তামাকের বিষ থেকে যেভাবে ‘গোলাপ গ্রাম’ হয়ে উঠলো বরইতলী
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দু'পাশে সারি সারি গোলাপ বাগান। প্রতিটি বাগান ছেয়ে আছে লাল গোলাপে। একটি-দু'টি নয়; এ যেনো লাল গোলাপের রাজ্য! হেমন্তের শীতল বাতাসে মিশে গোলাপের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে মহাসড়কে চলমান গাড়ির যাত্রী ও পথচারিদের মাঝে।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বরইতলী, হারবাংসহ ৮ টি গ্রামের প্রায় ১৭২ একর জমিতে হচ্ছে গোলাপের চাষ। বিশেষ করে উপজেলার বরইতলী ইউনিয়ন পরিচিতি পেয়েছে 'গোলাপ গ্রাম' হিসেবে। প্রতিদিন এসব বাগানের ফুল যাচ্ছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে।
এক যুগ আগেও চকরিয়া উপজেলার কৃষির প্রায় পুরোটাই ছিলো তামাক নির্ভর। ১৮টি উপজেলার ১০টি'র প্রায় ১০০০ একর জমিতে হতো তামাকের চাষ।
তবে পাঁচ বছরে পাল্টে গেছে সেই দৃশ্যপট। এখন তামাকের চেয়ে ফুল চাষে বেশি ঝুঁকছেন চাষিরা। প্রতিবছর ২০০ বাগান থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হচ্ছে।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর উপজেলার ৭০ হেক্টর জমিতে গোলাপ, ৪০ হেক্টরে গ্ল্যাডিওলাসসহ মোট ১১০ হেক্টর (২০২ একর) জমিতে ফুলের চাষ হচ্ছে।
তামাকের কুফল সম্পর্কে কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তর ও কিছু স্থানীয় এনজিও সচেতনামুলক প্রচারণায় মুলত পাল্টে যায় দৃশ্যপট।
বড়ইতলীতে যেভাবে গোলাপ চাষের শুরু

১৯ শতকের গোড়ার দিকে বরইতলী গ্রামের নিজ বাড়িতেই লাল গোলাপের বাগান তৈরি করেন জমিদার বাবু শ্রী নতুন চন্দ্র দে। কলকাতা ও ঢাকা থেকে বিভিন্ন প্রজাতির চারা সংগ্রহ করে বাড়ির আঙ্গিনায় বাগান তৈরি করেছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আরেক গোলাপপ্রেমী বরইতলী গ্রামের বাসিন্দা রব্বান কাদেরী কলকাতা ও ঢাকা থেকে উন্নত, বাহারি রঙের গোলাপ চারা সংগ্রহ করে নিজ বাড়িতে আরেকটি সৌখিন বাগান গড়ে তুলেছিলেন।
এ দুইজনের গোলাপ প্রেম ছড়িয়ে যায় গ্রামবাসীর মাঝে। গ্রামের প্রায় সবার আঙ্গিনায় একটা ছোট গোলাপ বাগান করা পরিণত হয় শখে। দুই যুগ আগে সেই শখ থেকে বাণিজ্যিক রূপ পায় গোলাপ চাষ।
শখ যেভাবে পরিণত হয় বাণিজ্যিক উদ্যোগে
স্থানীয় যুবক ও কৃষকদের মাঝে তামাকের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়তে দুই দশক আগে কাজ শুরু করে কয়েকটি এনজিও। তাদের প্রচারণাই পরবর্তীতে সামাজিক অন্দোলনে রূপ নেয়।
ইপসাসহ কয়েকটি এনজিও বরইতলী-হারবাংসহ আশপাশের উপজেলা গুলোতে গোলাপ চাষের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এছাড়াও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো তামাকের বিকল্প চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেছে নানা কার্যক্রম ও পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়ায় বদলে যায় বরইতলীর কৃষির চেহারা। তবে কৃষকরা জানান, এখনো পর্যন্ত গোলাপ চাষিদের কোনে ধরনের প্রণোদনার ব্যবস্থা করেনি সরকার।
বরইতলী ফুলবাগান মালিক সমিতির সভাপতি মো. মইনুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বরইতলীতে আজ যেসব গোলাপের বাগান দেখছেন, তার সবগুলোই এক সময় তামাকের ক্ষেত ছিলো। প্রায় দুই যুগ আগে চার একর জমিতে গোলাপের বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেছিলাম। শুধু আমি নই; চকরিয়ার শিক্ষিত যুব সমাজ তামাকের বিষ থেকে বেড়িয়ে আসতে গোলাপ বাগান করাকে আন্দোলন হিসেবে নিয়েছিলো। এখন আমাদের গ্রামে তামাকের চাষ নেই বললেই চলে।'

তিনি জানান, চলতি বছর শুধু বরইতলী গ্রামেই ৬০ একর জমিতে গোলাপের আবাদ হয়েছে। এছাড়া গ্ল্যাডিওলাস চাষ হয়েছে ৪০ একর জমিতে।
ইপসার প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান বলেন, "আমাদের টার্গেট হচ্ছে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। এ লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে আমরা তামাক চাষিদের গোলাপসহ তামাকের বিকল্প ফষল চাষের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে আসছি।"
তিনি আরো জানান, "তবে আইন অমান্য করে চকরিয়ার মাতামুহুরী নদীর তীর ঘেঁষে এখনো চলছে তামাক চাষ। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে তামাকচাষিদের পরিসংখ্যান নিয়ে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে।"
গোলাপ চাষ পরিণত হয়েছে সমৃদ্ধ ব্যবসায়
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরকান সড়কের দু'পাশে চোখ যতদুর যায় সারি সারি গোলাপের বাগান। মাঝে মাঝে দু'একটি গ্ল্যাডিওলাস বাগান। উত্তর ও দক্ষিণ বরইতলী গ্রামে গোলাপ বাগান রয়েছে প্রায় ৭০টি। অন্যগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হারবাংসহ পাশের কয়েকটি ইউনিয়নে।

চাষীরা জানান, সারা বছর চাহিদা থাকে গোলাপের। চাষও হয় বছরজুড়ে। তবে শীত মৌসুমে ডিসেম্বর-এপ্রিলে গোলাপের চাহিদা থাকে বেশি। কারণ এ সময়ে বিয়ে, বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখ, ভ্যালেন্টাইনস ডেসহ বিভিন্ন উৎসবে গোলাপের চাহিদা বাড়ে।
বাগান মালিকরা জানান, চকরিয়ায় উৎপাদিত এসব বাগানের সিংহভাগ গোলাপ সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রাম শহরের চেরাগী পাহাড়ের ফুল দোকানগুলোতে। বাকি গোলাপ যায় কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলা শহরে।
বর্তমানে পাইকারিতে ১০০ গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকা দরে। শীত মৌসুমে তা ৭০০-৮০০ টাকা দরে বিক্রি হবে। তবে বর্ষা মৌসূমে ফুলের চাহিদা একেবারে কমে যায়। সে সময় লোকশান গুনতে হয় কৃষকদের।
একতা বাজার এলাকার গোলাপ চাষি মুজিবুল হক তিন বছর আগে ৪০ শতক জমিতে গোলাপের চাষ শুরু করেন। নতুন বাগান করতে তার ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিলো। বর্তমানে প্রতিমাসে ৪০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করছেন।
মুজিবুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "একসময় আমরা তামাকের চাষ করতাম। কিন্তু তামাক চাষে যেমন পরিশ্রম বেশি, তেমন ঝুঁকিও। আত্মীয়-স্বজনরা বাড়িতে আসে না। রোগশোক লেগেই থাকত। তাই তিন বছর আগে তামাক ছেড়ে গোলাপ চাষ শুরু করি।"
তিনি জানান, বর্তমানে একদিন অন্তর অন্তর ১০০০ থেকে ১২০০ গোলাপ সংগ্রহ করা হয় তার বাগান থেকে। প্রতি পিস গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ৬ টাকায়।

দক্ষিণ বরইতলী গ্রামের মোহাম্মদ মুরাদ গত ১০ বছর ধরে ১২০ শতক জমিতে গোলাপের চাষ করছেন। তার বাগানে প্রায় ১০ হাজার গোলাপ গাছ রয়েছে।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "১২ জন শ্রমিক সারাবছর ধরেই আমার বাগানে গাছ করে। এই বাগান থেকে বছরে প্রায় ১৭ থেকে ১৮ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়। সার-পানিসহ প্রতি বছর বাগান পরিচর্যার জন্য খরচ হয় ৬ লাখ টাকার মত।"
দশ বছর ধরে এই বাগানে কাজ করছেন স্থানীয় মনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, "স্বামী নেই; দুটি মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। একজন প্রতিবন্ধি। গত দশ বছর ধরে এই বাগানে কাজ করেই সংসার চালাচ্ছি। কাজের জন্য প্রতিদিন ৩০০ টাকা মজুরি পাই।"
প্রয়োজন সরকারি প্রণোদনা

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন বলেন, স্থানীয় যুবকদের প্রচারণা ও কৃষি বিভাগের সহযোগীতায় চকরিয়াতে দিন দিন তামাকের চাষ কমছে। তবে করোনার সময় ফুল ব্যবসায় ব্যাপক ধস নেমেছিলো। কৃষকরা গতবছর থেকে সেই ক্ষতি পুশিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন।
তিনি আরো জানান, "এখানকার কৃষকদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ফুল বিপনন। চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার থেকে ব্যবসায়িরা না আসলে কৃষকদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। তাই চকরিয়ায় ফুল সংরক্ষনের জন্য হিমাগার তৈরী করা প্রয়োজন।"
বরইতলী ফুলবাগান মালিক সমিতির সভাপতি মো. মইনুল ইসলাম বলেন, "দিন দিন দ্রব্যমূল্যর দাম বাড়ছে। সে হিসেবে ফুলের দাম বাড়েনি বললেই চলে। অন্যদিকে ট্যোবেকো কোম্পানিগুলোর বেশি মুনাফায় তামাক চাষের প্রলোভন তো রয়েছেই।"
"তাই যদি গোলাপ চাষিদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়; ফুলের আবাদ আরও বাড়বে," বলেন তিনি।