‘একের পর এক মেধাবী শিক্ষার্থী খুন হচ্ছে, আমার ছেলে হত্যার বিচার পাব তো?’

'আমরা তিল তিল করে আমাদের সন্তানদের গড়ি, আর আমাদের সন্তানেরা শেষ হয়ে যায়। এইটা তো সরকার দেখল না। আজকে কেস হবে, পরশুদিন বের হয়ে চলে যাবে, দেশে এই তো হচ্ছে। এ কারণেই আরেকটি ছেলের ক্ষতি হয়ে যায়। তা না হলে কারোর সাহস ছিল না আবরার মরার পরে বুয়েটের কোনো ছেলের গায়ে হাত তোলার।'
অত্যন্ত ভারাক্রান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নিহত বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশের (২৪) মা ফারহানা ইয়াসমিন। তিনি হত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে সোমবার সন্ধ্যার দিকে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগে তিন দিন নিখোঁজ ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই শিক্ষার্থী।
মঙ্গলবার সকালে তার মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শেখ ফরহাদ বলেন, 'নিহত ফারদিনের মাথার পুরো অংশে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া তার বুকে আঘাতের চিহ্ন আছে। প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি, এটি হত্যাকাণ্ড। কারণ, আঘাতের চিহ্নগুলো স্বাভাবিক না।'
পরে দুপরে ফারদিনের মরদেহ নেয়া হয় ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানে ছিলেন তার বাবা কাজী নূর উদ্দিন। জানাজার আগে ছেলের পক্ষ থেকে সবার কাছে ক্ষমা চান কাজী নূর উদ্দিন।
জানাজা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ছেলে হত্যার বিচার চাইলেন। ছেলের লাশ নিয়ে বাসায় ফেরার সময় বুয়েটের এক শিক্ষককে (ছাত্র কল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক মিজানুর রহমান) কাছে পেয়ে তিনি বললেন, 'স্যার, একের পর এক মেধাবী শিক্ষার্থীরা খুন হচ্ছে। বিচার তো হচ্ছে না। আমার ছেলে হত্যার বিচার পাব তো?' এ সময় ফারদিনের বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন মিজানুর রহমান।
ফারদিনের বাবা আরও বলেন, 'ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না। একটাই দাবি, হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে তাদের যেন বিচারের মুখোমুখি করা হয়। একটাই প্রত্যাশা, ফারদিনের মায়ের মতো আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। এ জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।'
ছেলেকে কারা হত্যা করছে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই কাজী নূর উদ্দিনের। তিনি বলেন, 'আমি বা আমার ছেলে কারও ক্ষতি করিনি। আমার ছেলেকে কারা খুন করেছে, এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল হয়েছে। ফারদিনের চলাচলের ভিডিও ফুটেজ, সে কার সঙ্গে কথা বলেছে, কারা তাকে নিয়ে গেছে, ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেটি খুঁজে বের করবে।'
ডেমরার কোনাপাড়ার শান্তিবাগে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন ফারদিন। তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের নয়ামাটি এলাকায়।
ফারদিন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং ক্লাবেরও যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।
এদিকে পুলিশ এবং পরিবারের স্বজনরা বলছেন, ফারদিনের বান্ধবী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত ৪ নভেম্বর রাতে তাকে রামপুরা ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে নামিয়ে দেন ফারদিন। এরপর থেকে আর কোনও হদিস পায়নি ফারদিনের পরিবার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ৫ নভেম্বর রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন ফারদিনের বাবা নুর উদ্দিন।
জানা গেছে, গত চার বছর ধরে ওই তরুণীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে ফারদিনের। পাশাপাশি তারা একটি ডিবেট ক্লাবেরও সদস্য। ৪ নভেম্বর ঘোরাফেরার পর রাত সোয়া ১০টায় ওই তরুণী বাসায় ফিরে আসে বলে পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন তিনি। সাধারণ ডায়েরি গ্রহণ করে ওই তরুণীসহ অন্যান্যদের সঙ্গে ফারদিনের মোবাইল কল রেকর্ডের সূত্র ধরেই তদন্ত করছে পুলিশ।
ফারদিনের মামা খান সেলিমুজ্জামান বলেন, 'আমরা ধারণা করছি, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এর পেছনে কারা রয়েছে, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করে বের করবে। আমরা পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে মামলা দায়ের করবো। এখন তার দাফন প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা ব্যস্ত।'
রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমরা বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এরই মধ্যে তার বান্ধবী, যাকে রামপুরা ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে নামিয়ে দিয়েছিল ৪ নভেম্বর রাতে তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাকেও আমরা সন্দেহের বাইরে রাখছি না।'
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এ ঘটনার পেছনে প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে আমরা কাজ করছি। বান্ধবীকে নামিয়ে দেওয়ার পর সে কোথায় কোথায় গিয়েছে, সে বিষয়ে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। সেসব বিষয় তদন্ত করে পরবর্তী সময়ে বোঝা যাবে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নাকি এর পেছনে অন্য কোনও ঘটনা ঘটেছে।'