যেভাবে ইয়াবার খোঁজে গিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো ধরা পড়ল ‘ব্ল্যাক কোকেন’

ইয়াবা তদন্তে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে নাম উঠে আসায় ২০২৩ সালের শেষের দিকে ভুলবাড়িয়া গ্রামের আবু বক্কর ওরফে রুবেলের বাড়িতে অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
তাকে ধরতে না পারলেও কর্তৃপক্ষ ১৫ গ্রাম আইস, ১২ গ্রাম ইয়াবা গুঁড়া, এক গ্রাম কোকেন এবং পেন্সিলের সিসা হিসেবে ব্যবহৃত গ্রাফাইটের মতো দেখতে এক ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের ৪৪টি টুকরা জব্দ করে।
অজানা ওই পদার্থটির প্রায় কয়েক সপ্তাহব্যাপী ফরেনসিক পরীক্ষার পর বুধবার (৩১ জানুয়ারি) কর্তৃপক্ষ মোট সাত গ্রাম ওজনের পদার্থটিকে 'ব্ল্যাক কোকেন' হিসেবে চিহ্নিত করেছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসি-এর কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা।
বাংলাদেশে এ প্রথম
মেক্সিকো এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে ব্ল্যাক কোকেন সাধারণ মাদকদ্রব্য হলেও বাংলাদেশে এ প্রথম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এটি জব্দ করেছে।
ডিএনসি ফরিদপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক শামীম হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোকেন সাধারণত পাউডার আকারে সেবন করা হয়। এটিকে শক্ত বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। তাই পাচারকারীরা এটিকে কাঠকয়লার মতো ছোট ছোট টুকরো করে তৈরি করে যা পরে গুঁড়ো করা যায়। তারা কিছু রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে এমনটা করে।'
ফরিদপুরে রুবেলের বাড়িতে অভিযানের নেতৃত্বদানকারী শামীম বলেন, 'আমরা ধারণা করছি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য এ মাদক দেশের ভেতর এভাবে আনা হয়েছে।'
তিনি জানান, মাস দুয়েক আগে মেক্সিকোতে দুই টন ব্ল্যাক কোকেন জব্দ করা হয়েছিল। কোকেনের এই নতুন রূপ এত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে বলে তারা আশা করেননি।
'তবে যার বাড়ি থেকে নতুন মাদক উদ্ধার করা হয়েছে, তাকে ধরার জন্য আমরা উচ্চ সতর্কতায় রয়েছি। তাকে গ্রেপ্তারের পর আমরা মাদকের রুট ও বিক্রি ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারব,' বলেন তিনি।

'ব্ল্যাক কোকেন কী?
সিএনবিসিটিভি১৮-এর খবর অনুযায়ী, ব্ল্যাক কোকেন হলো সচরাচর পরিচিত সাদা কোকেন এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ। এ মিশ্রণের কারণে মাদকটির রঙ বদলে কালো হয়ে যায়। ভিন্ন এ রঙ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে মাদকটিকে ছদ্মবেশ ধারণে সাহায্য করে।
অ্যাক্টিভেটেড কার্বনের মতো রাসায়নিক পদার্থ যোগ করে কোকেনের গন্ধ দূর করা হয়। কালো রঙয়ের কারণে এ কোকেনের টুকরোগুলো দেখতে সাধারণ কাঠকয়লার মতো লাগে। অ্যাক্টিভেটেড কার্বন গন্ধ নিশ্চিহ্ন করে ফেলে বলে মাদকের রঙভিত্তিক পরীক্ষা এবং কুকুরের গন্ধশক্তির পরীক্ষায় ব্ল্যাক কোকেন ধরা পড়ে না।
চোরাচালান সহজ করার জন্য ব্ল্যাক কোকেনকে প্রায়ই অ্যাসফল্ট, প্রিন্টার টোনার, কাঠকয়লা বা সারের রূপ দেওয়া হয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝিতে চিলির স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশের সেনাবাহিনী ব্ল্যাক কোকেন তৈরি করেছিল। কথিত আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে পাচারের জন্য চিলিতে একটি গোপন কোকেন ল্যাবরেটরি স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন পিনোশে।
নতুন মাদক, নতুন কৌশল
শামীম জানান, মাদক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে সময়ে সময়ে দেশে নতুন নতুন মাদক নিয়ে আসছে।
'তারা মাদক বহনের জন্য চতুর সব কৌশল অবলম্বন করছে। এ প্রথম ব্ল্যাক কোকেন নামক একটি নতুন মাদক পাওয়া গেছে। আমরা সন্দেহ করছি, আন্তর্জাতিক কুরিয়ার ব্যবহার করে কোনো পার্সেলের মাধ্যমে এ চালান ঢাকায় আনা হতে পারে। একইভাবে ডিওবি এবং অন্যান্য নতুন কিছু মাদকও আনা হয়েছিল,' বলেন তিনি।
তবে কীভাবে কোন দেশ থেকে এ কোকেন আনা হয়েছিল, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। রুবেল বর্তমানে পলাতক থাকায় মাদকটি দেশে কত গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে এবং কারা এর বিক্রিতে জড়িত তাও জানা যায়নি।
তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
'দেশে এর আগে কখনো ব্ল্যাক কোকেন পাওয়া যায়নি। তাই এটি নিয়ে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। বাংলাদেশে এটি নতুন মাদক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া দেশের সব ইউনিটকে এটি নিয়ে অবহিত করা হবে,' বলেন ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারি।
নতুন মাদকের ঢেউ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে নতুন নতুন মাদক ঢোকার পরিমাণ বেড়ে গেছে।
পাটোয়ার বলেন, 'কোকেন একটি শক্তিশালী উত্তেজক ওষুধ। হৃদপিণ্ডকে প্রভাবিত করা এ মাদক অতিরিক্তমাত্রায় [ওভারডোজ] গ্রহণ করা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ।'
গত ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সাড়ে আটকেজি কোকেনসহ দুই বিদেশিকে গ্রেফতার করে। এটি দেশে এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান। এরপর গত সপ্তাহে কোকেন সিন্ডিকেটের আরও পাঁচ দেশি-বিদেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো দেশে নতুন মাদক হিসেবে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস এবং এলএসডি'র কথা জানা যায়।
এর আগে ২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চা পাতার মতো দেখতে নিউ সাইকোঅ্যাকটিভ সাবস্ট্যান্স (এনপিএস) বা খাত নামক মাদক জব্দ করেছিল। এছাড়া গত সেপ্টেম্বরে দেশে আরেকটি শক্তিশালী মাদক হেরোইন ধরা পড়েছিল।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত