রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে অতিষ্ঠ ঢাকাবাসী, দুর্ভোগের জন্য দায়ী কে?

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার পশ্চিম কাফরুলের বাসিন্দা হনুফা বেগম নিয়মিত তালতলার রাস্তা ধরে চলাচল করেন। তিনি গত ৭ মাসেরও বেশি সময় ধরে দেখছেন ওই এলাকার অধিকাংশ রাস্তার একটি অংশ কেটে মেরামত না করেই ফেলে রাখা হয়েছে।
এতে রাস্তা দিয়ে বড় একটি অংশে গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। বৃষ্টি হলে কাটা অংশে পানি জমে কাঁদা হয়, শুষ্ক সময়ে হয় ধুলা— যা স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত ভোগাচ্ছে।
হনুফা বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নতুন রাস্তাটিতে ওয়াসার কাজের জন্য বৃষ্টি হলে আর এ অংশ দিয়ে চলাচলা করা সম্ভব হয় না। কাঁটা অংশে কাঁদা-পানি জমে থাকে, যা কাপড় নষ্ট করে দেয়। এই খাদে পড়ে গত দুই দিন আগে একটি রিকশাও উল্টে গিয়েছিল।"
আসাদ এভিনিউ ব্যবহারকারী বাইক চালক নোমান মাহমুদ বলেন, "কিছুদিন পর পর রাস্তা কেটে মাসের পর মাস ফেলে রাখা হয়। এতে একদিকে যেমন যানজট সৃষ্টি হয়, আবার চলতে গিয়েও দুর্ঘটনা ঘটে। ৩ মাসেরও বেশি সময় ধরে রাস্তাটি এভাবে পড়ে আছে, দেখার যেন কেউ নেই।"
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ও এখানকার বাসিন্দা জামিউল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "এমনিতেই পুরান ঢাকার যানজটে আমরা অতিষ্ঠ। এর মধ্যে রাস্তা কেটে মেরামত না করে ফেলে রাখায় দোকানে লোকজন আসতে পারছে না। বংশালের রাস্তা কয়েকমাস ধরে মেরামত না করে ফেলে রাখায় আমরা নিজেরা ইট সুরকি দিয়ে কোনোভাবে লেবেল করে রেখেছি। গাড়ি চলাচল করে রাস্তা এবড়োথেবড়ো হয়ে গিয়ে প্রতিনিয়তই রিকশা উল্টে যাচ্ছে।"
শুধু শেওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর কিংবা পুরান ঢাকাতেই নয়— রাজধানীর অন্তত ৫০টি এলাকায় এমন দৃশ্য রয়েছে। টিবিএস রিপোর্টার সম্প্রতি ফার্মগেট, তেজকুনিপাড়া, পল্লবী, আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, বড় মগবাজার, মধুবাগ, পাইকপাড়া, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, মালিবাগ, খিলগাঁও, রায়েরবাজার, গ্রীণ রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, পুরান ঢাকা, লালবাগ, বাসাবো, সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়িসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে ঢাকা ওয়াসার খুঁড়ে রাখা রাস্তার এমন বেহাল দশা দেখতে পান।
স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান, ঢাকা ওয়াসা এসব রাস্তা খুঁড়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ইট-সুরকি দিয়ে রাস্তা ভরাট করে। এরপর ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে ইট-সুরকি দেওয়া রাস্তা এভাবেই পড়ে থাকে, কিন্তু মেরামত করা হয় না। যদিও মেরামত ও কার্পেটিংয়ের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের।
ঢাকা ওয়াসার দাবি, তারা কাজ শেষ করে ইট-সুরকি ফেলে গর্ত ভরাট করে দেওয়ার পরে মেরামতের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন মেরামত না করে ঢাকা ওয়াসার ওপর দায় চাপাচ্ছে।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন বলছে, ওয়াসা কাজ শেষ করে টেস্টিং এর জন্য সময় নেয়। তাই কাজ শেষের সাথে সাথেই তারা মেরামত করতে পারছেন না। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠিকাদার নিয়োগে সময় লেগে যায়, ফলে কাজে বিলম্ব হয়।
এদিকে, ঢাকা শহরের সড়ক খনন বিধিমালা- ২০১৯ এ জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরের বর্ষায় রাস্তা খোঁড়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
এ নীতিমালা অনুযায়ী, দিনে খনন কাজ বন্ধসহ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না করলে জরিমানার বিধান রাখা হলেও, এসবের তেমন কোনো প্রয়োগ নেই। আবার বর্ষা মৌসুমে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে মূল ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ ফি জমা দেওয়াসহ খননের রাবিশ/মাটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ না হলে জামানতের ফি দ্বিগুণ করার বাধ্যবাধকতাও তেমন মানতে দেখা যায় না।
নীতিমালায় বলা আছে, খননকারী সংস্থাকে খনন শুরুর তারিখ ও শেষের তারিখ সাইনবোর্ড দিয়ে সাইটে জানাতে হবে। রাস্তা খোঁড়ার নামে মাসের পর মাস কাজ ফেলে রাখা যাবে না। রাতের বেলায় খননের পর ওই রাতের মধ্যেই আধুনিক খনন-সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি দিয়ে পুনর্বাসন কাজ শেষ করে রাতের মধ্যেই যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। খননের আগে রাস্তাটি যে অবস্থায় ছিল, খননের পর সম্পূর্ণ আগের মতোই উপযুক্ত, ঝকঝকে-তকতকে করে তৈরি করে দিতে হবে— যাতে কোনোক্রমেই বোঝার উপায় না থাকে যে রাস্তাটি খনন করা হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। যেসব স্থানে মেরামত করা হয়, সেখানে মেরামতের পরেও এবড়োথেবড়ো অবস্থা দেখা যায়।
ঢাকা দক্ষিণের জোন-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) সাইফুল ইসলাম জয় টিবিএসকে বলেন, "ওয়াসা যখন রাস্তা কাঁটার অনুমতি নেয়, তখন সেগমেন্ট অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঢাকা ওয়াসা নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করে রাস্তা সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দেয় না। এছাড়া, টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় সময় বেশি লেগে গেলে মেরামতে কিছু বিলম্ব হয়।"
তার অঞ্চলের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাস্তা খুঁড়ে কাজ চলমান আছে, যা শেষ হলে কার্পেটিং করা হবে বলে জানান তিনি।
ঢাকা উত্তর অঞ্চল-৫ এর নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) নুরুল আলম টিবিএসকে বলেন, "অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঢাকা ওয়াসা টাইম ফ্রেম মেনে কাজ শেষ না করায়, ৫/৬ মাসও লেগে যায় কাঁটা রাস্তা মেরামত করতে। আসাদ গেইট এলাকায় ২-৪ মাস ধরে খোঁড়াখুঁড়ি করছে ওয়াসা। কাজ শেষ করে এখন তারা অবজারবেশনে রেখেছে, পানির প্রেশার চেক করতে। আমাদের ক্লিয়ারিটি না দিলে আমরা কার্পেটিং এর কাজ শেষ করতে পারি না।"
ঢাকা উত্তরের এই কর্মকর্তা আরও বরেন, "অনেক সময় আমরা কার্পেটিং শেষ করার পরে ওয়াসা আবার রাস্তা খোঁড়ে। তখন আমাদের নির্ধারিত বাজেটও শেষ হয়ে যায়। ফলে এ বিষয়টি নিয়ে আমাদেরও ভুগতে হয়।"
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অন্তত ৩ জন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "সিটি কর্পোরেশন এলাকায় যে পরিমাণ রাস্তা ঢাকা ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থা খোঁড়ে, সেই অনুযায়ী ঠিকাদার নিয়োগ হয় না। ঢাকা ওয়াসার যেমন গাফিলতি রয়েছে, তেমনি সিটি কর্পোরেশনেরও এসব উন্নয়ন কাজে টেন্ডারিং, ঠিকাদার নিয়োগ, কাউন্সিলরদের অভিযোগের কারণে কাজে দেরি হয়।"
ঢাকা ওয়াসা যে পরিমাণ রাস্তা কাঁটার অনুমতি নেয়, তার থেকে অনেক বেশি কেটে ফেলার কারণেও ভোগান্তি বাড়ছে বলে জানায় সিটি কর্পোরেশন। এছাড়া অনেক রাস্তা ফেলে রাখা হয়, পরবর্তী রাস্তার উন্নয়ন কাজের সাথে একবারে মেরামতের জন্যেও। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়ে।
ঢাকা ওয়াসার ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর অব অপারেশনস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার একেএম শহীদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "আমরা কাজ ফেলে রাখি না, বরং সিটি কর্পোরেশন মেরামত না করে ফেলে রাখে। আমরা ইট-সুরকি দিয়ে লেবেল করে দেওয়ার পরে কার্পেটিং এর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের– সেখানে ক্লিয়ারিটি দিতে হবে কেন? কাজ শেষে জানানোর পরেও অনেক সময় সিটি কর্পোরেশন কাজ করে না।"
ওয়াসার এই কর্মকর্তা আরও বলেন, "আমরা মাত্র ১ ফুট প্রস্থ নিয়ে ৪-৫ ফুট পর্যন্ত গভীর করে কাজ করি। এতে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা না। যখন মাসের পর মাস সিটি কর্পোরেশন ফেলে রাখে, তখন রাস্তার গর্তের পরিধি বেড়ে যায় এবং ভোগান্তি বাড়ে।"