম্বে মিলছে।
চৌধুরী হাসানুজ্জামান বলেন, "এখন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াতে কিছু ট্যুরিস্ট যাচ্ছে। তবে দুবাইতে অনেক দিন থেকে ভিসা বন্ধ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুই মাস কর্মচারীদের বেতন দিতে পারব কি-না সন্দেহের মধ্যে আছি।"
চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে ইচ্ছুক এমন একজন টিবিএসকে বলেন, "আমার ছেলের অস্ত্রোপচারের জন্য ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। তবে, বাংলাদেশে অস্থিরতার কারণে, আমাদের সফর বাতিল করতে হয়েছে; ঢাকার একটি স্থানীয় হাসপাতালেই অস্ত্রোপচার করিয়েছি।"
গন্তব্য ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ ভ্রমণকারীদের পর্যটকদের সংখ্যা পরিবর্তিত হয়।
বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের মতে, সাংস্কৃতিক বন্ধন, নৈকট্য এবং ভিসা পাওয়ার সুবিধা বিবেচনায় ভারতই বাংলাদেশিদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া পর্যটকদের অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই ভারতে যান।
এরপরে চিকিৎসা, ঘোরাফেরা, কেনাকাটার ও অবকাশ কাটানোর জন্য থাইল্যান্ড অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য। এখানে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাংলাদেশি পর্যটকের যাতায়াত রয়েছে।
এছাড়া, মালয়েশিয়ায় ১০-১৫ শতাংশ, এবং সিঙ্গাপুরে ৫-১০ শতাংশ বাংলাদেশি পর্যটক যান।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং ওমান-সহ মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি পর্যটকের মধ্যে ১০-১৫ শতাংশের যাতায়াত রয়েছে। অন্যদিকে, ইউরোপে রয়েছে ৫-৮ শতাংশ। এছাড়া, অন্যান্য এশিয়ান অন্যান্য দেশ যেমন— নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং চীনেও বাংলাদেশি পর্যটকদের ৫-৮ শতাংশের পদচারণা রয়েছে।
অন্যদিকে, উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় ২-৫ শতাংশ বাংলাদেশি পর্যটককে ভিসা দেওয়া হয়।
আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটিং এজেন্সি ট্রিপ মেকার সাধারণত আসিয়ান ও সার্কভুক্ত দেশগুলোতে পর্যটক পাঠিয়ে থাকে।
এই এজেন্সির মোট ট্রাফিকের ১০-১৫ শতাংশ হয় ভারতে। যদিও এটি এখন শূন্যে নেমে এসেছে— যা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ট্রিপ মেকার গত বছর মোট ৩ হাজারের মতো পর্যটক পাঠিয়েছিল বিভিন্ন দেশে। এরমধ্যে ৭০০ জন ছিল ভারতে।
ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে
এখনো বেশিরভাগ দেশ অনেক চিন্তাভাবনা করে ভিসা দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন ট্যুর অপারেটররা।
ফলে ভিসা রিজেকশন অনেক বেশি হচ্ছে। যারা আগে ভ্রমণ করেননি তাদের ক্ষেত্রে অন্তত ২৫ দিন সময় লাগছে ভিসা পেতে।
এ কারণে বারবার টিকিট পরিবর্তন, হোটেল বুকিং পরিবর্তনের মতো ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে যা ফাইনের মাধ্যমে ভ্রমণ খরচকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এতে পর্যটকরা এই মুহূর্তে ভ্রমণ করতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলেও জানান ট্যুর অপারেটররা।
ট্যুর অপারেটর অফ বাংলাদেশের পরিচালক (ট্রেড অ্যান্ড ফেয়ার) তসলিম আমিন শোভন বলেন, "ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসি প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার ভিসা ইস্যু করে। সে হিসেবে প্রতি মাসে এক লাখের বেশি ভিসা ইস্যু হয়। আমাদের ট্যুরিস্টরা অন্তত ৫০,০০০ টাকা করে খরচ করে থাকে। আমার হিসেবে প্রায় ৭০০-৭৫০ কোটি টাকা ইন্ডিয়ান সেগমেন্টে খরচ হতো, যদি এসব ট্যুরিস্ট যেতে পারতেন।"
"এখন সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ লোক ভারতে যাচ্ছে। যাদের ভিসা আগে করা ছিল বা কেউ কেউ মেডিকেল ভিসা পাচ্ছে শুধু তারাই যাচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "যারা ভ্রমণ করবেন তারা কেউ মানসিকভাবে প্রস্তুত নন। কারণ ভ্রমণের জন্য যে পরিকল্পনা থাকে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন সব উলোট-পালোট হয়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে মানুষ অনুমান করতে পারে, তার হাতে সামনে কত টাকা থাকবে। কিন্তু এখন মানুষ ভাবছে যে তাকে কম খেয়ে কম ঘুরে টাকা বাঁচাতে হবে, কারণ সামনে কী হয় কেউ জানে না।"
এদিকে, বহির্গামী এয়ারলাইন্স সূত্রে জানা গেছে, এখন বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই শ্রম অভিবাসী। ফলে সামগ্রিক যাত্রী প্রবাহতে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি; শ্রম অভিবাসীরা নিয়মিত বিদেশে যাচ্ছেন।
তবে অবকাশ যাপন এবং ব্যবসায়িক কাজে ভ্রমণকারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক মো. কামরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আমরা কলকাতা ও চেন্নাইতে আমাদের ফ্লাইট কমাইনি, কারণ আগে ভিসা পাওয়া পর্যটকরা এখনও ভ্রমণ করছেন। তবে, ভিসা স্থগিতাদেশ অব্যাহত থাকলে, আগামী মাস থেকে আমাদের ফ্লাইট কমানো কথা চিন্তা করতে হতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "এছাড়া, রুটগুলোতে বিমান ভাড়া বাড়ানো হয়নি।"