হারিয়ে যাচ্ছে কুমিল্লার নমশূদ্র পল্লির বাঁশ-বেত শিল্প

কুমিল্লার গোমতী নদীর পালপাড়া ব্রিজ। এ ব্রিজ থেকে ৫০ গজ পূর্বে গোমতীর বেড়িবাঁধ ঘেঁষা নমশূদ্র পল্লি। কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার আড়াইওরা গ্রামে অবস্থিত এ পল্লি। বংশ পরম্পরায় বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে চলে এখানকার বাসিন্দাদের সংসার।
এ পল্লির এক হাজার মানুষ সম্পৃক্ত আছেন এ পেশায়। তবে চড়া সুদের ঋণ এবং ঠিকমতো ঋণ না পাওয়ায় সংকটের মুখে পড়েছেন নমশূদ্র পল্লির বাসিন্দারা।
নমশূদ্র পল্লির কুটির শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুমিল্লার লালমাই উপজেলা থেকে তল্লা বাঁশ, মুলি বাঁশ ও বউরা বাঁশ সংগ্রহ করেন তারা। প্রতিটি বাঁশের দাম পড়ে মানভেদে ১২০ থেকে ২৫০ টাকা।

সেই বাঁশ প্রথমে পানিতে ভেজান, তারপর শুকান। শুকনো বাঁশ আবার ভেজানোর পর পুনরায় শুকিয়ে শুরু হয় বেত তোলা।
বেত তোলার কাজ শেষ হলে বাঁশের ঝুড়ি-কুড়ি তৈরির কাজে হাত দেন তারা। সাধারণত কুলা, খাঁচা, ওরা, ঝুঁড়ি ও ডালা তৈরি করেন। বর্ষা ঋতুতে তৈরি করেন মাছ ধরার ফাঁদ। প্রতিটি পণ্যের দাম পড়ে গড়ে ১২০ টাকা।
ঠিকভাবে বেত তুলতে পারলে প্রতি সপ্তাহে একজন কুটির শিল্পী ১৫ থেকে ২০টি পণ্য তৈরি করতে পারেন।
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার দাউদকান্দি, মহানগরীর চকবাজার, হোমনা উপজেলা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর বাজারে বিক্রি হয় এসব পণ্য। ব্যাপারিরা গ্রামে এসেও কারও কারও কাছ থেকে সরাসরি পণ্য সংগ্রহ করেন।
আড়াইওরা নমশূদ্র পল্লির এক হাজার মানুষ সম্পৃক্ত আছেন এ পেশায়।এর মধ্যে ছয় শতাধিক নারী। প্রতি মাসে খাবার খরচ বাদে একজন কুটির শিল্পী গড়ে পাঁচ হাজার টাকা জমাতে পারেন। জমানো টাকা থেকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, ঋণ পরিশোধ ও আনুষাঙ্গিক খরচ মেটান তারা।

বংশ পরম্পরায় কুটির শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও এনজিওর ঋণের চাপে এ শিল্পকে সম্প্রসারিত করতে পারছেন না নমশূদ্ররা। পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও পর্যাপ্ত পুঁজির অভাবে চাহিদামতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না কেউ কেউ। ফলে বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না তারা।
অন্যদিকে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় এবং ভালো পুঁজি খাটাতে না পারায় তরুণ প্রজন্ম ঝুঁকছে অন্য পেশায়। অনেকে চলে যাচ্ছেন বিদেশে। অনেক নারী এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও পুরুষ কুটির শিল্পীর সংখ্যা দিন দিন কমছে।
নমশূদ্র পল্লির সুভাষ চন্দ্র নম ৩০ বছর ধরে সম্পৃক্ত আছেন এ পেশায়। তিনি বলেন, 'বংশগত কারণে এ পেশা ধরে রেখেছি। আয় রোজগার যেমনই হোক, কাজটা চালিয়ে যেতে চাই। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কারও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।'

শংকর চন্দ্র নম নামে অপর এক কুটির শিল্পী বলেন, 'বেশ কয়েক বছর ধরে বাঁশ-বেতের কাজ করাতে খুব দ্রুত পণ্য তৈরি করতে পারি। দিনে অন্তত আটটি ঝুড়ি বানাতে পারি। টানাপড়েন না থাকলে কাজ করে আনন্দ পেতাম।'
কুটির শিল্পী কানন বালা দাস বলেন, 'সপ্তাহে যে টাকা আয় করি, তার একটা অংশ চলে যায় ঋণ পরিশোধের কাজে। কম সুদে ঋণ এবং সরকারের সহায়তা পেলে আমাদের ঐতিহ্যবাহী পেশাটা ধরে রাখতে পারতাম।'
নমশূদ্র পল্লির মরণী রাণী দাস জানান, তার একমাত্র ছেলে প্রতিবন্ধী। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কুটির শিল্পী। কোনো রকম খেয়ে-পরে জীবন কাটাচ্ছেন। কিন্তু কোনো টাকা জমাতে পারছেন না।

সদর উপজেলার উত্তর দুর্গাপুর ইউপির চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'কুটির শিল্পীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের অনেক সুযোগ আছে। কিন্তু উৎপাদনের সঙ্গে আয়ের সমন্বয় না থাকায় তাদের এ পেশায় ধরে রাখা যাচ্ছে না। একজন কুটির শিল্পী দিনে পাঁচটি কুলা বানাতে পারলেও তার ৩০০ টাকা লাভ থাকছে না, সেক্ষেত্রে তিনি কেন এ পেশা ধরে রাখবেন? যুগের তালে তারা পিছিয়ে পড়ছেন।'
সমাজসেবা কার্যালয় কুমিল্লা অঞ্চলের উপপরিচালক জেড এম মিজানুর রহমান বলেন, 'আড়াইওরার কুটির শিল্পীদের জীবনমান উন্নয়নে যে ধরনের সহায়তা দরকার, তা করতে সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হবে।'