অস্ট্রেলিয়া-যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে দেশীয় মিষ্টি: বিশ্ববাজারে রপ্তানির সম্ভাবনা কতটুকু?
বাংলাদেশের শহর-গ্রামাঞ্চলের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন মিষ্টির ব্র্যান্ড। সময়ের সঙ্গে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানও নেমেছে এই ব্যবসায়ে। কিন্তু গত এক দশকে পণ্যটির ভিন্নতা, উন্নয়ন হলেও বিশ্ববাজারে ঢুকতে পারেনি বাংলাদেশ।
এরপরেও আশার কথা হল— অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে স্বল্প পরিমাণে মিষ্টি রপ্তানি শুরু হয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বৈশ্বিক বাজার বিবেচনায় মিষ্টি পণ্য রপ্তানির দিকে নজর দিলে নতুন সম্ভবনা সৃষ্টি হবে।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত ১৭ আগস্ট তিন ধরনের মিষ্টি ও দই মিলে ১,৯৩২ কেজি পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছে রিভারেইন ফিস অ্যান্ড ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। এই মিষ্টির মধ্যে ছিল কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী রসমালাই ৪১৬ কেজি, চমচম ৩২৬ কেজি ও কালোজাম ৩৯০ কেজি।

এর আগে, গত মে মাসে বিডি ফুডসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সবজিয়ানা ১,১০০ কেজি মিষ্টি পাঠিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। এরমধ্যে ছিল স্পঞ্জ রস গোল্লা, রস গোল্লা, চমচম, ক্ষীর মোহন, ল্যাংচা এবং মিষ্টি দই।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের রোগতত্ত্ববিদ সৈয়দ মুনিরুল হক টিবিএসকে বলেন, "অন্যান্য কৃষি পণ্যের সঙ্গে মিষ্টি পণ্যও রপ্তানি হয়েছে সমুদ্র পথে। অস্ট্রেলিয়ায় চালান নিয়ে আমরা একটু ভয়ে ছিলাম। ওই দেশের সংগনিরোধ বেশ কঠিন। তবে সফলভাবে গিয়েছে। আশা করছি, যুক্তরাষ্ট্রের চালানটিও সফলভাবে যাবে।"
"আমাদের স্থানীয় জনপ্রিয় মিষ্টিজাত পণ্যগুলো গুণগত মানসম্পন্ন। উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলে রপ্তানিখাত বড় হতে পারে," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ মিষ্টি প্রস্তুতকারক সমিতির তথ্যমতে, নিবন্ধিত প্রায় ৪০০ সদস্য রয়েছে এই সংগঠনটির।
এর বাইরে সারাদেশে দুই হাজারেরও বেশি স্থানীয় উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে। তবে এসব প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করছে না।
রপ্তানি স্বল্প পরিমাণে যা হচ্ছে, তাও ক্রেতারা করছেন, উৎপাদক নয়। রপ্তানির বিপরীতে বিদেশে অবস্থারত বাংলাদেশীদের চাহিদার ভিত্তিতে সেখানেই আউটলেট খুলছে মিষ্টির ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রামভিত্তিক বনফুল দুবাই ও লন্ডলে আউটলেট খুলেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামাঞ্চলের পণ্যটি ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলছে গত এক দশক ধরে। এ সময়টুকুতে পণ্যটির স্বাদে ভিন্নতা আনা, বিভিন্ন রকমের পণ্য তৈরিসহ এর উন্নয়নে কাজ চলছে। এরমধ্যে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানও যুক্ত হচ্ছে বিনিয়োগ নিয়ে। পণ্য উন্নয়নের পরের ধাপে রপ্তানির দিকে নজর দেবেন উদ্যোক্তারা।
দেশের মিষ্টির ব্যবসা শুরু মূলত প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। গ্রামাঞ্চলে দুই হাজারেরও বেশি দোকানে মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি হয় মিষ্টি। যার জনপ্রিয়তাও অঞ্চলভিত্তিক। কুমিল্লার রসমালাই, টাঙ্গাইলের চমচম, যশোরের জামতলার রসগোল্লা, নওগাঁর প্যারা সন্দেশ, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, মুক্তাগাছার মণ্ডা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি ইত্যাদির খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে।
তবে রসগোল্লার কপিরাইট কলকাতার হলেও বাংলাদেশের রসগোল্লাও বিখ্যাত। এছাড়া ঢাকাভিত্তিক ব্র্যান্ড দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো মিনা সুইটস, প্রিমিয়াম সুইটস, প্রমিনেন্ট সুইট রস, বনফুল, মিঠাই, জয়পুর, মুসলিম সুইটস ইত্যাদি। তারা নিজস্ব ব্র্যান্ডকে প্রমোট করছে।
বাংলাদেশ মিষ্টি প্রস্তুতকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডেকে বলেন, "একসময় গ্রামাঞ্চলের স্থানীয় দোকানে মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি হতো। গত এক দশকে শিক্ষিত উদ্যোক্তা এগিয়ে এসেছেন এ খাতে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানকরণ হয়েছে। অর্থাৎ ব্র্যান্ড হিসিবে দাঁড় করানোর মাধ্যমে নতুন কাঠামো তৈরি হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া এখনো চলমান।"
"অর্থাৎ একটি শিল্প প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ব্র্যান্ডে পরিণত হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকে দেশের বাজারের উন্নয়ন হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। ফলে বিদেশি রপ্তানির বিষয়টি এখনো গুরুত্ব পায়নি। আশা করছি, তিন থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে রপ্তানির বিষয়টি গুরুত্ব পাবে," যোগ করেন তিনি।
বিশ্ব বাজারের বাংলাদেশের সম্ভবনা
বৈশ্বিকভাবে মিষ্টান্ন খাতের পণ্যের হিসেবে বিবেচনা করা হয় চকলেট, বিস্কুট, আইসক্রিম ও মিষ্টিকেও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ সম্প্রতি কনফেশনারি মার্কেট সাইজ অ্যান্ড শেয়ার বিষয়ক এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০২২ সালে এ খাতের মার্কেট সাইজ ভ্যালু দাঁড়ায় ৩০৯.৯৮ বিলিয়ন ডলার। এই খাত থেকে ২০২৮ সালে ৪০১.৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব আদায়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুগার কনফেকশানারি খাতে রপ্তানি আয় হয়েছে ২৩৬ দশমিক ৮১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে এখানে রসমালাই বা মিষ্টান্ন পণ্যের অবদান নেই বললেই চলে। বর্তমানে স্বল্প পরিমাণে যেটুকু মিষ্টি বিদেশ যাচ্ছে, তাও অন্য পণ্যের সঙ্গে পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া, অবাণিজ্যিক হিসেবে বিমান কার্গোর মাধ্যমেও মিষ্টি রপ্তানি হয়। এসব পণ্যের মূল ভোক্তাও প্রবাসের বাংলাদেশিরা।
রিভারেইন ফিস অ্যান্ড ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কমার্সিয়াল ইনচার্জ বশিরুল হক জিলানী টিবিএসকে বলেন, "ফ্রোজেন এবং ব্রেড-বিস্কিট পণ্যের সঙ্গে মিষ্টিও রপ্তানি শুরু করেছি আমরা। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি ক্রেতারা আমাদের পণ্যের ভোক্তা। সেখানে দেশের মিষ্টির চাহিদা রয়েছে।"
বনফুল অ্যান্ড কোং এর চেয়ারম্যান এমএ মোতালেব টিবিএসকে বলেন, "দুগ্ধজাত বিদেশে পাঠানো বেশ চ্যালেঞ্জিং। স্থানীয় চাহিদার কারণে লন্ডন ও দুবাইয়ে আমরা আউটলেট খুলেছি। সেখানেই উৎপাদন হয়। তবে রপ্তানি সম্ভবনা রয়েছে। বিমান কার্গোতে করে জাপান ও কোরিয়ায়ও আমাদের মিষ্টি যায় অল্প পরিমাণে। পণ্যের মানসংক্রান্ত জটিলতায় আশঙ্কায় বড় আকারের রপ্তানি এগোয়নি। আশা করছি, ভবিষ্যতে প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটলে রপ্তানির সম্ভবনা বাড়বে।"
তবে মিষ্টি রপ্তানির সনদ পাওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে কিছু জটিলতা।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের রোগতত্ত্ববিদ সৈয়দ মুনিরুল হক বলেন, "সমুদ্রপথে কৃষি পণ্যের সঙ্গে মিষ্টি পাঠানো হয়েছিল। সে হিসেবে অনুমিত দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শুধু মিষ্টি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সনদ কে দেবে, তা নির্ধারণ করতে হবে।"
"দুগ্ধজাত পণ্য হওয়ায় রপ্তানি সনদ বা অনুমতির এখতিয়ার প্রাণি সংগনিরোধের হতে পারে। আবার খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করলে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্বও হতে পারে। কিন্তু সেটি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়," যোগ করেন তিনি।
মুনিরুল হক আরও জানান, ভারতে এমন পণ্য রপ্তানির জন্য পৃথক সংস্থা অ্যাগ্রিকালচার প্রোসেস অ্যান্ড ফুড অথরিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের পণ্য নিয়মিত রপ্তানি শুরু হলে সেরকম কোনো কাঠামো হয়তো গড়ে উঠবে।