সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি: নগরেও পানি ঢুকছে, প্লাবিত ৭ উপজেলা

সিলেটে বন্যায় নতুন করে আরও দুটি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। নতুন করে পানি ঢুকেছে বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। এ নিয়ে জেলার সাতটি উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যায় পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ।
এদিকে, বৃহস্পতিবার রাত থেকে নগরীর নদী তীরবর্তী কয়েকটি এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সব কর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। জরুরি সেবার জন্য চালু করা হয়েছে কন্ট্রোল রুম।
এর আগে টানা বৃষ্টি ও ঢলে বুধবার রাতেই তলিয়ে যায় সীমান্তবর্তী পাঁচ উপজেলা জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জ। বৃহস্পতিবার রাতে নতুন করে প্লাবিত হয় বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা।
তবে শুক্রবার সকাল থেকে সিলেটে বৃষ্টি থেমেছে, দেখা মিলেছে রোদের। তবে বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটের উজানে ভারতের মেঘালয়ে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারি আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘন্টায় মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ১৯৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

বন্যাকবলিত এলাকায় ৫৪৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে চালু করেছে জেলা প্রশাসন। এরমধ্যে আক্রান্ত সাত উপজেলার ৩৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৮০২ জন আশ্রয় নিয়েছে। নগরের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখার কথা জানিয়েছে সিটি করপোরেশন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে কুশিয়ারা দুটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে অমলসিদ পয়েন্টে ২০৭ সেন্টিমিটার এবং শেওরা পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দিপক রঞ্জন দাস বলেন, সিলেটে ঢলের কারণে এবারের বন্যা দেখা দিয়েছে। উজানে বৃষ্টি থামলে ঢলও বন্ধ হবে। তখন বন্যা পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে জৈন্তাপুর উপজেলা। এ উপজেলার ৭৫ শতাংশ এলাকাই পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি উঠে গেছে বেশিরভাগ বাড়িতে।
বাড়িতে পানি উঠে যাওয়ায় জৈন্তাপুরের ফতেহপুর এলাকার বৃদ্ধা হাওয়া বিবি আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে।

তিনি বলেন, 'আগেও বাড়িতে পানি উঠছে। কিন্তু এত দ্রুত পানি বাড়তে দেখিনি জীবনে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে পানিতে সব তলিয়ে গেলো। পানি দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় ঘর থেকে কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। আসবাবপত্র সব পানিতে ভিজে নষ্ট হচ্ছে।'
জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী জানান, উপজেলার টিলা এলাকা ছাড়া বাকিসব এলাকাই প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও মানুষের বাড়ির চাল পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। বন্যা কবলিতদের জন্য চাল বরাদ্দ দেওয়া হলেও অনেকের রান্না করে খাওয়ার মতো শুকনো জায়গাও নেই।
তিনি বলেন, 'বন্যা কবলিত মানুষদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে গৃহপালিত পশু উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বন্যায় গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি পারে।'
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্লাবিত এলাকায় ১ হাজার বস্তা শুকনো খাবার, ৭৫ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও ত্রাণ বরাদ্ধের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য ইউনিয়নভিত্তিক মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে সুরমা নদী উপচে সিলেট নগরের নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। শুক্রবার নগরের জামতলা, তালতলা, মাছিমপুর, ছড়ারপাড় তোপখানা, সোবহানীঘাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। পানি ঢুকে পড়েছে তালতলা এলাকার সিলেট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ে।
ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার মো. বেলাল হোসেন বলেন, 'বন্যার পানি ওঠার কারণে এ স্টেশন থেকে সব যন্ত্রপাতি আলমপুর স্টেশনে নিয়ে রাখা হয়েছে। পানি আরও বাড়লে গাড়িগুলোও অন্যত্র নিয়ে রাখতে হবে। কর্মীদের আপাতত সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে অস্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।'
সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৩ নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত ফায়ার সার্ভিসের মূল স্টেশন।
ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত শন্তু বলেন, 'তালতলা ফায়ার স্টেশন ছাড়াও নগরের বাগবাড়ি, উপশহর এলাকার নিম্নাঞ্চলে পানি উঠতে শুরু করেছে।'
সিলেট সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উজানের পানি নেমে আসায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ছড়ার পানি নদীতে যাওয়ার কথা, এখন উল্টো নদীর পানি ছড়া উপচে নগরীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।

এদিকে, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেওয়ায় বৃহস্পতিবার বিকালে জরুরি সভা করে সিটি করপোরেশন।
সভায় নগরীর কয়েকটি ওয়ার্ডকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুতের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। শুক্রবার থেকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি এবং প্রাথমিক চিকিৎসাসামগ্রী পাঠানো শুরু হয়। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় উদ্ধার কাজের জন্য নৌকার ব্যবস্থা, নিম্নাঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্র ও উপ-কেন্দ্রগুলো বন্যার পানিতে যাতে ডুবে না যায় সেজন্য সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিভাগের কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সহযোগিতা প্রদান, নগরবাসীর জরুরি সেবার জন্য ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুম চালুসহ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে রান্না করা খাবার পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সভায় জনস্বার্থে সিসিকের বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে ৩ টন চিড়া, ৩ টন মুড়ি, গুঁড়, খাবার পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং ওরস্যালাইন কেনা হয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, 'উজানের পানি নেমে আসায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সিলেট নগরীর ছড়ার পানি নদীতে পড়ার কথা, উল্টো নদীর পানি ছড়া উপচে নগরীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা সব প্রস্তুতি নিয়েছি।'
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোবারক হোসেন জানান, বন্যার্তদের সহায়তায় উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল-রুম খোলা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে মেডিকেল টিম গঠন করা হচ্ছে। বন্যা-কবলিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে।