২০২৩–২৪ অর্থবছরে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি শিল্প খাতে: বিবিএস-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি, শিল্প ও সেবা—তিনটি প্রধান খাতেই প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা লেগেছে শিল্প খাতে।
সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত সংশোধিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩.৫১ শতাংশে, যা আগের অর্থবছরের ৮.৩৭ শতাংশ থেকে ৪.৮৬ শতাংশীয় পয়েন্ট কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.৮৬ শতাংশ।
এর আগে, গত মে মাসে বিবিএসের সাময়িক প্রাক্কলনে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ৬.৬৬ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। তবে চূড়ান্ত হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বাস্তব প্রবৃদ্ধি সেই হিসাবের চেয়ে প্রায় অর্ধেক কম হয়েছে।
বৃহৎ শিল্পের প্রবৃদ্ধি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেমে এসেছে মাত্র ১.০২ শতাংশে, যা আগের বছরের ৮.৩৮ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রবৃদ্ধিও অর্ধেকে নেমে এসেছে—৯.১৫ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৪.৬৬ শতাংশ। অন্যদিকে, কুটির শিল্পের প্রবৃদ্ধি ১০.০১ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৯২ শতাংশে। এ সময় বিদ্যুৎ খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১.৫৫ শতাংশ।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, গত অর্থবছরে সব খাতেই প্রবৃদ্ধি কমেছে, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিল্প খাত।
এর পেছনে তিনি কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শিল্প প্রবৃদ্ধির জন্য প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ, অন্যদিকে সাধারণ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা শিল্প খাতকে বিপর্যস্ত করেছে। নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, যা শিল্প খাতের সংকটকে গভীর করেছে।
মুজেরি আরও বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চরম সংকটে পড়েছিল, কিছু ব্যাংক তো প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। এর ফলে শিল্প খাতে ঋণের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়।
তাছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খুলতে সমস্যা হয়েছে। সেই সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগও প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের এই সম্মিলিত প্রভাব প্রবৃদ্ধির গতি থামিয়ে দিয়েছে, যার ফলে মহামারির পর এবারই প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম হয়েছে।
অন্য খাতেও ধাক্কা
শুধু শিল্প খাত নয়, কৃষি ও সেবা খাতেও প্রবৃদ্ধি কমেছে বলে বিবিএসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৩.৩০ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩.৩৭ শতাংশ। ফসল ও উদ্যানপালন খাতে কিছুটা উন্নতি হলেও পশুপালন, বনায়ন ও মৎস্য চাষে প্রবৃদ্ধি কমেছে, যার ফলে সামগ্রিক কৃষি প্রবৃদ্ধির হার নেমে গেছে।
সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিও কমেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.০৯ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫.৩৭ শতাংশ। পরিবহন, তথ্য ও যোগাযোগ, এবং আর্থিক ও বীমা খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর হয়ে গেছে।
শিল্প, কৃষি ও সেবা—তিনটি প্রধান খাতেই প্রবৃদ্ধি কমার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৪.২২ শতাংশে, যা আগের অর্থবছরের ৫.৮২ শতাংশ ছিল।
চলতি মূল্যে, ২০২৪ সালে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দাঁড়িয়েছে ৪৫০ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪৬০ বিলিয়ন ডলার।
বিবিএস জানিয়েছে, জিডিপি হিসাব প্রাক্কলনের জন্য ব্যবহৃত রপ্তানি আয়ের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের থেকে নেওয়া হয়েছে। ২২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০২২) এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০২৩) তুলনায় রপ্তানির প্রবৃদ্ধি (১২.২১ শতাংশ) বিবেচনায় নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিডিপির সাময়িক হিসাবের জন্য মোট রপ্তানি আয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল। তবে সংশোধিত হিসাবে দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মোট রপ্তানি আয় সাময়িকভাবে প্রাক্কলিত রপ্তানি আয়ের তুলনায় ২১.০৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের পূর্বাভাস সংশোধন করেছে। যেহেতু প্রবৃদ্ধির হিসাব আগের বছরের তথ্যের ওপর নির্ভরশীল, তাই রপ্তানি আয়ের পরিবর্তন সত্ত্বেও সামগ্রিক জিডিপি অনুমান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
সঞ্চয় ও বিনিয়োগেও নিম্নগতি
বিবিএসের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির সঙ্গে বিনিয়োগ, দেশজ সঞ্চয় ও জাতীয় সঞ্চয়ের অনুপাত যথাক্রমে ৩০.৭০ শতাংশ, ২৩.৯৬ শতাংশ ও ২৮.৪২ শতাংশ হয়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল যথাক্রমে ৩০.৯৫ শতাংশ, ২৫.৭৬ শতাংশ ও ২৯.৯৫ শতাংশ।
ফলে গত অর্থবছরের তুলনায় বিনিয়োগ ০.২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট, দেশজ সঞ্চয় ১.৮০ শতাংশীয় পয়েন্ট এবং জাতীয় সঞ্চয় ১.৫৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে।
মাথাপিছু আয় টাকায় বেড়েছে, ডলারে কমেছে
২০২৩-২৪ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী, মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে তিন লাখ চার হাজার ১০২ টাকা (২,৭৩৮ ডলার)। আগের অর্থবছরে এটি ছিল দুই লাখ ৭৩ হাজার ৩৬০ টাকা (২,৭৪৯ ডলার)।
ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্থানীয় মুদ্রায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে, তবে ডলারের হিসাবে তা সামান্য কমেছে।