কোভিড লকডাউনে দেশে জন্মহার বেড়েছে: বিবিএস সমীক্ষা

কোভিড-১৯ লকডাউনের প্রভাবে দেশে শিশু জন্মহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উঠেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত এক সমীক্ষার প্রতিবেদনে।
'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২' শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে স্থূল জন্মহার (প্রতি হাজারে) বেড়ে ১৯.৩ হয়েছে, যা ২০২১ সালে ছিল ১৮.৮। এছাড়া, মোট প্রজনন হার (১৫-৪৯ বসয়ী প্রতি এক হাজার নারী) ২.০৫ থেকে বেড়ে ২.১৫-তে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া, দেশে বাল্য বিবাহ এবং শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়াসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সূচকে বাংলাদেশের অবনতি হওয়ায় ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন কঠিন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৩ জুন) রাজধানীর বিবিএস সম্মেলন কক্ষে জরিপের ফলাফল প্রকাশকালে প্রকল্পের পরিচালক মোঃ আলমগীর হোসেন জানান, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার (প্রতি হাজারে জীবিত জন্ম নেওয়া শিশুর বিপরীতে) ২০২২ সালে বেড়ে ৩১ হয়েছে; ২০২১ সালে এই হার ছিল ২৮।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।
জন্মহার বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. শামসুল আলম বলেন, "শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়। এর ফলে এসডিজি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে। এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে মাতৃ মুত্যুর হার কমা আমাদের জন্য ভালো খবর। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিবেশি অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে।"
দেশে মাতৃ মৃত্যুর অনুপাত (প্রতি লাখ জীবিত জন্ম নেওয়া শিশুর বিপরীতে) ২০২২ সালে কমে ১৫৬ হয়েছে, যা এর আগের বছর ছিল ১৬৮।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার ২০২১ সালের ৬৫.৬ শতাংশ থেকে কমে ২০২২ সালে ৬৩.৮ শতাংশ হয়েছে।
বিবিএস বলছে, এক বছরে স্থুল বিবাহের হার (প্রতি হাজার জনসংখ্যায়) ১৩.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮.১ শতাংশ হয়েছে। এছাড়া, বাল্যবিবাহ (২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে) ২০২১ সালের ৪.৭ শতাংশের তুলনায় ২০২২ সালে বেড়ে ৬.৫ শতাংশ হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্টয়ান্ডার্ডকে বলেন, "টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) বেড়েছে। এই ফলাফল আমাদের জন্য সুখকর নয়। এর একটি অন্যতম কারণ হলো, করোনাকালে যাদের বিয়ে হয়ে গেছে তারা বিয়ের প্রথম বা দ্বিতীয় বছরে বাচ্চা নিয়েছেন।"
"কোভিড ২০২১ পর্যন্ত ছিল, সেসময় যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের একটা প্রভাব রয়েছে জন্মহার বৃদ্ধিতে। গ্রামাঞ্চলে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।"
"এছাড়া, চাইল্ড ম্যারেজ, আর্লি চাইল্ড ম্যারেজ বেড়েছে। চাইল্ড ম্যারেজ বাড়লে আর্লি চাইল্ড প্রেগনেন্সি বাড়ে। গ্রাম এলাকায় এটি বেশি হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
গড় আয়ু বেড়েছে
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে গড় আয়ু সমস্যা বেড়ে ৭২.৪ বছর হয়েছে, যা এর আগের বছর ছিল ৭২.৩ বছর।
জরিপে দেখা গেছে, পুরুষ ও নারী উভয়ের গড় আয়ু ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। পুরুষদের গড় আয়ু ৭০.৬ বছর থেকে বেড়ে ৭০.৮ বছর হয়েছে। এছাড়া, নারীর গড় আয়ু ৭৪.১ বছর থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৪.২ বছর।
বেড়ছে সাক্ষরতার হার
বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৭ বছর এবং এর চেয়ে বেশি বয়সের জনসংখ্যার মধ্যে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। ২০২২ সালে এই হার হয়েছে ৭৬.৮ শতাংশ, যা এর আগের বছর ৭৬.৪ শতাংশ ছিল।
প্রতিবন্ধিতা
জরিপ অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে দেশে প্রতিবন্ধিতার (প্রতি এক হাজার জনসংখ্যায়) হার ২৪.১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৫.৫ শতাংশ হয়েছে।
বিদ্যুৎ সুবিধা
দেশে ২০২২ সালেও বিদ্যুৎ সুবিধা পায়নি ০.৭৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী। এই হার ২০২১ সালে ছিল ০.৭৬ শতাংশ।
২০২২ সালে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে ৯৭.১৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী, যা ২০২১ সালে ছিল ৯৬.৮৬ শতাংশ।
জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সুধিবার আওতা বাড়লেও কমেছে সৌর বিদ্যুতের। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ২০২১ সালে সৌর বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করত ২.২৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী। ২০২২ সালে এ হার কমে ২.০২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
টয়লেট সুবিধা
২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ০.৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখনো খোলা আকাশের নিচে মল ত্যাগ করে। এই হার ২০২১ সালে ছিল ১ শতাংশ।
নিরাপদ পয়ঃব্যবস্থাপনার সুবিধার অভিগম্যতা রয়েছে ৬৬.১ শতাংশ জনগোষ্ঠীর। এর আগের বছরে এই হার ছিল ৬৮ শতাংশ।
মোবাইল ও ইন্টারনেট
বিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী জনসংখ্যার অনুপাত (১৫ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী) ২০২২ সালে ৭৩.৮ শতাংশ, যা এর আগের বছর ছিল ৭১.৩ শতাংশ।
আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যার অনুপাত (১৫ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী) ৪৩.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৫.৫ শতাংশ হয়েছে।
ব্যাংকিং সুবিধা
জরিপ বলছে, দেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাবধারী জনসংখ্যার অনুপাত (১৫ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী) ২৭.৯ শতাংশ থেকে কমে ২৬.২ শতাংশ হয়েছে।
মোবাইল আর্থিক সেবা হিসাবধারী জনসংখ্যার অনুপাত (১৫ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী) ৪২.৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৪১.৯ শতাংশ।
বেড়েছে তালাকের হার
বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, দেশে স্থুল তালাকের হার (প্রতি হাজার জনসংখ্যায়) বেড়েছে। জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে তালাকের হার ০.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১.৪ শতাংশ হয়েছে।
গ্রামীণ এলাকায় তালাকের হার ০.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১.৮ শতাংশ। শহরাঞ্চলে এই হার ০.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১ শতাংশ হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এএসএম আমানুল্লাহ বলেন, "প্রথম বিবিএস যে পদ্ধতিতে তালাকের হিসাব করে, তা যথার্থ হয় না। ভুল পদ্ধতির কারণে প্রকৃত তথ্য উঠে আসে না। বাস্তবে দেশে তালাকের হার আরও বেশি।"
অভিবাসন
জরিপে দেখা যায়, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় অভ্যন্তরীণ আগমনের (প্রতি হাজার জনসংখ্যায়) হার ৩০.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৩০.৯ শতাংশ হয়েছে।
তবে পল্লী থেকে পল্লীতে আগমনের হার কমে ২০২২ সালে ৯.৩ শতাংশ হয়েছে, যা ২০২১ সালে ছিল ১১.৫ শতাংশ।
এদিকে, শহর থেকে পল্লীতে আগমন ৫.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০.৯ শতাংশ হয়েছে।
এছাড়া, পল্লী থেকে শহরে আগমন ১৮.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৬.৪ শতাংশ হয়েছে। শহর থেকে শহরে আগমনের হার ২৯.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে৩৮.৪ শতাংশ।
অন্যদিকে, জরিপের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অভিগমনের হার বেড়েছে। ২০২২ সালে এই হার ৬.৬ শতাংশ হয়েছে, যা এর আগের বছর ছিল ৩ শতাংশ।