লাঠিয়াল বাহিনীর দখলে মেঘনার চরের প্রায় ১ লাখ একর জমি

গত ৩০-৪০ বছর যাবত লক্ষ্মীপুরের চারটি উপজেলার মেঘনা নদীর ২০টি চরে প্রায় ১ লাখ একর জমির অর্ধেকই ২৫-৩০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলে চলে গেছে। দখল স্থায়ী করতে অনেকেই চরের জমি নিজেদের দাবি করে নিম্ন ও উচ্চ আদালতে অনেক মামলা জুড়ে দিয়েছেন। কিছু চরে রয়েছে সীমানা আন্তঃজেলা সীমানা বিরোধ। চরে প্রশাসনের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
আলতাফ মাস্টার। মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের বহু জমিতে চলে তার ইশারা। চরের মাছঘাটকে গড়েছেন বিনোদন কেন্দ্র, গড়েছেন নতুন বাজার, তৈরি করিয়েছেন রাস্তা। তার মতো এরকম ২৫-৩০ জনের হাতেই রয়েছে লক্ষীপুরের মেঘনায় নতুন চরগুলোর রাজত্ব বা কর্তৃত্ব।
অথচ নদীসংক্রান্ত সিকস্তি ও পয়স্তি আইনে রয়েছে, নতুন জেগে ওঠা চরের মালিক সরকার। এসব জমি নথিভুক্ত করে বৈধ মালিক বা ভূমিহীনদের কাছে হস্তান্তরের দায়িত্ব জেলার ডিসি (কালেক্টর) এবং ভূমি কর্মকর্তাদের।
তবে তিন থেকে চার দশক আগে জেগে ওঠা এসব চরের জমির এরকম প্রশাসনিক বিলিবন্টনের কোন ঘটনার কথা জানা নেই চরবাসীদের।
ভূমি কর্মকর্তারা বলেছেন, জরিপ না হওয়া, আন্তঃজেলা সীমানা জটিলতা আর মামলা-মোকদ্দমার কারণে দুর্গম চরের জমি-জমা আয়ত্তে আনা যাচ্ছে না। এই ফাঁকে চলে চর দখল, পাল্টা দখল, খুনাখুনি। জোতদাররা নিজস্ব লাঠিয়াল দিয়ে এসব নিয়ন্ত্রণে রাখে।
চলতি বছরের জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, লক্ষ্মীপুর সদর, কমলনগর এবং রামগতি পর্যন্ত ৭৬ কিলোমিটার এলাকায় মেঘনা নদীর ৮টি চর ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতি এবং দূর্গম চরের জমি উদ্ধারে সরকারের সহজ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ না থাকায় যুগের পর যুগ চর নিয়ন্ত্রণে রেখেছে স্থানীয় দখলদাররা। তাদের রয়েছে লাঠিয়াল বাহিনী। ভূমিহীন কিছু মানুষ দখলদারদের লাগদি (চাঁদা) দিয়ে চরের বসবাস কিংবা বর্গায় চাষাবাদ করে।

রায়পুর উপজেলার নতুন কানিবগার চর ও চর কাছিয়ার বাসিন্দারা জানায়, প্রভাবশালীরা উত্তরাধিকারী (বয়া) সূত্রে এসব চরের মালিক। জমি হিসেব করে তারা বার্ষিক চাঁদাও নেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক নারী জানান, লাগদির টাকা না দিয়ে চরের এক ইঞ্চি জমি, নদী, খালের পানিও ব্যবহার করা যায় না। চর কাছিয়ায় রহমান মাঝিও (৩৫) জানান একই কথা।
জসিম হাওলাদার (৩৫) নামক আরেক বাসিন্দা কানিবগার চরের পাশে চরকাছিয়ায় ছোট একটি বসতি স্থাপন করেছেন। একজনকে ১০ হাজার টাকা বার্ষিক লাগদি (চাঁদা) এবং ১৮ হাজার টাকা স্ট্যাম্প খরচ দিয়ে বসতির জন্য এককানি (১.৬ একর) জমি নিয়েছেন। জমিটি বন্দোবস্ত নেওয়ার জন্য ৩ বার নথি জমা দিয়েছেন। কিন্ত কাগজ করতে পারেননি। তার আশংকা এ জমিটি হয়তো দখলদাররা নিয়ে যাবে।
কানিবগা নতুন বাজার থেকে পশ্চিম দিকে খালি মাঠের মধ্যখানে ছোট একটি ঝুপড়ি ঘরে তিন মেয়ে নিয়ে বসবাস করে মজিবুল সিকদার মাঝি দম্পতি। এ ঝুপড়িতেই ১২ বছর কেটেছে তাদের। মজিবুল সিকদার জানায়, চরে হাজার হাজার একর সরকারি জমি পড়ে আছে। কিন্ত তাদের এক টুকরো জমি নেই।
২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্মল এটলাস থেকে জানা যায়, উত্তর চর বংশী ইউনিয়নের নতুন কানিবগার চর মৌজায় সরকারি হিসেবে জমি রয়েছে ৭ হাজার ৮শ ৬৭ একর। চর খাসিয়া, জালিয়ার চর, চর পাগলা মৌজাসহ ৪টি মৌজায় ১০ হাজার ৪শ ৯৭ একর।
গ্রামবাসীরা জানিয়েছে ২০০১ এবং ২০০৮ সালে সামান্য কিছু জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। বাকি ৯০ ভাগই খাস। চরগুলোর বয়স আনুমানিক ৪০ বছর। সবগুলো চরে প্রায় ৩-৪ হাজার মানুষের বসতি রয়েছে। চরের বাসিন্দা ছালা উদ্দিন, রফিক এবং খালেক জানিয়েছেন, প্রায় ১২ বছর আগের পরিমাপের সাথে বর্তমানে সেখানে অন্তত আরো ২০ হাজার একর নতুন জমি যুক্ত হয়েছে।
কানিবগার বাসিন্দা ছালা উদ্দিন(৫০), রফিক ব্যাপারি (৫০), খালেক হাওলাদার (৮০), শাহাজাহান সর্দ্দার (৬৫), কাজল হাওলাদার (৪০),আবদুল রশিদ ব্যাপারি(৬০) সহ অনেকেই গত ১৫-২০ বছর চর কাছিয়া ও কানিবগার চরে বাস করেন। এদের ১ জনের বন্দোবস্তের জমি রয়েছে। অন্যরা দখলদারদের লাগদি দিয়ে বসবাস করে। কয়েকজন কিছু দখলদারদের থেকে ২-৩ লাখ টাকা দিয়ে কার্ডের জমি ও খাস জমি কিনেছেন।
দখলদার কারা ?

বেশ কয়েকজন স্থানীয় জানিয়েছেন, মেঘনার সবগুলো চরের প্রভাবশালীদের মধ্যে জলদস্যু, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ইউপি সদস্য, ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান রয়েছেন।
তারা আরো বলেন, অতীতে চর দখলকারীরা ছিল জলদস্যু। বর্তমানে মূল ভূখণ্ডের রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিরা চরের একমাত্র দখলদার। তারা মূল ভূখণ্ডে বসে লাঠিয়াল বাহিনীর মাধ্যমে চরে বসবাস, চাষাবাদ, পশুপালন, মাছ ধরা, জমির বালু ও মাটি বিক্রিসহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেকে আন্তঃজেলা বিরোধ সৃষ্টি করে একএকটি চরকে বানিয়েছে নিজের চিরস্থায়ী একক রাজ্য।
নতুন কানিবগার চরের ৪-৫ জন স্থানীয় বাসিন্দা জানিয়েছেন, উত্তর চর বংশী ও দক্ষিণ চর বংশী ইউনিয়নের ৭টি চরে রয়েছে ৮-১০জন প্রভাবশালী দখলদার। বাসিন্দারা দখলের সীমানা দেখিয়ে জানিয়েছেন, নতুন কানিবগার চর, কানিবগা তপ্ত চর, কানিবগার চর, চরঘাসিয়া, চরকাছিয়া ও চর জালিয়া এলাকায় রায়পুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা মাস্টার আলতাফ হোসেন হাওলাদার বিভিন্ন লোকজনের নামে দখলে রেখেছেন অন্তত ৫ হাজার একর জমি।
কিন্তু, আলতাফ হোসেন মাস্টার জানিয়েছেন, স্থানীয় এলাকাবাসীর পূর্বপুরুষের মালিকানাধীন চরের ২৩শ একর জমি নিয়ে উচ্চ আদালতে এলাকাবাসীর মামলা রয়েছে। তিনি চরের নেতৃত্ব দিলেও কোন মামলার বাদি নন। বাসিন্দারা জানিয়েছেন মফিজ খাঁ নামের এক ইউপি সদস্যের দখলে রয়েছে প্রায় ১ হাজার একর জমি।
রায়পুরের তিনটি এবং বরিশাল জেলার ১টি সহ মোট ৪টি চরে মোস্তফা কামাল বেপারি, মহিন উদ্দিন আমিন, আবুল মাল, ফারুক ছৈয়াল, চর কাছিয়ায় আবুল কাজী, বাদশা কাজী, রশিদ মোল্লা, দেলু সর্দ্দার ও জাকির মোল্লা, মনির মোল্লার নামের কয়েকজন চরের জমি দখল নিয়ে বিভিন্ন মামলার আসামী ও বাদি।
সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়নের মজুচৌধুরীর হাটের পশ্চিমে মেঘনা নদী দ্বীপ চর মেঘাসহ ছোটবড় ৫টি চরের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধি আবু ইউসুফ ছৈয়াল চেয়ারম্যান এবং আলমগীর হোসেন মেম্বার ও স্থানীয় করাতি পরিবার। রয়েছে আরো কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতা। চেয়ারম্যানের দখলে ১ হাজার একর জমি রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
রামগতির ১৬ হাজার ২শ একর আয়তনের চর আবদুল্লাহ পুরো ইউনিয়নটি খাস। ভোলা জেলা ও হাতিয়ার ২ জন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির সহায়তায় তেলিয়ার চর, মৌলভীর চর, চর মুজাম, চর সেভাজ নিয়ন্ত্রণ করে খোকন ও ফখরুল নামের দুই সহোদর জলদস্যু। খোকন ও ফখরুলের নামে বিভিন্ন থানায় অসংখ্য মামলা রয়েছে।

রামগতির যুবলীগ নেতা মেজবাহ উদ্দিন ভিপি হেলাল জানান, চর আবদুল্লাহর বেশিরভাগ জমি ৫-৬জন রাজনৈতিক নেতার দখলে রয়েছে। তারা জমিচাষ, বসতি এবং পশুপালনে অনুমতি দিয়ে টাকা নেয়।
চর আবদুল্লাহ ইউনিয়নের একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কামাল হোসেন মঞ্জুর চেয়ারম্যানের ভাই লাঠিয়াল প্রধান বাবুল। চেয়ারম্যানের দখলে রয়েছে প্রায় ৫শ একর।
বন্দোবস্তেও হাত রয়েছে প্রভাবশালীদের
স্থানীয়রা জানায় ২০০১ সালে এবং ২০০৮ সালে রায়পুরের কিছু জমির বন্দোবস্ত দেয় সরকার।
রহমান গাইন নামের একজন জানায়, তখন বন্দোবস্ত দেওয়া নথিগুলোর বেশিরভাগই নামে-বেনামে তৈরি করেছিলেন প্রভাবশালী দখলদাররা। বর্তমানে সেগুলো ভূমিহীনদের মাঝে উচ্চ মূল্যে হস্তান্তর করছে তারা।
প্রভাবশালীদের লাঠিয়াল বাহিনী
রায়পুর, লক্ষ্মীপুর সদর এবং রামগতিরের সকল চরে প্রভাবশালীদের লাঠিয়াল বাহিনী রয়েছে।
উত্তর চর বংশী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. মোস্তফা কামাল বেপারী এ প্রতিবেদকের নিকট স্বীকার করেছেন, আলতাফ মাস্টার তার মাধ্যমে কানিবগার দক্ষিণ অংশ দেখাশোনা করে।
তিনি জানান, "মানুষ তাকে মান্য করে। কানিবগা নামে একটি নতুন বাজার গড়ে তুলছেন আলতাফ মাস্টার। জমির মালিকদের ব্যক্তিগত চাঁদায় হাজীমারা স্লুইচ গেইট থেকে বরিশালের গোবিন্দপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার কাচাঁ সড়কও নিমার্ণ করে ফেলেছেন আলতাফ মাস্টার।" রাস্তার নিমার্ণ ও বাজার তৈরি দেখাশোনা করছেন মোস্তফা ব্যাপারী।

গত ২ বছর যাবত লক্ষ্মীপুর জেলার সুপরিচিত একটি বিনোদন চর জালিয়ার আলতাফ মাস্টার ঘাঁট। সে এলাকাটিও খাস। চরের জমি দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে আলতাফ মাস্টার জানান, "চর জেগে উঠার পর ১৯৯৪-১৯৯৫ সালের দিকে বরিশালের জনৈক টুনু চৌধুরী হাজীমারা স্লুইচ গেইট পর্যন্ত এসে লক্ষ্মীপুর জেলার জমি দখল করে বসে। বিষয়টি আমি মেনে নিতে পারিনি।"
"সে সময় আমি প্রশাসন ও স্থানীয় এলাকাবাসীর সহযোগিতা নিয়ে টুনু চৌধুরীর দখল করা সব ভূমি উদ্ধার করে আমাদের দখলে নিই। এ জন্য একাধিকবার তাদের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে। তারা আমাদের নামে ২টি মামলা করেছে আমরাও পাল্টা ২টি মামলা করেছি।"
সে সময়ে উদ্যোগ না নিলে এ জমি তারা দখলে নিয়ে যেত বলেন জানান আলতাফ মাস্টার। তবে তার নিকট প্রকৃতপক্ষে কত জমি রয়েছে সে বিষয়ে কোন তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানান আলতাফ মাস্টার।
দখলের অভিযোগ থাকা সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আবু ইউছুফ ছৈয়াল জানান, "ভোলার কিছু সন্ত্রাসী এসে লক্ষ্মীপুরের মেঘার চর সহ আশপাশের চরগুলো দখলে নিতে চায়। দখলে বাঁধা দিয়ে আমি লক্ষ্মীপুরের চরগুলোতে নিয়ন্ত্রণ রেখেছি। এজন্য একাধিক মামলার আসামি হয়েছি।"
তিনি বলেন, "চরের ৪-৫শ একর জমিতে আমি মহিষ পালন করি।"
তবে স্থানীয়রা জানিয়েছে, চেয়ারম্যানের দখলে রয়েছে অন্তত ১ হাজার একর। এ চরগুলোর অন্য দখলদারদের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
সরকারি তথ্যে চর রমনীমোহন, মেঘার চর, নব্বার চরে জমির পরিমাণ রয়েছে ২১ হাজার একর। যার শতকরা ৮০ ভাগই খাস।
দখলদাররা চরে কী করে?
বর্তমানে চরগুলোতে ব্যাপক হারে সয়াবিন, ধান উৎপাদন ও প্রায় লাখের মতো গরু-মহিষ পালন করা হয়। চরগুলো হয়ে উঠেছে টাকা আয়ের বিশাল ক্ষেত্র।
রায়পুর থেকে রামগতি পর্যন্ত চরগুলোর দূরত্ব প্রায় ৭৬ কিলোমিটার হলেও প্রত্যেকটি চরের নিয়মকানুন প্রায় একই রকম।

চর শামছুদ্দিনের জিল্লাল, চর কাছিয়ার মফিজ, চর মেঘার শাহজালাল মোল্লা জানায়, চরে বসতি ও চাষাবাদের জন্য কানি (১.৬একর) ১০ হাজার, গবাদি পশু পালন ও চাষাবাদের জন্য কানি ৫ হাজার লাগদি দিতে হয়।
কিছু চর মহিষ ও গরুর মালিকদের নিকট প্রতি সিজনে ভাড়া দেওয়া হয়। চরের খালে মাছ শিকার করতে জেলেরা টাকা কিংবা মাছের ভাগ দেওয়া লাগে।
রায়পুরের প্রায় চরে স্কেভেটর কিংবা ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু তুলে বিক্রি করছে দখলদাররা। কেউ কেউ চরে দীঘি খনন করে মাছ চাষ করছে। দখলদারদের নিয়োজিত কর্মী বাহিনী বা লাঠিয়াল বাহিনীর মাধ্যমে চাঁদা আদায় করে।
এসব নিয়ে ভয়ে মুখ খোলার সাহস পায়না কেউ।
চর নিয়ে আইনে কী আছে?
নদীতে জমি ভেঙে যাওয়াকে শিকস্তি বা ডাইলুভিয়ন বলে। আর এলুভিয়ন বা পয়স্তি হলো নতুন চর সৃষ্টির মাধ্যমে জমি পুনরায় জেগে ওঠা।
১৯৯৪ সালের ১৩ জুলাই তারিখের আইন অনুযায়ী, কোনো জমি শিকস্তি হওয়ার ত্রিশ বছরের মধ্যে স্বস্থানে পয়স্তি হলে জমির পূর্বতন মালিক বা তাদের ওয়ারিশগণ শর্ত সাপেক্ষে ফেরত পাবেন। তবে জমি পয়স্তি হলে প্রথমে তা কালেক্টরের পক্ষে দখল গ্রহণ করবেন পরে গণবিজ্ঞপ্তি জারি ও জরিপ সম্পন্ন করবেন। নকশা প্রস্তুতের পর পূর্বতন মালিক বা তাদের ওয়ারিশগণের নামে কালেক্টর জমি বরাদ্দ দেবেন।
চর কালকিনির আলা উদ্দিন মাঝি জানিয়েছেন, তিনি কখনো শুনেননি সরকার লক্ষ্মীপুর জেলার কোন চরের জমি উদ্ধার করেছিল। সরকারের নিরবতার সুযোগে প্রভাবশালীরা ইচ্ছামতো চরের জমি দখল করে নিচ্ছে।

আলা উদ্দিন মাঝি আরো জানায়, একবার যারা দখল নিতে পেরেছে গত ৩০ বছরে সেগুলো আর উদ্ধার হয়নি। উদ্যোগও দেখেননি।
'ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ এ বলা হয়েছে, বৈধ কাগজপত্র না থাকার পরেও কেউ যদি সরকারি খাস ভূমি জমি জোর করে দখল করে রাখেন, সেজন্য কারাদণ্ড ও জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
নদীর চর দখলের প্রধান হাতিয়ার আন্তঃজেলা সীমানা বিরোধ ইস্যু ও মামলা
মনির ও ছিদ্দিক নামের ২ বাসিন্দা জানায়, সীমানা বিরোধ থাকলেই চর দখল সহজ। কারণ বিরোধ নিষ্পত্তির আগে ওই জমির জরিপ, ম্যাপ কিছুই হতে পারে না। জরিপ ও ম্যাপ না হলে বন্দোবস্ত দেওয়া যায় না এবং আদালতের মামলাও রায় হয় না।
মেঘনা নদীর অন্তত ১০টি চর নিয়ে ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় সময় বিরোধ দেখা দেয় বলে জানিয়েছেন মেঘার চরের বাসিন্দা ওহাব আলী।
তিনি জানান, লক্ষ্মীপুর জেলার কিছু চর পাশের ভোলা ও বরিশাল এবং ভোলা, বরিশালের কিছু চর লক্ষ্মীপুরের প্রভাবশালীরা দখলে নিয়েছে। সেগুলো নিয়ে কয়েকবার মারামারি হয়েছে। প্রতিটি বিরোধের পরপরই মামলা ও পাল্টা মামলা হয়েছে।
সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তিতেও সমস্যা
২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক সভায় জানানো হয়, আন্তঃজেলা সীমানা বিরোধের নিষ্পত্তির ভিত্তি হবে সিএস রেকর্ডের সীমানা। অন্যদিকে জরিপকাজ সম্পাদন ও মৌজা ম্যাপ চূড়ান্ত না করে নদ-নদীতে জেগে ওঠা নতুন চরের বন্দোবস্ত না দিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে অনুবিভাগের একটি চিঠি সূত্রে জানা গেছে, ২০১১-২০১২ অর্থবছরে ভোলা সদর উপজেলার সাথে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা ও রামগতি উপজেলার আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণকালীন সরেজমিনের ভূমি রেকর্ড কর্মকর্তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে স্থানীয়রা।
প্রভাবশালীদের নির্দেশে চরের বাসিন্দারা তাদের ওপর হামলা করে। পরে জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পিলার স্থাপন না করেই কর্মসূচী ত্যাগ করেন। এখন পর্যন্ত ভোলা ও লক্ষ্মীপুর জেলা সীমানা বিরোধ চলমান রয়েছে। যা দখলদারদের জন্য বড় সুযোগ।
যেভাবে হয় চর দখল
স্থানীয় মাওলানা নুর হোসেন জানিয়েছেন, নদীতে চর জাগলে খবর পেয়ে বাঁশের খুটিঁ গেড়ে নিশানা দেয় দখলদাররা।
চরের বুকে খুব উচূঁ টং ঘর তুলে দেয়। এক একটি টং ঘরের আশপাশে প্রায় শত কানি (১শ৬০একর) জমির মাঝে কেউ আসতে পারবে না। এরপর কিছু গরু মহিষ ছেড়ে দিয়ে চরটি পুরো দখলে নেয়।
তারপর চরটি তাদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি কিংবা এ ভূমি তিনি সরকার থেকে লিজ এনেছে বলে প্রচার করে। কিছু ক্ষেত্রে আদালতে জুড়ে দেয় মামলা, তারপর মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা চরের মালিক।
দখল নিয়ে খুনোখুনি, মামলা
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর জেলায় চর দখল নিয়ে গত ২০ বছরের মধ্যে ২০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনাসহ অন্যান্য ঘটনায় প্রায় ১শটির মতো ফৌজদারী মামলা রয়েছে বিভিন্ন আদালতে।
২০০১ সালে সদর উপজেলার চর রমনী মোহনে ৪ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রামগতির তেলিয়ার চরে ডাকাত খোকন ও সাইফুল বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হয়।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চর দখল নিয়ে চরবংশী ইউনিয়ন আওয়ামী নেতা রাহুল ও ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নজরুল ইসলাম গ্রুপের সংঘর্ষে এক কিশোর নিহত হয়।
জুলাই মাসে চরমেঘা দখল করতে এসে ৫টি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে লুটের ঘটনা ঘটেছে।
চর নিয়ে মামলা কেন শেষ হয় না?
রায়পুর এবং লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চরের জমির মামলা নিয়ে ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সরকারের পক্ষের কৌশলী ছিলেন লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের আইনজীবি খোরশেদ আলম। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, বিশেষ কোন ক্ষমতা প্রয়োগ ছাড়া দখলদার থেকে চরের জমি উদ্ধার করা অসম্ভব।

তিনি বলেন, দখলদারা অবিশ্বাস্য রকমের মামলাবাজ। তারা কোন মামলা নিদিষ্ট আদালতে না রেখে বার বার আদালত পরিবর্তন করে। দখল রাখতে তারা সব আদালতেই মামলা করে। বেশিরভাগ মামলার বাদি হয় একাধিক ব্যক্তি। চিরস্থায়ী দখলের জন্য আন্তঃজেলা সীমানা বিরোধ নিয়ে তারা নিম্ন ও উচ্চ আদালতে মামলা জুড়ে দিচ্ছে।
এ আইনজীবি বলেন, দখলদাররা এখন নিম্ন আদালতে কোন মামলা রাখেনি। তাদের সব মামলা এখন উচ্চ আদালতে। আদালতের মামলাই তাদের জমি দখলের হাতিয়ার।
লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের আইনজীবি ও জেলা আওয়ামীলীগের প্রস্তাবিত সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল মাহমুদ ভূইঁয়া মান্না জানান, রাজনৈতিক পরিচয়ে চর দখলকারীরা আসলে রাজনীতিটা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। তাদের বিষয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। অন্যদিকে যে কোন উপায় বা কোন প্রকল্পের মাধ্যমে লক্ষ্মীপুরের সবগুলো চর সরকারের হেফাজতে নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
প্রশাসন যা বলছে
রায়পুর উপজেলা ভূমিকর্মকর্তা রাসেল ইকবাল এবং রামগতি উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা মো. আমজাদ হোসেন উভয়ের বক্তব্য একই রকম। তারা জানান, বর্তমানে ভূমি কর্মকর্তাগণ এত বেশি দায়িত্বে থাকেন যাতে তারা আলাদাভাবে চরের প্রতি বিশেষ নজর দিতে পারে না। আবার মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে এবং দূর্গম হওয়ায় চরের বাসিন্দারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও কোন অভিযোগ জানাতে পারেন না।
এসব কারণে প্রশাসণের তেমন নিয়ন্ত্রণে নেই চর। সে সুযোগে প্রভাবশালী মানুষেরা চরের দখল পাকাপোক্ত করতে পেরেছে।
তারা আরো জানান, খাস জমি প্রভাবশালীদের দখল থেকে উদ্ধার করতে গেলেই মামলা জুড়ে দিয়ে তা বন্ধ করে দেয়। আন্তঃসীমানা বিরোধও রয়েছে। তাই চরের জমি কাজে লাগাতে হলে রাজনৈতিক ব্যক্তি, স্থানীয় সরকার এবং বিচার বিভাগের সমন্বয়ে সমাধানের চেষ্টা বের করতে হবে।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর সবগুলো চরে দিয়ারা জরিপ পরিচালনা করা হবে। জরিপ ও ম্যাপ প্রস্তত ছাড়া এ জমি কাউকে বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে না।
অন্যদিকে আন্তঃজেলা সীমানা বিরোধের কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিরোধ নিস্পত্তি ছাড়াও কিছু সমস্যা সমাধান করা সম্ভব না।
চরের জমির সমাধান চান স্থানীয়রা
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর অধীন্যস্ত সংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটি-সনাক এর লক্ষ্মীপুর জেলা সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর জেএম ফারুকী বলেন, "সরকারি নানা নিয়মকানুন এবং জরিপকাজ সম্পাদন ও মৌজা ম্যাপ কিংবা জেলার সীমানা বিরোধ মিটিয়ে নতুন চর সরকারের দখলে নিয়ে বন্দোবস্ত দিতে কয়েক যুগ কেটে যাবে। দীর্ঘ এ সময়কে সুযোগ হিসেবে নিয়ে একেকজন দখলদার হাজার হাজার একর চরের জমি দখলে রেখেছে।অন্যদিকে ভূমিহীন ও অসহায় মানুষ চরের জমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করতে পারছে না।" বিশেষ কোন পদ্ধতিতে তিনি এর সমাধান চান।
চরের বাসিন্দা রহমান মাঝি, ছিদ্দিক, আলা উদ্দিন, মনিরসহ অন্তত ৫০ ব্যক্তির সাথে কথা হলে তারা জানায়, বন্দোবস্ত না দিতে পারলেও তাদের বসবাস ও চাষাবাদের জন্য পুরো চর সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রয়োজনে বিশেষ একটা নীতিমালা তৈরি করে ভূমিহীনদের মধ্যে কমপক্ষে ৫ থেকে ১০ বছরের জন্য কিছু জমি লিজ দেওয়া যেতে পারে।
এতে চরের বাসিন্দারা আইনিভাবে বসবাস ও চাষাবাদের সুযোগ পাবে। এতে চরের জরিপকাজ সম্পাদনও সহজ হবে এবং কমে যাবে অপরাধ এবং সরকার রাজস্ব পাবে।
লক্ষ্মীপুর জেলায় মেঘনার চর ও জমি
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের উত্তর সীমানা চর ভৈরবী থেকে লক্ষ্মীপুরের দক্ষিণ সীমানা রামগতির টাংকি বাজার পর্যন্ত প্রায় ৭৬ কিলোমিটার এলাকায় মেঘনা নদীতে রয়েছে ২০টি চর। এসব চরের বেশিরভাগের বয়স ২০-৪০ বছর।
২০১১ সালের পরিমাপের ওপর ভিত্তি করে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর স্মল এটলাসের তথ্য মতে এসব চরে রয়েছে ৪৮ হাজার একর জমি। যার মধ্যে রায়পুর থেকে সদর উপজেলার নতুন কানিবগার চর, চর কাছিয়া, খাসিয়ার চর, জালিয়ার চর, চর পাগলা, চর ইন্দুরিয়া, কানিবগার চরের আয়তন ১৮,১১৫ একর।
সদর উপজেলার চররমনী মোহন, চর মেঘা, নব্যার চর, ভোলার চরের আয়তন ১৯,৪৫৫ একর।
কমলনগরের চর শামসুদ্দিন, চর মাতব্বর, মাইজের চরের আয়তন ১২০০ একর। এবং রামগতি উপজেলার চর আবদুল্লাহ, তেলিয়ার চর, মৌলভীর চর, চর মুজাম চরের আয়তন ২৬,৩৩২ একর।
তবে গুগলআর্থের মেজারমেন্ট টুলস ব্যবহার করে দেখা গেছে পরিমাপের ১২ বছর পর মেঘনার লক্ষ্মীপুর সীমানায় চর রয়েছে ৬৫ হাজার একর। এছাড়া ভোলা, বরিশাল ও নোয়াখালীর আন্তঃসীমানা এলাকার চরসহ লক্ষ্মীপুরের মেঘনার চরগুলোতে জমির পরিমাণ কমপক্ষে ১ লাখ একর।
স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছে মেঘনায় আরো চর বাড়ছে।