'সরকারি ধর্মঘটে' শ্রমিকের সংকট, সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে

'রংপুরে পরিবহন ধর্মঘট আসলে শ্রমিকদের নয়, এটি সরকারের। এখানে আমাদের মতো শ্রমিকদের কিছু করার নেই। আমরা শুধুমাত্র সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছি,' রংপুর শহরের বাস টার্মিনালে বসে কথাগুলো বলছিলেন মো. আলমগীর হোসেন। রংপুর-দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও রুটের 'আল আকসা' বাসের সুপারভাইজার তিনি। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ঠাকুরগাঁও থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের গাড়িতে করে রংপুরে নিয়ে এসেছেন তারা।
আলমগীর বললেন, 'বাস থেকে আয় করা টাকা দিয়ে প্রতিদিন সংসারের খরচ মিটে। এখন দু'দিন ধর্মঘটের নামে সরকারি ছুটি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার তো আমাদের খেতে দিবে না। তাহলে কী করব আমরা? মালিকদের তো লাখ লাখ টাকা। আমাদের সে উপায় নেই।'
তাদের সাথে আলাপকালে জানা গেল, ঠাকুরগাঁও বাস টার্মিনালে অন্তত ৫ হাজার শ্রমিক রয়েছেন।
পরিবহন নেতারা বলেন, রংপুরে অন্তত ৯ হাজার পরিবহন শ্রমিক রয়েছেন। তারা সবাই গাড়ি বন্ধ রেখে 'উপরের ইশারার দিকে' তাকিয়ে রয়েছেন।
আরেক বাসচালক আজাদ জানালেন, প্রতিদিন তার পরিবারের লোকজনের জন্য অন্তত ২০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। উত্তরাঞ্চলে গাড়ি চলাচল বন্ধ। টাকা আয়ের কোনো উৎস নেই। আবার গাড়ি চালানোর ক্ষমতাও নেই। কারণ এটি তো সরকারের ইশারায় দেওয়া 'ধর্মঘটের নামে হরতাল'।
'অথচ সরকার বিআরটিসি বাস ঠিকই চালু রেখেছেন। তারপর আওয়ামী লীগের লোকজনকে তো চ্যালেঞ্জ করার উপায় নেই। আমার ভরসা পরিবহন নেতারাই। সিগন্যাল পেলেই গাড়ি চালাব', যোগ করেন আজাদ।
টার্মিনালে অন্তত ৫০ জন শ্রমিক বাসের মধ্যে বসে গল্প করছিলেন। কেউ কেউ আবার রাতে বিএনপি নেতাদের পরিবহন করে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ পরিবহন নেতাদেরও সমালোচনা করছেন। রংপুর থেকে তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা রুটে চলাচলকারী এক চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, 'পরিবহন নেতা বলতে এখন কিছু নেই। সবাই দালাল। সব সময় সবাই সরকারি দলের তোষামোদী নিয়ে ব্যস্ত। এই নেতারা কখনো আমাদের উপকারে আসে না। অথচ আমাদের রাস্তায় নামিয়ে তারা ফায়দা হাসিল করে।'
রফিকুল ইসলাম নামের একজনকে দেখা যায় ১০ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে টার্মিনালে আসছেন। খোঁজ নিচ্ছিলেন, বিকালে বাস চলবে নাকি। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থেকে তারা বুধবার রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এসেছেন এক স্বজনকে দেখতে। বৃহস্পতিবার রফিকুল খবর পেয়েছেন তার বাড়ির দুটি গরু অসুস্থ। কিন্তু এখন সহজে বাড়ি ফেরার উপায় নেই।
রফিকুল বলেন, 'এখন বাধ্য হয়ে অটোরিকশা, ভ্যান কিংবা অন্য যেকোনো উপায়ে সুন্দরগঞ্জ ফিরতে হবে। বাসের লোকজন বললেন বিএনপির সমাবেশের কারণে ধর্মঘট চলছে। এই কারণে বাস বন্ধ। কী ভয়ানক ব্যাপার! দেশের কয়জন মানুষ সরাসরি রাজনীতি করে? অথচ আমরা হাজার হাজার মানুষ পরিবহন ধর্মঘটের শিকার।'
বগুড়া যাওয়ার জন্য শহরের মডার্ন মোড়ে সকালে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাইফুল শান্ত। কিন্তু কোনো বাস নেই রাস্তায়। তিনি ধর্মঘটের কথা শুনেই এসেছেন। তারপরও সাইফুলের আশা ছিল হয়তো দুয়েকটি বাস বেশি ভাড়া নিয়ে হলেও রাস্তায় চলাচল করবে। কিন্তু একটি বাসেরও দেখা পাননি এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে। পরে আশাহত হয়ে তার মতো আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী মিলে অটোরিকশায় যাত্রা শুরু করেন।
সাইফুল বলেন, 'এভাবে দেশটাকে রাজনীতির মধ্যে আটকে ফেলে আমাদের পিষে মারছে কিছু লোক। এখন দুনিয়াতে তাদের বিরুদ্ধে বিচার চেয়ে লাভ নেই।'
শহরের সিও বাজারের লাভলু মিয়া। রিকশা চালান ২১ বছর ধরে। ধর্মঘটের কারণে তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত বলে দাবি করলেন। বলেন, 'সবাই বোঝে এটি সরকারি ধর্মঘট। সরকার ধর্মঘটের নামে গরীব মানুষের পেটে লাথি মারছে। শহরে কোনো মানুষ নেই রিকশায় ওঠার মতো। আমাদের তো অবৈধ ইনকাম নেই। প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে খেতে হয়।'
তবে পরিবহন নেতাদের দাবি ভিন্ন। ধর্মঘট ডাকার পেছনে তাদের অজুহাত হলো রংপুর অঞ্চলে মহাসড়কে 'অবৈধ যান চলাচল' করছে; এসব যান চলাচল বন্ধের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে জেলা মোটর মালিক সমিতি।
তাদের ধর্মঘট অনুযায়ী, শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তারা কোনো ধরনের যানবাহন চালাবে না। এর মধ্যে বাস, মিনিবাস, ট্রাক ও মাইক্রোবাস রয়েছে।
রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতির সভাপতি একেএম মোজাম্মেল হকের ভাষ্য, 'মহাসড়কে নিরাপত্তার জন্য পরিবহন মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আইন করেছে। কিন্তু রংপুরের মহাসড়কগুলোতে এখনো নছিমন, করিমন, ভটভটিসহ বিভিন্ন অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। এজন্য প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এমন অবস্থায় মহাসড়কে এসব যান চলাচল বন্ধের জন্য কয়েকটি সংগঠন মিলে সভা করে শুক্রবার ভোর থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রংপুরের সকল রুটে পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে।'
তবে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য হলো, আগামীকাল শনিবার তাদের রংপুরে বিভাগীয় গণসমাবেশ হবে। এই সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতেই সরকারের প্রচ্ছন্ন ধর্মঘট।
বিএনপির রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এর আগের মহাসমাবেশেও পরিবহন ধর্মঘটের নামে একই পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। রংপুর, ময়মনসিংহ ও খুলনায় সরকার একই কৌশলে খেলছে। এতে লাভ নেই। আমরা তো গণদাবির কথা বলছি। মানুষের মুক্তির কথা নিয়ে মাঠে এসেছি। সরকার বার বার বলে বিএনপি ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু এখন সরকারই ষড়যন্ত্র করে আমাদের বাধা দিচ্ছে। তবে এভাবে বাধা দিয়ে গণজোয়ার ঠেকানো যাবে না।'